বাঙালি জাতির শৃঙ্খলমুক্তির দিন

আরিফ রায়হান | বুধবার , ২৩ মার্চ, ২০২২ at ৯:৩৯ পূর্বাহ্ণ

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। এটি বাঙালি জাতির শৃঙ্খলমুক্তির দিন। বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর দিন। মুক্তির প্রতিজ্ঞায় উদ্দীপ্ত হওয়ার একটি দিন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালির ওপর চালিয়েছিল নির্মম হত্যাযজ্ঞ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ওই রাতেই গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু। তার আগেই তিনি বার্তা পাঠিয়ে দেন স্বাধীনতার ঘোষণার। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গে উজ্জীবিত সশস্ত্র জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের মুক্তির ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস। স্বাধীনতার ইতিহাস ৩০ লাখ শহিদের আত্মদান আর ২ লাখ মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও সংগ্রামের গৌরবগাথা, গণবীরত্বের ইতিহাস।
আমাদের স্বাধীনতা এক দিনে কিংবা হঠাৎ করে কোনো পাওয়া নয়। এর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে বছরের পর বছর। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজ বেনিয়া ক্লাইভের নির্দেশে এবং সেনাপতি ওয়াটসনের নেতৃত্বে ইংরেজ সৈন্যরা বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে নবাবের সেনাপতি মীর জাফর আলী সিংহাসনের লোভে ইংরেজদের পক্ষ নিয়ে তাদের যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করে। সেদিন বাঙালি জাতি পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ হয়। সেই পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্তি পেতে বহু আন্দোলন, বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এ জাতিকে।
এদিকে ১৯৪৭ সালে জন্ম নেয় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের। এসময় আমরা বাঙালি জাতি ইংরেজদের দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্তি পেলেও নতুন করে শাসনের নামে শোষণের জাঁতাকলে পড়ি পাক শাসকগোষ্ঠীর হাতে। তারা প্রথমে আঘাত হানে আমাদের ভাষার ওপর। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতি প্রাণ দিয়ে মায়ের ভাষার মান রক্ষা করেছিল। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের পর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং এরপর অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনে জয়লাভের পরও শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা শুরু করে। একদিকে বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের নাটক এবং অন্যদিকে গোপনে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। শাসক গোষ্ঠীর এই মনোভাব বুঝতে পেরে বাংলার মুক্তকামী মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এরমধ্যে একাত্তরের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা করে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু সেদিন আরো বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’
এদিকে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ সারাদেশে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। মধ্যরাতেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু ইপিআরের ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ডাক দেন। ইংরেজিতে ঘোষিত সেই স্বাধীনতা ঘোষণার বাংলা অনুবাদ হলো, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বাংলায় যে বার্তা পাঠান সেটি হলো, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রু বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করেন চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ হান্নান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত বাণীটি সর্বপ্রথম পাঠ করেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণার কপি ইংরেজি ও বাংলায় ছাপিয়ে চট্টগ্রামে বিলি করা হয়। এই ঘোষণা টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার ও তৎকালীন ইপিআর’র ওয়ারলেসের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয় এই ঘোষণা। জাতির জনকের স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালি ছাত্র-জনতা, কৃষক, শ্রমিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সাংবাদিক, সাহিত্যিকসহ নানা পেশার মানুষ পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। স্বপ্নের স্বাধীনতার জন্য সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাব্যাপী মুক্তিবাহিনীর সাহসী সন্তানদের শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিরোধ যুদ্ধে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে পাক সেনারা। ’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধে পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করে বাঙালির বীর সন্তানদের কাছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখোকার ডাকে স্বাধীনতা
পরবর্তী নিবন্ধরাজনীতির কবি