বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ২৬ জুলাই, ২০২১ at ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমরা আপনার সাহায্য কামনা করি

কোরবানীর ঈদের পরের দিন আমার মোবাইল টেলিফোন বাজতেছিল, আমি ফোন ধরি, ও প্রান্ত থেকে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম, আমি শেখ হাসিনা-’ এরপর ঈদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন এবং করোনায় সতর্ক থাকার কথা বলে কলটি শেষ করা হলো। এটি ছিল একটি ভয়েস কল। সরকার প্রধানের পক্ষ থেকে মোবাইল ব্যবহারকারীদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব কন্ঠস্বরে এই শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হয়। আমি মনে করি এটি একটি ভালো কাজ। আওয়ামী লীগ একটি জনবান্ধব রাজনৈতিক দল। এই দল সবসময় জনগনের সাথে সংযুক্ত থাকার চেষ্টা করে। আমি এর আগে বিভিন্ন ঈদে কিংবা নববর্ষের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভয়েস কল পেয়েছি। কিন্তু এবারের ভয়েস কলটি আমাকে আবেগ আপ্লুত করেছে। রাজনীতি হচ্ছে জনগনের সান্নিধ্যে থাকার একটি প্রক্রিয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগনের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেন, বিভিন্ন সময়ে উনার বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকে আমরা তা বুঝতে পারি। আমাদের এই রকম বিশ্বাস আছে যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কখনো জনগনের ইচ্ছাকে পদদলিত করবেন না।
সাহিত্য সংস্কৃতি, পরিবেশ নিয়ে কথা বললেও আমি মূলত কমার্সের ছাত্র। আমি যখন অনার্সে ভর্তি হই তখন বাংলাদেশে কমার্সে শুধুমাত্র একটাই অনার্স কোর্স ছিল সেটা হলো ‘অনার্স ইন কমার্স’ আমি যখন মাষ্টার্সে ভর্তি হই তখন কমার্সকে দুইভাগ করে একাউন্টিং এবং ম্যানেজমেন্ট দুটি বিষয়ে অনার্স মাস্টার্স পড়ানো শুরু হয়। এখন ফাইন্যান্স, মার্কেটিংসহ অনেক বিষয়ে বাণিজ্য বিভাগের ছাত্ররা অনার্স পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনেক আগে থেকেই বিবিএ ও এমবিএ কোর্স চালু করেছিলো। আমার লেখাপড়া মূলত একাউন্টিং ভিত্তিক। বড়ো বড়ো শিল্পগ্রুপ, জায়ান্ট কোম্পানী, শিল্পটাইগারেরা গতানুগতিকভাবে তাদের হিসাব প্রক্রিয়ায় ট্রেডিং একাউন্ট তৈরী করে তাদের গ্রস প্রফিট বের করেন, সেখান থেকে তারা প্রফিট এন্ড লস একাউন্ট তৈয়ার করেন। তাদের ব্যালেন্সসীটে মূলধন ও দায় এবং সম্পদের বিবরণ থাকে। যখন তারা বিনিয়োগ করেন তখন তারা জমি কেনার ব্যয়, কাঠামো এবং ভবন নির্মাণের ব্যয়, যন্ত্রপাতি কেনার ব্যয়, কাঁচামাল কেনার ব্যয়, শ্রমের মজুরি দেওয়ার ব্যয় এর বন্দোবস্ত করেন। তারা নিজেরা হয়তো কোন প্রাইভেট মালিকের কাছ থেকে জমি কিনে নেন কিংবা সরকারের অধিগ্রহণ করা জমি বরাদ্দ নেন। আমি বিজনেস ম্যানেজমেন্টের শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সময় উন্নত দেশের কয়েকজন একাউন্টিং ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পাই। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কয়েকজন অথারের সাথে আলাপ আলোচনায় আমি জানতে পারি যে ‘কস্ট্‌ অফ এনভায়রনমেন্ট’ অর্থাৎ পরিবেশ নষ্ট করার মূল্য সম্পর্কে আমাদের ভাবা উচিত। একটা জায়গার উপর যখন আমি একটা শিল্প কারখানা গড়ে তুলি কিংবা কয়েক মাইল এলাকা হুকুম দখল করে যখন আমি ইকোনমিক জোন বানাই তখন গাছপালা, পাখি, কীটপতঙ্গ, খাল বিলসহ পরিবেশ নষ্ট হয়ে যে ক্ষতি হয় তার কোন মূল্য আমাদের ব্যালেন্সসীটে অন্তর্ভূক্ত করিনা। দু’একজন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ আমাকে বলেছেন এটা অবশ্যই করা উচিত। আজ থেকে একশো বছর আগে শুরু হওয়া ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের