বাঙালি সেনাদের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহটা ঘটেছে চট্টগ্রামেই

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী | রবিবার , ৫ মার্চ, ২০২৩ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

বিগ্রেডিয়ার এম আর মজুমদার ছিলেন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের প্রধান; ছিলেন তিনি একে বাঙালি তদুপরি পুরোপুরি জাতীয়তাবাদী। হামলা শুরু করার আগে সেনাধ্যক্ষ খাদিম হোসেন রাজা গেছেন চট্টগ্রামে, মজুমদারকে বুঝিয়েছেন যে জয়দেবপুরে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, মুরুব্বি হিসেবে সেখানে তাঁর

 

উপস্থিতি দরকার। খাদিমের মতে, মজুমদার খুশি হয়েই চলে এসেছিলেন। খুশি হয়ে মোটেই চলে আসেননি, এসেছেন বাধ্য হয়ে। ঢাকায় এনে তাঁকে বন্দি করা হয়। পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে এবং সেখানে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল।

মজুমদার বিদ্রোহ করতে চেয়েছিলেন। করতেনও, যদি রাজনৈতিক নির্দেশ পেতেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কাছে তিনি খবর পাঠিয়েছিলেন। তাঁর চিন্তা ছিল শেখ মুজিব চট্টগ্রামে গিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং যুদ্ধের নেতৃত্ব দেবেন। সেটা ঘটেনি। ঘটলে ইতিহাস ভিন্ন গতি নিতো। হানাদারেরা হামলা করার সাহস পেত না, হামলা করলেও যুদ্ধ তেমন একটা হতো না, শুরুতেই তারা পরাজিত হতো, এবং যুদ্ধ যেটুকু হবার হতো তা এই বাংলাদেশের মাটিতেই।

বাঙালি সেনাদের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহটা ঘটেছে চট্টগ্রামেই, ঘটেছে ক্যান্টনমেন্টে, ঘটেছে ইপিআরএর স্থানীয় হেডকোয়ার্টার্সে। চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেছেন বেতারকর্মীরা। যেখান থেকে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা প্রচারিত হয়েছে। চট্টগ্রামে সমুদ্র আছে, আছে সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর। রয়েছে

পাহাড়। যেগুলো নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হানাদারদের বিপদ ঘটতে পারত। পাকিস্তানিদের হিসাব ছিল যে ইপিআর বাহিনীতে রয়েছে এক হাজার সশস্ত্র বাঙালি সদস্য, পুলিশ লাইনে মওজুদ বিশ হাজার রাইফেল। রেডিও ট্রান্সমিটারটি বিদ্রোহের বাণী ছড়াচ্ছিল। পাকিস্তানিদের পক্ষে চট্টগ্রাম দখল করতে একটানা ছয় দিন যুদ্ধ করতে হয়েছে। স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীকে ব্যবহার করা দরকার পড়েছিল। বহু পাকিস্তানি হতাহত হয়েছে।

যুদ্ধের পরিচালনা নিয়ে হানাদার সেনাধ্যক্ষদের ভেতর বিরোধ বেঁধেছে। যুদ্ধ হয়েছে অনেক ক’টি শহরে। সেগুলোর বিবরণ নানা জায়গায় পাওয়া যাবে। সব কিছুর ভেতর থেকে বাঙালিদের জন্য যে বাণী বের হয়ে এসেছে কিন্তু একটাই। সেটা হলো সিদ্ধান্ত নিয়ে সমন্বয় করে আক্রমণ করলে হানাদারেরা যে ক্ষতি ঘটিয়েছে তার ক্ষুদ্রাংশও ঘটাতে পারতো না। তারা ভাতে মরতো, পানিতে মরতো; অস্ত্রাঘাতে তো মরতোই।

পাকিস্তানি জেনারেলদের বড় রকমের দুশ্চিন্তা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। তাঁকে বন্দি করতে পারা যাবে কি না, করা গেলে কোথায় কিভাবে তাঁকে রাখাটা ঠিক হবে, এসব নিয়ে অনিশ্চয়তা বিদ্যমান ছিল। বন্দি করার কাজটা যখন সহজেই সম্পন্ন হলো তখন টিক্কা খান এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে,

