৭১’এর স্মৃতি কথা

জামশেদ হোসেইন | সোমবার , ২৬ জুলাই, ২০২১ at ১০:৫২ পূর্বাহ্ণ

দিনটি ছিলো ১৯৭১ এর ১১ এপ্রিল রবিবার। আমাদের বাড়ির কাছেই নানা বাড়ি। হাটহাজারীর ফতেহপুর গ্রাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নাম্বার সড়ক মুখের কাছাকাছি। চট্টগ্রাম সেনানিবাস হাটহাজারীতে অবস্থিত থাকায় পাক হানাদার বাহিনী ঐসব সড়ক দিয়ে সবসময় চলাফেরা করত। ২৫ মার্চ চট্টগ্রাম ক্রাক ডাউনের পর চারিদিকে চলছে হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ এবং জ্বালাও পোড়াও এর বিভীষিকা।
হানাদার বাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে রাস্তার দু’পাশে বাড়ি ঘরে আগুন দেয় এবং নির্বিচারে নিরীহ মানুষ জনকে হত্যা করতে থাকে। চৌধুরী হাট, মদন হাট, হাটহাজারীসহ পুরো এলাকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। ১১ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল ফতেহপুর মদনহাটে আমার নানা বাড়ি ঘেরাও করে। হানাদার বাহিনী আমার নানা কন্ট্রাকটর দুলা মিয়া, নানার আরেক ভাই ইব্রাহিম সারাং, ভাইপো সুলতান আহমেদ, প্রতিবেশী আলী আহমদ, বাদশাহ মিয়া-১ ও বাদশাহ মিয়া-২সহ মোট ছয়জনকে বাড়ির পুকুর পাড়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে। তখন আমার এক মামাত ভাই ভয়ে গোলাগুলির আগেই মাটিতে পড়ে গড়িয়ে পুকুরে পরে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। বাড়ির আঙ্গিনায় তাদেরকে সমাহিত করা হয়। তিনি বাকি জীবন চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বাবা ও দুই চাচা সহ ৬ জনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়েই বেঁচে ছিলেন। আমার মমতাময়ী মা-সহ পরিবারের সবাইকে আজীবন আপনজন হারানোর এই নির্মমতাকে বহন করতে হচ্ছে। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর পরও নানার বাড়িতে আজও স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথার সুর ভেসে বেড়ায় নীরবে-নিভৃতে। এখনও মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত সাক্ষী ওই পরিবারগুলোর সেই মর্মস্পর্শী ঘটনা সবার দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে। তাদের জীবনে শুধু প্রতিক্ষণ স্বজন হারানো বুক ফাটা কান্না আর দীর্ঘশ্বাস। নির্মম হত্যার সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো আমাদেরকে পীড়া দেয়, ব্যথিত করে। আমরা নিকটজনরা আজো মনের ভেতর এক ধরনের কষ্ট দুঃখ যন্ত্রণা অনুভব করি।
এই লোমহর্ষক গণহত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে নানা বাড়ির অনেকে নির্বাক হয়ে যান। মনে হয় যেন এ দিনটি এলে শহীদদের আত্মা বাড়ি এসে ভিড় করে। মনে হয় যেন স্বজনরা গুলিবিদ্ধ হয়ে বলছে, বাবা আমাকে ধর, পানি দাও!এমন নিষ্ঠুর নির্দয় ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বজনরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। দীর্ঘ প্রায় ৪ যুগ পরও এই বর্বরোচিত গণহত্যার কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। আর স্থাপিত হয়নি শহীদের স্মরণে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনায় লোকজ সংস্কৃতি যেন হারিয়ে না যাই
পরবর্তী নিবন্ধযুবসমাজের যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জনে মনোযোগী হওয়া জরুরি