বন্ধু

মীর নাজমিন | বুধবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ

গ্রামের পরিবেশ এবং গ্রাম্য ছেলেমেয়েদের সাথে কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না শহরের নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ুয়া ছাত্র সাহিল। একদিকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কারিকুলাম আর গ্রামের স্কুলের কারিকুলামের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। অন্যদিকে গ্রামের সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠা ছেলেমেয়েগুলোর সাথে জন্ম থেকে শহুরে পরিবেশে বেড়ে উঠা সাহিলের চলাফেরা, আচার আচরণ কিছুতেই মিলছে না। মিলবেই বা কি করে? এর আগে একবারের জন্যও যে গ্রামের মুখ দেখেনি সাহিল। গ্রাম সম্পর্কে তার কোন অভিজ্ঞতাই নেই। তাইতো ক্লাসেও সারাক্ষণ একা একা মনমরা হয়েই বসে থাকে সে। মাত্র দু মাস আগে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে গ্রামের একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হয় সাহিল। জন্ম থেকে অদ্যাবধি শহরের আলো হাওয়ায় বেড়ে উঠলেও হঠাৎ করে তার বাবা আর্থিকভাবে একটু বেকায়দায় পড়ে যাওয়ায় বাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য ব্যয় মিটাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। শহরের তুলনায় গ্রামে জীবনযাপন অনেক সাশ্রয়ী। তাই শহর ছেড়ে গ্রামে আসতে বাধ্য হয় তার পরিবার। ক্লাসের অন্যান্য ছেলেমেয়েরা নতুন একজনকে তাদের ক্লাসে পেয়ে অনেক আগ্রহ নিয়েই তার সাথে ভাব জমাতে আসে। কিন্তু সাহিল সোজা বলে দেয়, দেখো শুধুশুধু তোমরা আমাকে ডিস্টার্ব করতে এসো না। আমার মা বলেছেন, তোমাদের সাথে কোনদিনও আমার বন্ধুত্ব হবে না। তোমরা আমার বন্ধু হওয়ার যোগ্য নও। শহরে আমার অনেকগুলো বন্ধু আছে। সমস্যাটা কাটিয়ে উঠলে কিছুদিনের মধ্যেই আবার শহরে ফিরে যাবো আমরা। যে কয়দিন এখানে আছি, দয়া করে আমাকে আমার মতো থাকতে দিও। সাহিলের এই কথাগুলো শুনে ক্লাসের সবাই চুপসে যায়। সাহিলের এই কথাগুলো তাদের আগ্রহের আগুনে যেনো ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দেয়। কিন্তু একই ক্লাসের সুমন নামের একটা ছেলে সারাক্ষণ তার পেছনে লেগেই থাকে। যেনো সে সাহিলকে বন্ধু করেই ছাড়বে। একবার ব্যাগ থেকে সাহিলের খাতা নিয়ে লুকিয়ে রাখবে, আবার কলম দিয়ে ওর শার্টের পেছনে ছবি এঁকে দিবে। আবার দেখা যায় ওয়াটার পট থেকে ইচ্ছে করে পানি ঢেলে সাহিলের বসার জায়গাটা ভিজিয়ে দেয়। এমন আরো অনেককিছুই করতে থাকে সুমন। তার উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে সাহিল তার ক্লাস টিচারের কাছে সুমনের নামে বারবার অভিযোগ করে। অবশেষে ক্লাস টিচারের বকুনি খেয়ে ক্ষান্ত হয় সুমন। কিন্তু তারপরও সারাক্ষণ সে সাহিলের উপর নজরদারি করতে থাকে। সাহিল কখন ক্লাসে আসে, ক্লাসে কেমন আচরণ করে বা অন্যান্যদের সাথে কিভাবে কথা বলে ইত্যাদি ইত্যাদি। সুমন হয়তো কোন অজানা কারণে ছেলেটার প্রতি খুব আকৃষ্ট হয়ে মনে প্রাণে তার বন্ধুত্ব কামনা করে বলেই এমন করে সারাক্ষণ সাহিলের পেছনে লেগে থাকে। টিচারের বকুনি খাওয়ার পর থেকে যদিও তেমনভাবে আর উত্ত্যক্ত করে না কিন্তু ও যেনো সাহিলের ছায়া। সাহিল যেদিকেই যাক, সারাক্ষণ সুমন তার পিছু পিছু বা আশেপাশেই ঘুরঘুর করে। কিন্তু এসবে পাত্তা না দিয়ে সাহিল সাহিলের মতোই চলতে থাকে।
