যুবসমাজের যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জনে মনোযোগী হওয়া জরুরি

কুমার প্রীতীশ বল | সোমবার , ২৬ জুলাই, ২০২১ at ১০:৫২ পূর্বাহ্ণ

কোভিড নামের মহামারীটি বিশ্বব্যাপী কি ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন একটি প্রেক্ষাপটে ১৫ জুলাই বিশ্বব্যাপী অনেকটা নীরবেই পালিত হলো ‘বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস’। ‘মহামারী উত্তর যুব দক্ষতা বিষয়ে পূর্ণভাবনা’-এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কাউন্সিল ‘বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস’ পালন করে। এবছর ‘বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস’ পালন খুবই চ্যালেঞ্জিং। করোনাকালীন সঙ্কটের কারণে আর্থ-সামাজিক অবস্থা, আয় এবং জীবিকার উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলছে। করোনাকালীন লকডাউন ব্যবস্থার ফলে বিশ্বব্যাপী স্বাভাবিক শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশীপ এবং শিক্ষানবিশীসহ দক্ষতা বিকাশের ধারাবাহিকতাসমূহ আজ হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীরা স্কুল বন্ধের কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)পরিচালিত এক বৈশ্বিক জরিপের মাধ্যমে জানা যায়, ৮০% এরও বেশি শিক্ষানবিশী উদ্যোক্তার প্রশিক্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে। মহামারী শেষ হওয়ার পরেও এর প্রভাব থাকবে। কোভিড সংকটের ফলে যে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে, তা ব্যাপক আকার ধারণ করবে ক্রমেই। ইতিমধ্যে প্রতি ছয়জন তরুণ-তরুণীর মধ্যে একজনের কাজ করা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বেকারত্বের হার বেড়ে যাবে। আইএলও’র অনুমান অনুসারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আশা করে, বিশ্ব অর্থনীতি হ্রাস পাবে। আইএলও সতর্ক করেছে, পূর্ণকালীন চাকরিজীবী ঝুঁকির মুখে পড়বে। বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা করছে, প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি হবে।
কোভিডের আগেই ১৫-২৪ বছর বয়সী যুবসমাজ শ্রমবাজারে একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়ে। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দুই অথবা তিনগুণ বেশি যুবক চাকরি হারাবে অথবা যোগ্যতানুযায়ী চাকরি পাবে না। কোভিডের আগেও প্রায় ২৭ কোটির বেশি যুবকের কর্মসংস্থান ছিল না, ছিল না শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ, সে সঙ্গে আছে সাত কোটি বেকার যুবক। যারা চাকুরি করছেন তাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন অনানুষ্ঠানিক চাকরিতে, তারাও ঝুঁকির মুখে পড়বে। মহামারী শেষ হওয়ার পরে এবং লকডাউন ব্যবস্থা তোলার পরেও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব থাকবে এবং পরিবেশ সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যুবতী মহিলা, প্রতিবন্ধী যুবক, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের যুবক এবং অনানুষ্ঠানিক কাজে বা স্ব-কর্মসংস্থানে নিয়োজিতদের সর্বাধিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বাংলাদেশে গেল বছরের প্রথম ছয়মাসে ৩ লক্ষেরও বেশি অভিবাসী ব্যক্তি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষত মধ্য প্রাচ্য থেকে ফিরে এসেছে। এছাড়াও একটি ভালো সংখ্যক অভিবাসী ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে, আমরা জানি না সংখ্যাটি কত বড়। এটি কেবল মধ্য প্রাচ্য থেকে নয়; একই সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও হতে পারে। বিশ্বের ১৭৪ টি দেশে বাংলাদেশী অভিবাসী ব্যক্তি রয়েছে, যার সিংহভাগ মধ্যপ্রাচ্যে।
করোনা পরবর্তী নতুন পরিস্থিতিতে, চীন, জাপান নতুন শিল্প উদ্যোগের কথা ভাবছে। কোরিয়া ইতিমধ্যে বিনিয়োগের জন্য নতুন গন্তব্য অনুসন্ধান করছে। স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য অনেক নতুন উদ্যোগ প্রয়োজন হবে। এখন পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে, করোনা পরবর্তী নতুন পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক চাহিদা এক হবে না, শিল্প-কারখানায় নতুন নতুন উদ্ভাবনী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে, পুঁজিবাজার পুনর্গঠিত হবে। ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে, ভবিষ্যতের চাকরির সুযোগটি স্বাস্থ্য, কেয়ার গিভিং, আইটি এবং এআই ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা, অ্যাকাউন্টিং এবং বড় বড় ডেটা ব্যবস্থাপনা, ইন্টারনেটভিত্তিক সামগ্রী (আইওটি) ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি করবে। ফার্মাসিউটিক্যালস এবং স্বাস্থ্য খাতে থাকবে প্রধান ফোকাস। এককথায়, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আসবে। কাজের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ বাড়বে।
