বীর মুক্তিযোদ্ধা চাচা

শাকিব হুসাইন | বুধবার , ৮ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

মূল সড়কের পশ্চিম পাশ দিয়ে ছোট একটা রাস্তা বের হয়ে গেছে। কোনমতে একটা ভ্যানগাড়ি চলে রাস্তাটা দিয়ে। রাস্তাটা দিয়ে আধা মাইল হেঁটে গেলেই চোখে পড়বে একটা ছোট পাকা বাড়ি। বাড়িটা রশীদ মিয়ার। গতবছর তার স্ত্রী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। রশীদ মিয়ার পনেরো বছরের ছোট একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়েও আছে। ওর নাম রুপু। রুপুকে নিয়ে রশীদ মিয়া কোনমতে বেঁচে আছে এই দুনিয়ায়। রুপু এবার জেএসসিতে বৃত্তিও পেয়েছে। মেয়ের সাফল্যে রশীদ মিয়া তার লাল গরুটা জবাই করে গ্রামের সবাইকে খাইয়েছে। আজ সকাল থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। একটুকুও থামার নাম নেই। রাতেরবেলা রশীদ মিয়া বারান্দায় বসে রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধরাচ্ছেন। কিন্তু কোনমতে ধরছে না। একপর্যায়ে ধরে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। আপনারা যেখানে আছেন, যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ জয় বাংলা। রশীদ মিয়া রুপুকে কাছে ডাকে। রুপু ছুটে আসে বাবার কাছে।
– শুনেছিস মা। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে। আমাদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলেছে। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বলেছে। -সত্যি বলছ বাবা ? -হ্যাঁ, রে মা হ্যাঁ। এই যে শোন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। তখন বাবা-মেয়ে দু’জনে আবার রেডিওতে মন দিল। রেডিও থেকে ভেসে আসছিল বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী সেই অমর বাণী-’ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ জয় বাংলা। -কি জ্বালাময়ী কণ্ঠ না রে মা? -হ্যাঁ, বাবা। আচ্ছা বাবা আমরা কি ওদের সাথে পারব? -আমাদের পারতেই হবে রে মা। ওদের অত্যাচার সইতে সইতে বাঙালিরা অতিষ্ঠ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে সবাই বুকে সাহস পেয়েছে। আমরা পারব রে মা।
– তাই যেন হয় বাবা। চল তোমাকে ভাত বেড়ে দেই। জয় বাংলা বলতে বলতে দু’জনে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল। এভাবে বেশকিছু দিন কেটে গেল। পাকিস্তানি হানাদার মিলিটারিরা হামলা করা শুরু করে দিয়েছে বাঙালিদের উপর। সকাল সকাল রশীদ মিয়া বারান্দায় বসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধরাচ্ছেন। এক সময় ধরে যায়। রেডিও থেকে ভেসে আসছে, গতকাল রাতে পাকিস্তানি হানাদার মিলিটারিরা হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করেছে। রশীদ মিয়া রুপুকে ডাকে। রুপু ছুটে আসে বাবার কাছে। -শুনেছিস রে মা। -কি বাবা?
পাকিস্তানি হানাদার মিলিটারিরা গতকাল হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করেছে। -কি বলো বাবা। এরকম পশুর মতো জঘন্য কাজ কেউ করতে পারে? -পারে রে মা পারে। পাকিস্তানি হানাদার পশুরা সব করতে পারে। -আচ্ছা বাবা, আমরা কি তাহলে ওদের কাছে হেরে যাবো? – আল্লা’ই ভালো জানে রে মামা । তবে আমার মন বলছে আমরা জিতব। আমরা বাঙালি , মাটির সন্তান। ওঁরা আমাদের পরাজিত করতে পারবে না রে মা। – তাই যেন হয় বাবা । এখনো তুমি মুখে কিচ্ছুটি দাওনি। চলো হাতমুখ ধুয়ে পান্তা ভাতটা খেয়ে নাও।
– না রে মা। আজ আমার গলা দিয়ে কিছু নামবে না। তুই বরং খেয়ে নে যা। -তুমি না খেলে আমি কি করে খাই । আমিও খাব না তাহলে।
– আচ্ছা , মা। চল যা আছে তা ভাগ করে খাই। দু’জনে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল। এভাবে আরো তিনমাস কেটে গেল। আজ আবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধরাচ্ছেন রশীদ মিয়া। আজ একবারেই ধরে যায়। রেডিও থেকে ভেসে আসছে, পাকিস্তানি হানাদার মিলিটারিদের মারতে গেরিলা বাহিনী ঢুকে পড়েছে শহরের আনাচে কানাচে। বিভিন্ন অপারেশনে তারা সফলও হচ্ছে । মিলিটারিরা গ্রাম-গঞ্জেও ঢুকে পড়েছে। সাথে সাথে রশীদ মিয়া রুপুকে কাছে ডাকে। রুপু ছুটে আসে বাবার কাছে ।
– মা রে শুনেছিস। -আবার কি সর্বনাশ হয়েছে বাবা?