মে মাসের শেষদিকে বর্ষার বৃষ্টিতে খালবিল পানিতে টইটুম্বুর। সাহিলের বাড়ি আর স্কুলের মাঝখানে মাঝারি আকারের একটা খাল আছে। এই খাল পার হয়েই প্রতিদিন স্কুলে যেতে হয়। গত দুই তিন মাস শুকনো মৌসুম ছিলো বলে স্কুলে যেতে কোন অসুবিধে হয়নি তার। কিন্তু বর্ষার এই বৃষ্টি তাকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। কারণ খালের উপর কোন ব্রিজ নেই। দুই তিনটা বাঁশ একত্র করে একটা সাঁকো বানিয়ে দেয়া হয়েছে পারাপারের জন্য। সেটা পার হয়েই স্কুলে যেতে হবে। প্রতিদিনের মতো আজকেও স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হয়ে সাঁকোর কাছে গিয়েই থমকে যায় সাহিল। একি! খালে প্রবল স্রোত চলছে। তার উপর এই ছোট্ট বাঁশের সাঁকো কাদা পানিতে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে। এটা পার হয়ে কিভাবে স্কুলে যাবে সে? তাছাড়া শহুরে ছেলে সে তো সাঁতার জানে না। যদি একবার পা পিছলে পড়ে যায় কি হবে তার? কিন্তু স্কুলে তো তাকে যেতেই হবে। কি আর করা? অবশেষে ভয়ে ভয়ে ধীর পায়ে সাঁকোর দিকে পা বাড়ালো সে। সামনের দিকে এক পা দিয়েই আবার পেছনে চলে আসে ভয়ে। সাঁকোর অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে সাহিলের এই অবস্থা দেখে মুখে হাত দিয়ে মিটমিট করে হাসছে সুমন। এভাবে কয়েক পা সামনে এগোতেই পা পিছলে খালের পানিতে পড়ে যায় সাহিল। অথৈ পানিতে হাত পা ছুঁড়ে হাবুডুবু খেতে থাকলো সে। উঠার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই উঠতে পারছে না। এদিকে সাহিলকে পানিতে পড়ে যেতে দেখে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগলো সুমন। কে কোথায় আছো? সাহিল খালের পানিতে পড়ে গেছে। কে কোথায় আছো? আশপাশে কেউই নেই যে সুমনের আর্ত চিৎকার শুনবে। সাহিল প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থা, পাড়ে সুমনকে দেখতে পেয়ে হাত তুলে চিৎকার করে তাকে বাঁচানোর আকুতি জানাতে থাকে সাহিল। অনেকক্ষণ ডেকেও কারো কোন সাড়া না পেয়ে গায়ের জামাটা পাড়ে খুলে রেখে সুমন নিজেই ঝাঁপ দেয় খালে। সুমন বাচ্‌চা ছেলে অনেক কষ্টে সাঁতরে সাহিলের কাছাকাছি যায়। অনেক চেষ্টার পর ওর পিঠের উপর চড়িয়ে সাহিলকে পানি থেকে পাড়ে নিয়ে আসে সুমন। একদিকে প্রবল স্রোতের সাথে লড়াই অন্যদিকে সাহিলের শরীরের ওজনের চাপে পাড়ে এসেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে সুমন। তার নাক মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে। ততোক্ষণে অনেকেই এসে জড়ো হয়ে যায় সেখানে।
জ্ঞান ফেরার পর চোখ মেলে সুমন দেখতে পায়, বিছানায় শুয়ে আছে সে। আর তার পাশেই বসে আছে সাহিল ও সাহিলের মা। সাহিলকে নিজেদের ঘরে দেখে যারপরনাই খুশি হয় সুমন। তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসে সাহিলের হাত ধরে সে। সুমনকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে সাহিল। আমাকে ক্ষমা করে দাও সুমন। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। পৃথিবীতে কাউকেই ছোট ভাবতে নেই। আজ তোমার জন্যই প্রাণে বেঁচে গেছি আমি। চির কৃতজ্ঞ তোমার কাছে। সাহিলের বুক থেকে সুমন নিজেকে মুক্ত করে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, বন্ধু হতে পারবো তো তোমার? বিশ্বাস করো সাহিল, এতোদিন তোমার সাথে যা যা করেছি শুধু তোমার বন্ধু হওয়ার জন্যই করেছি। সুমনের কথায় লজ্জা পেয়ে সাহিল বলে, তুমি তো আমার শুধু বন্ধু নও। বন্ধুর বিপদে যে নিজের জীবনবাজি রাখতে পারে সে তো বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু বলেই আবারো দুজন দুজনকে গভীরভাবে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। পাশ থেকে দুই বন্ধুর এমন কাণ্ড দেখে চোখ মুছলেন সাহিলের মাও। তারপর কাছে এসে তাদের দুজনকে একসাথে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, অনেকদিন বেঁচে থাকো বাবা। বেঁচে থাকুক তোমাদের এই অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। আজ থেকে শুধু সাহিল নয়, সুমনও আমার আরেক সন্তান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধট্রাম্পের বাধার কারণে আরও লোক মরতে পারে : বাইডেন
পরবর্তী নিবন্ধছোটবোন