বত্রিশ নম্বর বাড়ি

সুব্রত কুমার নাথ | বুধবার , ৩ এপ্রিল, ২০২৪ at ১১:০৭ পূর্বাহ্ণ

রোদে যেন গা পুড়ে যাচ্ছে। তাই দেশের সব ইশকুল ছুটি দিয়ে দেয়। এ সুযোগে কিশোরও টানা পাঁচদিনের ছুটি পেয়ে যায়। কিশোর পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। পাঁচ দিনের ছুটি পেয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয় , ঢাকায় শিল্পমেলা চলছে,এ সুযোগে মামার বাসায় বেড়াতে গেলে শিল্পমেলাও দেখা হবে, মনের লালিত স্বপ্নও পূরণ হবে। তাই কিশোর মাকে বলে, মা আমরা এবার ছুটিতে ঢাকায় রনি মামার বাসায় যাবো। মা বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে। এরপর কিশোরের বাবা বাসায় এলে পপি বলে, ছেলের স্কুল ছুটি হয়েছে। এই ছুটিতে সে রনির বাসায় যেতে চাইছে। তুমি কি বলো? কিশোরের বাবা বলেন, খুব ভালো আইডিয়া। আমার কলেজে পরীক্ষা চলছে। আমার তো যাওয়া হবে না। তুমিই তাকে নিয়ে ঘুরে এসো। পপি তখন সব গুছিয়ে পরদিন সকালে যাত্রা করে বিকেলে ছেলেকে নিয়ে রনির বাসায় পৌঁছে। তাদের দেখে কিশোরের দাদুদিদামনি তো মহাখুশি। ঠিক ওই সময় মামাও অফিস থেকে ফিরে কিশোরকে দেখে বলে, খরচের মেশিন তো এসে গেছে। এটা কিনে দাও, ওটা কিনে দাও এই বলে বলে আমার মাথাটা গিলে খাবে। এরপরও মামা শান্তভাবে বলেন, ভাগ্নে, কেমন আছিস? কবে আসলি? কিশোর বলে, এইতো এইমাত্র। মামা আমি শুনেছি, ঢাকায় শিল্প মেলা চলছে। তুমি কাল আমাকে ওখানে নিয়ে যেতে হবে। মামা বলেন, তুই তো এখনও ছোট, অনেক লোকের ভিড়ে হারিয়ে যাবি। মামা, তুমি অতশত বলে আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। তুমি এবার আমাকে শিল্পমেলায় বেড়াতে নিয়ে যাবে। এই বলে সবাই যার যার ঘরে চলে যায়। পরদিন সকালে সবাই টেবিলে নাস্তা খেতে বসে। এই সময় পপি রনিকে বলে, সে তোর সাথে বেড়াবে বলে এখানে এসেছে। রনি পপির মামাতো ভাই। সে খুব ভালো ছেলে। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ভালো বেতনে একটি মোবাইল কোম্পানিতে যোগদান করেছে। সে কখনো দিদির কথার অমর্যাদা করেনি। আজও সে দিদির কথা রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। রনি বলে, আগামীকাল আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তোকে মেলায় নিয়ে যাবো। ঠিক আছে? হ্যাঁ মামা, তাহলে তাই হবে। পরদিন মামা ভাগনে সকাল দশটায় বের হয়ে পড়ে। আন্তজার্তিক শিল্পমেলা বলে কথা। প্রচুর মানুষের সমাগম। নানান রকম সামগ্রীর সমাহার। কিশোর মামাকে নিয়ে মেলায় ঘুরছে। এটা দেখছে, ওটা দেখছে, কিছুই তার পছন্দ হয় না। তাই তার মন খারাপ। মামা জিগ্যেস করেন, ভাগ্নে, ভালো লাগছে না? কিছু খাবি? কিশোর বলে, আমি একটি জিনিস খুঁজছি। এটা পেলেই আমি খাবো। মেলা ঘুরা প্রায় শেষ। মেলার সর্বশেষ দোকান ছোটোদের খেলনা সামগ্রীর। এই দোকানে ঢুকে তার প্রত্যাশার জিনিস পেয়ে যায়। বাচ্চাদের খেলনার বিল্ডিং তৈরীর সরঞ্জাম। টিন সেড, সিলিং, পিলার, দেয়াল, কার্পেট ইত্যাদি। বিল্ডিং এ ব্যবহার্য দ্রব্যাদি সোফা, পালং, আলনা, আলমিরা, চেয়ার, টেবিল আরো কতো কী! মামার কাছে বায়না ধরে,এসব কিনে দেয়ার জন্য। ভাগ্নে, তুই এসব দিয়ে কী করবি? কিশোর বলে, বুঝলে মামা, বাড়ি বানাবো। ভাগ্নের কথামতো মামা এসব কিনে দেন। এসব পেয়ে কিশোর খাওয়ার কথা পর্যন্ত ভুলে যায়। সে মামাকে বলে, আর কিছু দেখবো না। চলো বাসায় ফিরে যাই। এরপর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা বাসায় ফিরে আসে। কিশোর বাসায় ফিরে খেলনা নিয়ে বসে পড়ে। বিল্ডিং এর সরঞ্জাম নিয়ে তার স্মৃতিতে ধরে রাখা সাদা রঙের একটি তিন তলা বিল্ডিং তৈরী করে। বিল্ডিং এর নিচতলায় ছোটবড় সব মিলিয়ে পাঁচটি, দোতলায়ও পাঁচটি রুম। তৃতীয়তলায় দুটি। বাড়ির পেছনের দিকে একটি রান্নাঘর এবং পাশে কবুতর ও মুরগির বেশ বড় দুটি ঘর তৈরী করে। আর এর ভিতরে সাজিয়ে গুছিয়ে আসবাবপত্র রাখে। এরপর খেলনার বাড়ি নির্মাণ করে মামাকে দেখায়। মামা বলেন, এতো সুন্দর বাড়ি! আমি ঠিক এ রকম একটি বাড়ি দেখেছি। উহ্‌! মনে পড়েছে, ভাগ্নে। এটা তো ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি। এই