ভেবেছিলেন বাঙালির বন্দি নেতাকে ঢাকাতেই রাখবেন এবং প্রকাশ্যেই বিচার করবেন। তবে যাঁরা কিছুটা কম হিংস্র ও অধিক বাস্তববাদী ছিলেন তাঁরা স্বস্তি পেয়েছিলেন তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাতে পেরে। কিন্তু ইয়াহিয়া তাঁকে নিয়ে কী করবেন সেপ্রশ্ন ইয়াহিয়ার নিজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। লোকটির ওপর

আন্তর্জাতিক চাপ ছিল মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছার। কিন্তু মুজিবকে প্রকাশ্যে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা দেবার পর সেটা আর সম্ভব ছিল না। ওদিকে সেনাবাহিনী আশা করছিল তাঁর বিচার করা হবে। তাই বিচারের ঘোষণা নাদিয়ে উপায় ছিল না। আয়োজনও করা হয়েছিল। তবে

ইয়াহিয়ার বাঙালি উপদেষ্টা ও মন্ত্রী জি ডব্লু চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে হাসান জহীর লিখেছেন যে, বিচারের ব্যাপারে ইয়াহিয়া যে স্থিরসঙ্কল্প ছিলেন তা নয়। নানা টানাপোড়েনের মধ্যে বিশেষ সামরিক আদালতে বিচারের প্রক্রিয়াটি ঠিকই শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিচারের সূত্রপাত ১১ আগস্টে, সমাপ্তি ১ ডিসেম্বরে। সর্বসম্মত

মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেওয়া হয় ডিসেম্বরের ৪ তারিখে; কিন্তু ততক্ষণে তো ভারতপাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। রায় কার্যকর করার প্রশ্নটা তাই অবান্তর হয়ে পড়েছিল। তদুপরি আমেরিকানরা নাকি দাবি করেছিল এবং সম্মতিও আদায় করে নিয়েছিল যে, মুজিবের বিরুদ্ধে রায় বাস্তবায়ন করা হবে না। যুদ্ধ এসে অনেক কিছুরই মীমাংসা করে দিয়েছে।

হাসান জহীরকে নিয়ে আসা হয়েছিল প্রশাসনকে চালু রাখার জন্য। পূর্ববঙ্গ তাঁর অপরিচিত ছিল না, এখানে তিনি আগেও কাজ করেছেন। তাঁর দেওয়া বেশ কিছু খবর কৌতূহলোদ্দীপক। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের আগের দিনগুলোতে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন গভর্নমেন্ট হাউজে। সেখানে দেখেছেন যে সব সামরিক

অফিসার এক রকমের নয়। ফরমান আলীর পাশের কামরাতেই বসতেন ব্রিগেডিয়ার এস ডি আহমদ। সেনাবাহিনী যে পূর্ব পাকিস্তানকে কব্জায় রাখতে পারবে না এ বিষয়ে তিনি পরিষ্কার ধারণা রাখতেন এবং তা বলতেনও। ইনি বেশ ফুরফুরে মেজাজের লোক ছিলেন এবং তাঁর ওপরওয়ালাদের প্রতি কোনো ভক্তিশ্রদ্ধা

রাখতেন না। গভর্নর টিক্কা খান ছিলেন তাঁর বিশেষ সমালোচনার পাত্র। বিগ্রেডিয়ার আহমদ এমনও দাবি করেছেন যে, সামরিক হামলার হিংস্র দিনগুলোতে তিনি কয়েকজন বাঙালিকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। এঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের একজন অনলবর্ষী তত্ত্ববিদও ছিলেন; যাঁকে তিনি পালাবার ব্যাপারে সাহায্য

করেন। হাসান জহীর নিজেও সামরিক বাহিনীর অনেক তৎপরতার অন্তরশূন্যতা দেখতে পেয়েছেন। যুদ্ধে নরমপন্থিরা ছিলেন, কিন্তু তাঁদেরকে গরমদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়েছে।

লেখক : শিক্ষাবিদ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅর্থনীতি হোক নিরাপদ এবং টেকসই
পরবর্তী নিবন্ধপূর্ব ষোলশহরে হযরত আঁছি শাহের (রহ.) বার্ষিক ওরশ