বাংলাদেশ উল্লেখিত প্রেক্ষাপটের জন্য কতটা প্রস্তুতি নিচ্ছে? আমরা কী ভাবছি? আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, যুবসমাজের স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে দক্ষতার বিকাশের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যুবসমাজের দক্ষতা বিকাশের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বিশেষত দূর শিখন, সমন্বিত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষানবিস এবং ইন্টার্নসহ শিক্ষার্থীদের আপস্কিল এবং রি-স্কিল করতে হবে। ইউনেস্কোর, আইএলও এবং বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে উঠে এসেছে, দূর-প্রশিক্ষণ এক্ষেত্রে একমাত্র অবলম্বন হতে পারে।
এসব বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের যুবসমাজের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ এবং উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য ৬০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ কাজে লাগাতে বিশ্বব্যাংক এই ঋণ প্রদান করছে। বাংলাদেশ সাম্প্রতিক দশকে দ্রুত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করে একটি মধ্যম আয়ের স্থিতিতে পৌঁছেছে। দেশে বর্তমান ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ চলছে। এর সুফল পেতে হলে আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এ পরিস্থিতিতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পর্যাপ্ত আপগ্রেডেশনের প্রয়োজনীয়তা ও কোভিড পরবর্তী বিভিন্ন উদ্যোগে প্রযুক্তি ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা ও কর্মক্ষম থাকার জন্য যুবসমাজের যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জনে মনোযোগী হওয়া জরুরি।
আমাদের জনশক্তির অভাব নেই। অভাব দক্ষ জনশক্তির। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার তিনভাগের এক ভাগ হলো ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ, যার মধ্য থেকে প্রতি বছর প্রায় বিশ লাখ তরুণ বাংলাদেশের শ্রম বাজারে প্রবেশ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে এদেশের শ্রমশক্তি ৭ কোাটি ৬০লাখে পৌঁছে যাবে। আবার ১৫ বছর ২৪ বছর বয়সীদের শতকার ৪১ ভাগের কোনো চাকরি, শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ নেই। এ অবস্থায় তরুণ বাংলাদেশিরা বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির অন্যতম বসবাসকারী হওয়া সত্ত্বেও তারা একটি অনিশ্চিত ও নিরাপত্তাহীন ভবিষ্যতের মুখোমুখি। এটা শুধু চাকরির সুযোগের অভাবের কারণে নয়, এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবজনিত কারণও যুক্ত আছে। যার ফলে অনেক শিল্প-কারখানা নিরুপায় হয়ে দেশের বাইরে থেকে দক্ষ লোক আনতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক আবার নিরক্ষর বা স্বল্প-সাক্ষর। এর একটা অংশ আবার তরুণ। এসব নিরক্ষর বা স্বল্প সাক্ষর যুবকদের বেশিরভাগ শেষ পর্যন্ত অনিয়মিত, অনানুষ্ঠানিক চাকরিতে যোগদান করে। বাংলাদেশে অনানুষ্ঠানিকখাতে প্রায় ৮৭% কর্মসংস্থান করে থাকে। কিন্তু এই অনানুষ্ঠানিক খাত সম্বন্ধে আমাদের সঠিক ধারণা ও তথ্য নেই। অনানুষ্ঠানিক খাত অসংগঠিত বিধায় জাতীয় শ্রম ও কর্মসংস্থানের জন্য প্রণীত নীতিমালাসমূহ এই খাতে কার্যকর করা কঠিন হয়ে যায়। এখানকার কর্মপরিবেশ, বেতন কাঠামো এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে যথার্থ তথ্য নেই। এখাতে এখনও শোভন কাজের মানদণ্ড নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।
সংকটের কথা বলতে বলতে নিজের অজান্তেই কখন জানি না, সম্ভাবনার দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছে গেছি। সংকটকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ এখন আর নেই। সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকেবহাল। তাই সংকট মোকাবেলা করে উত্তরণের পথ খুঁজে নিতে সরকার ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১’ প্রণয়ন করেছে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (টিভিইটি) সংস্কার প্রকল্পের একটি বড় সফলতাএটি। বাংলাদেশে এই ধরনের নীতিমালা এই প্রথম প্রণীত হয়েছে। যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তি হিসাবে গড়ে তুলতে হলে এই নীতিমালার আলোকেই চলতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭১’এর স্মৃতি কথা
পরবর্তী নিবন্ধবহমান সময়