– সর্বনাশ না রে মা। খুশির খবর। -কি খুশির খবর বাবা?
– বাঙালিরা লড়াই শুরু করে দিয়েছে রে মা। তোকে বলেছিলাম না আমরা বাঙালিরা ভীতুর জাত নই। আমরা লড়াই করতে জানি। -তাহলে আমরা জিতব বাবা। -অবশ্যই জিতব রে মা। আর একটা কথা মা। পাকিস্তানি হানাদার মিলিটারিরা গ্রামেও নাকি ঢুকে পড়ছে। তুই কিন্তু বাইরে বেরোস না । জানি না পশুরা কখন কাকে হত্যা করে।
– আচ্ছা, বাবা। রশীদ মিয়া সুর তুলে গাইতে শুরু করলেন। সাথে রুপুও। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ এভাবে আরো একমাস কেটে গেল। এক রাতে রশীদ মিয়া আর রুপু দু’জনে ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় দরজা থেকে ঠকঠক আওয়াজ এসে পড়ল রুপুর কানে। রশীদ মিয়াও জেগে গেল। রশীদ মিয়া বলল… -কে দরজায় শব্দ করে?
– চাচা আমি মুক্তিযোদ্ধা। দরজা খুলে দিন । রশীদ মিয়া আর একমুহূর্ত দেরি করল না। সাথে সাথে দরজা খুলে দিল। – চাচা এক গ্লাস পানি হবে? রুপু পানি এনে দিল। লোকটা ঢকঢক ঢকঢক করে পানি পান করল। -তুমি এখানে কি করে বাবা? – চাচা বেলতলার গাঁয়ে মিলিটারি ঢুকেছে। ওদের সাথে অস্ত্র লড়াইয়ে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারিনি। সবাই ভাগ ভাগ হয়ে সরে পড়েছি। কালকে একখানে মিলব সবাই। তারপর ওদের কিচ্ছা খতম করে দেব। -ভাইয়া, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ক’দিন ধরে ভালোমতো খাওনি। আদুরে গলায় রুপু বলল।
– তুমি কি করে জানলে? -আমি সবার মুখ দেখেই বুঝতে পারি । আচ্ছা, আমি তোমাকে ভাত বেড়ে দিচ্ছি। রুপু লোকটাকে ভাত বেড়ে দিল। লোকটা খাওয়া শুরু করল। পরেরদিন রুপুদের থেকে বিদায় নিয়ে লোকটা চলে গেল তার দলের কাছে। এভাবে প্রতিদিন একজন করে মুক্তিযোদ্ধা আসে রুপুদের কাছে। রুপু নিজ হাতে রান্না করে ওদের খাওয়ায় । মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক আপন হয়ে যায় রশীদ মিয়া আর রুপু। একরাতে যখন দু’জন মুক্তিযোদ্ধা খেতে বসেছে ঠিক তখনই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো । রশীদ মিয়া বলল… -কে দরজায়?