পর থেকে শিল্প কারখানার যে জোয়ার এসেছে সব শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করার সময় যদি কারখানাওয়ালাদের উপরে পরিবেশ বিনষ্টের মূল্য ধার্য করা হতো তাহলে আজ জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থায়নের জন্য বিশ্ববাসীকে চিন্তা করতে হতো না। বড়ো বড়ো কারখানাগুলি থেকে বের হওয়া বর্জ্য, দূষিত পানি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নদী, খাল বিল নষ্ট করে দিয়েছে। কলকারখানা বিশ্বময় এমন দূষণ ছড়িয়েছে সাগরের পানি পর্যন্ত কলুষিত হয়ে গেছে। জাহাজ, বিমান, যানবাহন এরাও দূষণ ছড়াচ্ছে। আপনি নিজে বিবেচনা করুন আপনি একটি গাড়ী কিনে তার দাম পরিশোধ করলেন কোম্পানীকে। আপনি গাড়ী চড়ে বেড়াচ্ছেন কিন্তু আপনার গাড়ী থেকে বের হওয়া কার্বন মনোঙাইড আশেপাশের মানুষের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে। আপনি দশটি মাইক লাগিয়ে গানের অনুষ্ঠান করলেন কিংবা যেকোন ধরণের অনুষ্ঠান করলেন, আপনি আনন্দ পেলেন কিন্তু আশেপাশের মানুষদেরকে শব্দ দূষণের মধ্যে ফেলে দিলেন। আপনি চট্টগ্রাম বা ঢাকার সবগাছ কেটে ফেললেন, সব দিঘী ভরাট করে ফেললেন, সব নদী জবর দখল করলেন, পাহাড় ও টিলা কেটে ফেললেন, তারপর বানালেন হাইরাইজ ভবনের শহর। ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট। এবার শুরু হলো আপনার চিৎকার। জলবায়ু অদ্ভুদ আচরণ করছে, মানুষের অদ্ভুদ অদ্ভুদ রোগ হচ্ছে, মানুষ শ্বাস নিতে পারছেনা অঙিজেনের অভাবে। আজকে করোনাভাইরাসের যে বিপর্যয় তা কি মানুষের তৈয়ারী কোন বায়োটেক শিল্পকারখানার কাজের ফল কিনা তা কে বলতে পারে? যখন আমরা শিল্পায়নের প্রথম সোপানেও উঠতে পারিনাই তখন চীন চার-পাঁচটি গবেষণার ক্ষেত্রে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। দেং শিয়াও পিং এর আমলে চীন বায়োটেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিনোম সিকোয়েন্সিং, আইসিটি বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা পরিচালনা করে। আমেরিকা ও ইউরোপের উন্নত দেশগুলি জৈবপ্রযুক্তি গবেষণায় অনেকদূর এগিয়ে আছে। করোনাভাইরাস কিভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করলো, তা আমাদের জৈবপ্রযুক্তি গবেষণার ফল কিনা তা একদিন মানুষ জানতে পারবে। মহাকাশ গবেষণা, সমুদ্রের তলদেশে গবেষণা এবং সামরিক বিজ্ঞানের উন্নয়নে পরিচালিত গবেষণায় মানুষ যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা করার সময় পরিবেশের কথা মাথায় ছিল কিনা তা আপনি ভেবে দেখতে পারেন। সামরিক বিজ্ঞানে জীবানু অস্ত্র তৈরীর কি পরিমাণ গবেষণা হয়েছে তাও ভেবে দেখতে পারেন। পরিবেশ বিপর্যস্ত করা আর নিজেদের বিপদ নিজেরা ডেকে আনা একই কথা। প্রশ্ন হলো শিল্পকারখানার উদ্যোক্তাদের উপর, বিশ্বের কোন দেশে ‘কস্ট্‌ অফ এনভায়রনমেন্ট’ চাপিয়ে দেওয়া কি কখনো সম্ভব ছিলো? যে পরিবেশ আমরা বিনষ্ট করেছি টাকা দিয়ে কি সেই পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারবো? আমরা কিছুই করতে পারবোনা, শুধু চিৎকার করতে থাকবো-ফিরিয়ে দাও অরণ্য, লও হে নগর। এই আলোচনার প্রেক্ষিতে বলছি, চট্টগ্রামের যেখানে আমি পরিবেশের বিপর্যয় দেখি সেখানে কথা বলি।
আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত বলতে কঙবাজার সৈকতকে বুঝি। কিন্তু আমার যেখানে পৈত্রিক বাড়ী সেই হালিশহর পতেঙ্গার পশ্চিম দিকেও বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত ছিল। সেটি কর্ণফুলীর মোহনা থেকে সীতাকুন্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই সৈকতের সীতাকুন্ড ও কুমিরা অংশ এখন জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের দখলে। আর হালিশহরের সৈকতে এখন নির্মিত হচ্ছে বে-টার্মিনাল। সাগর সৈকত এখন উধাও। চট্টগ্রাম ইপিজেড বানানোর সময় এই সৈকতের পানি মিশ্রিত বালি এনে জমি ভরাট করা হয়েছিল। এই সৈকতের পূর্বেকার ইতিহাস একটু বলি। পঞ্চাশের দশকে আমাদের বাড়ীর পশ্চিম দিকে অনেক উঁচু বালির স্তূপ ছিলো। এই বালি সাগরের পানির সাথে এসে সৈকতে জমা হতো। জমা হওয়ার একটি অদ্ভুদ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ছিলো। এই বালিতে ‘উরি’ নামে একধরণের কাটা ঘাস ছিলো। এই ঘাসের শিকড় বালির অনেক গভীরে থাকতো, পাতাগুলি অনেক শক্ত এবং সুঁচালো। জোয়ারের সময় ‘উরি’ ডুবে যেতো। ভাটার সময় বালি ও মাটি ঘাসের পাতায় লেগে থাকতো। এইভাবে ‘ধুম’ নামক একটি বালিয়াড়ি সাগর সৈকতে প্রাকৃতিকভাবে তৈয়ার হতো। এই বালিয়াড়িতে লাল রঙের কাকড়া বসবাস করতো। আমরা লাল কাকড়া দেখতে যেতাম। মানুষ দেখলে ওরা গর্তে ঢুকে যেতো। ভাটার সময় অসংখ্য লার্ক পাখি বালিয়াড়ির উপরে বসে থাকতো। এই অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত সৈকত প্রাকৃতিক ঝিনুকে ভর্তি ছিল। এইসব দেখে দেখে আমরা বড়ো হয়েছি। পঞ্চাশের দশকে চট্টগ্রাম বন্দর পোর্ট কলোনী (নর্থ কলোনী) বানানোর সময় হালিশহরের সৈকত থেকে সমস্ত ধুম কেটে বালি ও মাটি নিয়ে আসে। সেই সৈকতে মাটি খোড়ার জন্য বুলডোজার এবং ট্রাকে মাটি তোলার জন্য স্কেভেটরের ছড়াছড়ি ছিল। ডাম্পার নামের বিশাল বিশাল ট্রাক সেখান থেকে সারাদিন সারারাত মাটি এনে বন্দরের কলোনী বানানোর জন্য ভরাট করতো। ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসা সৈকত সংলগ্ন জমি হুকুম দখল করে। তারাও সৈকতের মাটি কেটে হুকুম দখলকৃত জমির একটি অংশ ভরাট করেছিল। কিন্তু জমিগুলি তারা কোন কাজে ব্যবহার করেনি। এইভাবে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাদের চোখের সামনে বিনষ্ট হয়েছে। এইসব দেখে দেখে আমরা ক্লান্ত। আমরা কথা বলতে পারিনা, বুক ফেটে যায়। আমার দূর্ভাগ্য হলো, গ্রামে আমার কোন বাড়ী নাই। মাঝেমাঝে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়ার কোন সুযোগ আমার নাই। আমার জন্ম শহরে, এই শহর যতই উন্নত হোক তা প্রকৃতি বিপর্যয়ের শিকার। আজ যখন আমি সিআরবিতে শিরিষতলার পাশে ছয় একর জায়গার উপরে হাসপাতাল নির্মাণের খবর শুনি তখন আমার বুক কাঁপে। আশংকা হয় শিরিষতলার পরিণতিও কি হালিশহরের সমুদ্র সৈকতের মতো হবে? শতবর্ষী গাছগুলি কাটা পড়বে? পাখিরা পালিয়ে যাবে? সংস্কৃতিকর্মীরা বুক চাপড়াবে?
আওয়ামী লীগ জনগণের দল। তারা জনগনের কথা শুনবে। শুরুতে বলেছিলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি ভয়েস কল পেয়ে আমার ভালো লেগেছিল। আমিতো আর উনাকে ফোন করতে পারবো না? সেই সুযোগ আমার নাই। হয়তো মোবাইল অপারেটরের বদৌলতে ভবিষ্যতে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ভয়েস মেসেজ পাবো। উনার প্রতি আমার অনুরোধ, আপনি দয়া করে শিরিষতলা রক্ষায় আপনার দয়ালু হাত দুটি বাড়িয়ে দিন। যে হাতে আপনি লক্ষ লক্ষ ভূমিহীনকে থাকার ঘর দিয়েছেন, যে হাতে আপনি ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছেন।
একজন বুড়ো মানুষকে শিরিষতলার শতবর্ষী একটি বৃক্ষের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে আমি অবাক হই, তখন রাতের আধার নামতে শুরু করেছে। তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম তুমি কি করছো? সে বললো কাঁদছি। এখানে আমি কাঁদতে এসেছি, প্রতিবাদ করতে আসিনি, এখানে আমি কাঁদতে এসেছি, বিচার চাইতে আসিনি।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযুবসমাজের যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জনে মনোযোগী হওয়া জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধআল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ (রহ.)