বাড়ির নকশা তোর মাথায় এলো কোত্থেকে? কিশোর বলে, আমাদের স্কুলের বাবলা স্যার হোয়াইট বোর্ডে এই বাড়িটি এঁকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু ৬ দফা সহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বিশ্বস্ত নেতা ও সুধীজনদের সঙ্গে এখানেই নিতেন। ১৯৭০এর নির্বাচনের সব কৌশল ও নির্দেশনা এখান থেকেই দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এই বাড়িতেই যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি। স্যারের এসব কথা শুনার পর থেকে আমার স্বপ্ন ছিল, খেলাচ্ছলে হলেও আমি এরকম একটি বাড়ি বানাবো। খেলায় খেলায় আমি মহানায়ক হবো। আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এ বাড়ি তৈরী করে সবাইকে দেখাতে পেরে আমি সত্যিই খুশি। মামা বলেন, তোর এ চমৎকার প্রতিভা দেখে আমিও অত্যন্ত খুশি। তাই তোকে আজ সত্যি সত্যিই বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর বাড়ি নিয়ে যাবো। তুই যাবি? হ্যাঁ মামা, ওখানে গেলে তো আমার ঢাকা আসাটাই সার্থক হবে। তাহলে চল্‌ আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি বের হয়ে পড়ি। যেই কথা সেই কাজ। মামা ভাগ্নে দুজনে দ্রুত বের হয়ে ধানমন্ডির দিকে ছুটতে থাকে। টেক্সিযোগে তারা খুব কম সময়ের মধ্যে বত্রিশ নম্বর বাড়ি পৌঁছে। কিশোর এ বাড়ি দেখে তো অবাক। তার মনে আঁকা ছবির সাথে বাড়িটি হুবুহু মিলে গেছে। বাড়িটি অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর শোয়ার ঘর, বাড়ির রান্নাঘর সহ সব ঘরের জিনিসপত্র সুন্দরভাবে গোছানো। কিশোর মামাকে জিগ্যেস করে, আচ্ছা মামা, এখানে বঙ্গবন্ধু কবে থেকে বসবাস করা শুরু করেন? ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে। এরপর ১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন সহ পরবর্তী সব আন্দোলনের সাক্ষী এই বত্রিশ নম্বর বাড়ি। এই বাড়ির তৈরির পিছনে একটা ইতিহাসও আছে , ১৯৫৫৫৬ সালে তৎকালীন সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর প্লটটি বরাদ্দ দেন। প্লট বরাদ্দের কথা শুনে শেখ মুজিবের পিতা শেখ লুৎফর রহমান সামান্য সঞ্চিত অর্থ ও ধান, জমিজিরাত বিক্রি করে যেটুকু পেয়েছিল তা দিয়ে মাটি ভরাট ও বিল্ডিং এর কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে দৈনন্দিন খরচ বাদে যা অবশিষ্ট থাকত; সেখান থেকে পাইপাই বাঁচিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এ বাড়ির কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। মামা, বঙ্গবন্ধুর পরিবারও কী এখানে থাকতো? হ্যাঁ মামা, বঙ্গবন্ধুর সাথে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা, বড় দুই ছেলে ও ছেলের বউ, ছোট ছেলে শেখ রাসেল এখানে থাকতো। কিন্তু

ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, এই বাড়িতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেন। সেই থেকে ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ বাড়িটি এখন বাঙালির আবেগ ও ভালোবাসার ঠিকানা। দেখ ভাগ্নে, শেখ মুজিবকে আদর করে তার মা বাবা খোকা বলে ডাকতো। এই খোকা বাংলা ও বাংলার মানুষকে খুব ভালোবাসতেন, তাই বাংলার মানুষ তাকে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা উপাধি দেন। জাতির পিতার প্রতি তোর শ্রদ্ধা দেখে আমি খুব খুশি হলাম। পুরো বাড়ি ঘুরে সন্ধ্যার পরপর তারা বাড়ি ফিরে আসে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে কিশোর সেদিন বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কিন্তু রাতে সে ঘুমোতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু নিয়ে তার মামার কথার উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করে। আর এর পরদিনই কিশোর মাকে নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করে। কিশোর গাড়িতে বসে বত্রিশ নম্বর বাড়ি ও মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা ভাবতে ভাবতে একসময় সে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস
পরবর্তী নিবন্ধতোকেই খুঁজি, বুনু