– হাম মিলিটারি হে। তুমারহা ঘার মে মুক্তি কা বাচ্চা হে। রুপু মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনের দরজা দিয়ে পালাতে বলল। মুক্তিযোদ্ধারা নিমিষেই পালিয়ে গেল। রশীদ মিয়া দরজা খুলে দিল। আর বলল…
– কই না তো স্যার। আমাদের ঘরে মুক্তিযোদ্ধা আসবে কোত্থেকে। একজন রাজাকার বলল … – স্যার এ মিথ্যা বলছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি মুক্তিযোদ্ধাদের এ ঘরে ঢুকতে। একজন মিলিটারি বলল…
– তো তুম নেহি বোলো গে। হাম তুমারহা লাড়কি কো লে যা তা হে। একজন মিলিটারি রুপুর হাত খপ করে ধরে ফেলল। রশীদ মিয়া বলল… -সত্যি বলছি স্যার । মুক্তিযোদ্ধারা এখানে আসে নি।
– তো তুম সাচ নেহি বলো গে। রুপু বলল… – বাবা, তুমি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা এদের বলবে না । এরা আমাকে মেরে ফেললেও বলবে না। রশীদ মিয়া মিলিটারিদের পায়ে পড়ল। তাকে লাথি মেরে রুপুকে নিয়ে গেল। চিৎকার করে কাঁদতে থাকল রশীদ মিয়া। পরেরদিন সকালে উঠোনে রুপুর রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখল রশীদ মিয়া। সাথে সাথে ছুটে গেল রুপুর কাছে। আর বলল… – রুপু, মা আমার। চোখ খোল। আমার উপর রাগ করেছিস। তোর মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ারা কিছুক্ষণ পর আসবে তো ওদের খাওয়াবি না। তুই ছাড়া ওদের খাওয়াবে কে ? রুপু উঠ রে মা। উঠবি না ? রুপু উঠ…. বলতে বলতে রশীদ মিয়া বুকফাটা চিৎকার করে রুপুর মৃতদের নিয়ে কাঁদতে থাকল । একাই মেয়েকে দাফন কাফন করল। সাথে ছিল কয়েকটা কাক আর নেড়ি কুকুরটা। আজ রুপুর মারা যাওয়ার একমাস হয়ে গেল। একমাস ধরে কোন মুক্তিযোদ্ধা আসে না রশীদ মিয়ার বাড়িতে। হঠাৎ একরাতে দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। রশীদ মিয়া বলল… -কে দরজায়?
– চাচা আমরা মুক্তিযোদ্ধা। রশীদ মিয়া দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
– চাচা, আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। আমরা জানতাম না যে মিলিটারিরা রুপুকে মেরে ফেলবে। আমরা এখানে অনেকবার আসার চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু আপনার বাড়ির পাশে সবসময় দু’জন রাজাকার ঘুরে বেড়ায়। ওদের জন্যই আপনার কাছে আসতে পারি না।
– তোমরা কি বলছ বাবা। তোমাদের রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল সেদিন আমার উপর। আর তোমরা না বাঁচলে দেশটারে কে পশুদের হাত থেকে রক্ষা করবে। আমার রুপুর মতো যেন আর কাউকে মরতে না হয় এজন্যই তোমাদের বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের। -চাচা, আপনি একজন খুব ভালো মানুষ। -আমি তোমাদের ভাত বেড়ে দেই। রুপু আমাকে বলেছিল , তোমরা আসলে যেন তোমাদের খাওয়াতে বলতে বলতে রশীদ মিয়ার দু-চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। রশীদ মিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভাত বেড়ে দিল। যখনই ভাত মুখে দিতে যাবে তখনই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। রশীদ মিয়া বলল …
– কে দরজায়? -হাম মিলিটারি হে। তুমারহা ঘার মে মুক্তি কা বাচ্চা হে। রশীদ মিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বলল… – তোমরা এখান থেকে চলে যাও বাবা। ওঁরা তোমাদের মেরে ফেলবে।
– না চাচা, আজ আমরা পালাব না। লড়াই করব। সেবার পালাতে রুপুকে হারিয়েছি। এবার আপনাকে হারাতে চাই না। কিছুক্ষণ পর মিলিটারিরা দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ল। শুরু করে দিল গোলাগুলি। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালাতে লাগলো। একজন মুক্তিযোদ্ধা মিলিটারির গুলি লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। রশীদ মিয়া সেই মুক্তিযোদ্ধার বন্দুক দিয়ে গুলি ছুঁড়তে থাকলো মিলিটারিদের উপর। হঠাৎ মিলিটারির একটা বুলেট এসে রশীদ মিয়ো বুকে লেগে গেল। সাথে সাথে রশীদ মিয়াও মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা সব মিলিটারিদের খতম করে দিয়েছে। তারা ছুটে আসল রশীদ মিয়ার কাছে। -চাচা, আপনি ঠিক আছেন? -আমি পেরেছি। আমার রুপুর হত্যাকারিদের মারতে পেরেছি। দেশের শত্রুদের মারতে পেরেছি। তোমরাই পারবে বাবা দেশকে পাকিস্তানি হানাদার পশুদের হাত থেকে বাঁচাতে। রুপু মা আমার, আমি তোর কাছে আসছি রে মা। বলতে বলতে রশীদ মিয়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। মুক্তিযোদ্ধারা রশীদ মিয়ার কথা শুনে কাঁদতে শুরু করল। আর বলল… – চাচা, আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ গড়ার পণ
পরবর্তী নিবন্ধবিস্ময়কর এক প্রাণি