ফখরুল-আব্বাস কারাগারে

টানাপড়েন শেষে গোলাপবাগে সমাবেশের অনুমতি মাঠেই বিএনপির নেতাকর্মীদের রাত্রিযাপন ‘সরকার পতনে’ আজ নতুন কর্মসূচি : মোশাররফ

আজাদী ডেস্ক | শনিবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ

নয়া পল্টনে পুলিশের ওপর হামলা ও হাতবোমা নিক্ষেপে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে পল্টন থানার মামালায় শুক্রবার ভোর হওয়ার আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফখরুল ও আব্বাসকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। গতকাল সন্ধ্যায় আদালতে হাজির করা হলে জামিন নাকচ করে ফখরুল ও আব্বাসকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক।
এদিকে নয়াপল্টন নয়, অনেক টানাপড়েন শেষে আজকের সমাবেশের জন্য রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠ ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে বিএনপি। ওই মাঠে মঞ্চ নির্মাণ এবং মাইক বসানোর জন্য বিএনপি নেতারা আনুষ্ঠানিক আবেদন করার পর ঢাকার পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক শুক্রবার বিকালে এ কথা জানান। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, তাদের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’ একই সময়ে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, শনিবার বেলা ১১টায় সায়েদাবাদের গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ করার অনুমতি তারা পেয়েছেন। বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি আছে এমন সমমনা সব রাজনৈতিক দলকে সেই সমাবেশে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তবে বিকেল থেকেই গোলাপবাগ মাঠে নেতাকর্মীরা জড়ো হতে শুরু করেছেন। যেখান থেকে তারা ফেইসবুক লাইভে রাজনৈতিক সহকর্মীদের ডাকছেন, জানাচ্ছেন নিজেদের অবস্থা। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নবিউল্লাহ নবী বলেন, ‘সমাবেশের স্থান নির্ধারণ হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই মাঠ প্রায় ভরে গেছে; কাল কী হবে, তার বলার অপেক্ষা রাখে না।’ ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদও সন্ধ্যার আগে গোলাপবাগ মাঠের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ঘুরে দেখেন। তিনি বলেন, সমাবেশের জন্য বিএনপিকে গোলাপবাগ মাঠ ব্যবহারের অনুমতি আগের ‘শর্তেই’ দেওয়া হয়েছে, যেমনটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দেওয়া হয়েছিল। একইরকম নিরাপত্তা বলয় গোলাপবাগেও থাকবে।
এদিকে গোলাপবাগ মাঠে পুলিশের কাছ থেকে সমাবেশ করার অনুমতি মিললেও মাঠের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে প্রথমে অনুমতি চায়নি বিএনপি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পুলিশের দেওয়া ২৬ শর্ত বহাল রেখে গোলাপবাগ
মাঠের অনুমতিরও প্রথম শর্তে বলা হয়, ‘এই অনুমতিপত্র স্থান ব্যবহারে অনুমতি পত্র নয়, স্থান ব্যবহারের জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে অনুমোদন নিতে হবে।’
পরে রাত সাড়ে ১০টায় বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ ইমরান সালেহ প্রিন্স গোলাপবাগ খেলার মাঠ ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেন।
আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব আকরামুজ্জামান গোলাপবাগ খেলার মাঠের কোনও ধরনের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ প্রদানের শর্তে বিএনপিকে মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দেন।
এর আগে রাত ৯টায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ বিভাগ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, গোলাপবাগ মাঠে অবকাঠামো উন্নয়নে প্রকল্পের কাজ শেষের পথে। শিগগিরই এই মাঠ উদ্বোধনের দিন ঠিক করা হবে। সুতরাং প্রকল্পের এই পর্যায়ে গোলাপবাগ খেলার মাঠে রাজনৈতিক সমাবেশ আয়োজন করা হলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে।
জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং দলীয় কর্মসূচিতে নেতা-কর্মী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে দেশের সব বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করছে বিএনপি। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশের মধ্য দিয়ে তাদের এ কর্মসূচি শেষে নতুন পদক্ষেপ ঘোষণা করার কথা রয়েছে।
গতকাল বিকেল ৪টার দিকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, ‘সরকার পতনে’ বিএনপি সমাবেশ থেকে নতুন কর্মসূচি নিয়ে আসছে। তিনি বলেন, ‘১০ ডিসেম্বর থেকে আমরা আগামী দিনে এই সরকারের বিদায়ের জন্যে কতগুলো চার্টার অব ডিমান্ড বা দফা আমরা ঘোষণা করব। আমাদের সাথে যারা যুগপৎ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত- ইতিমধ্যে আমাদের সাথে আলোচনা হয়েছে। আমরা আশা করি, তারা যুগপৎভাবে আমরা যে ১০ দফা প্রণয়ন করেছি, তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে ঘোষণা করবেন। যার যার অবস্থান থেকে তারা ভবিষ্যতে এই দফাগুলোর দাবিতে আন্দোলনকে শাণিত করে যুগপৎভাবে আন্দোলনে আসবেন।’
বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর গতকাল বেলা ১১টায় বিএনপির স্থায়ী কমিটি জরুরি বৈঠকে বসে, যাতে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সভাপতিত্ব করেন।
ঢাকার এ সমাবেশ ঘিরে গত কিছুদিন ধরেই উত্তেজনা চলছে দেশের রাজনীতিতে। সহিংসতার শঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকার তাদের নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতাও জারি করেছে।
বিএনপি নয়া পল্টনে তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে এ সমাবেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের অনুমতি দেয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ব্যবহারের। এ নিয়ে অনড় অবস্থানে ছিল দুই পক্ষ।
এর মধ্যে গত বুধবার বিএনপি কর্মীরা নয়া পল্টনে জড়ো হলে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। সংঘষের্র মধ্যে আহত স্বেচ্ছাসেবক দলের এক ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতার মৃত্যু হয় হাসপাতালে।
এরপর বিএনপি অফিসে অভিযান চালিয়ে হাতবোমা পাওয়ার কথা বলা হয় পুলিশের তরফ থেকে। গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় পাঁচশ নেতাকর্মীকে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল তারপরও বলে আসছিলেন, ১০ ডিসেম্বর তাদের সমাবেশ ‘হবে’। তবে বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশের সঙ্গে ‘সমঝোতা বৈঠকের’ পর অবস্থান বদলের ঘোষণা আসে।
ফখরুল ও আব্বাসকে গ্রেপ্তার করার পর বিএনপি কীভাবে সমাবেশ করবে প্রশ্ন করলে দলের আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘এটা পুলিশের দৈনিন্দন কার্যক্রমের অংশ। আমরা আইনগতভাবে মোকাবিলা করব।’
এদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও কেন্দ্রীয় নেতা মির্জা আব্বাসকে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়ার পর কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। কারাগারে আগে থেকেই বন্দী বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদসহ ৭ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হওয়া নেতাকর্মীরাও কোয়ারেন্টিনে আছেন।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের সবকটি কারাগারের নতুন একটি নিয়ম অন্তর্ভুক্ত হয়। যার আওতায় নতুন আসামি কারাগারে এলে কোয়ারেন্টিনে থাকার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়। এর আওতা থেকে বাদ পড়েননি বিএনপির নেতারা।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহাবুবুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, কারাবিধি মোতাবেক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে বিএনপির দুই নেতাকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। ডিভিশন সংক্রান্ত কাগজপত্র পেলে নিয়ম অনুযায়ী তাদের সূর্যমুখী ভবনে আলাদা কক্ষে কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে।
নগর বিএনপির প্রতিবাদ : দমন পীড়নের অংশ হিসেবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল এক বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানান কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, নগরের আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন, সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান।
বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, দেশ পরিচালনায় সকল ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে সরকার ফ্যাসিবাদী আচরণের আশ্রয় নিয়েছে। মানুষের ভোট ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে ধ্বংসের মাধ্যমে সমগ্র দেশকে কারাগারে পরিণত করেছে। নেতাকর্মীদেরকে গ্রেপ্তার এবং তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও কাল্পনিক কাহিনী তৈরি করে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। বর্তমানে সরকারের দুঃশাসনের মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। তারা রাতের অন্ধকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে তুলে নিয়ে গেছে। তারা দুইজনই বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা। দেশের এই সম্মানিত দুইজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা ৭১ সালের পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
নেতৃবৃন্দ বলেন, বিএনপিকে দমন পীড়নের অংশ হিসেবে নেতাকর্মীদের হত্যা, গ্রেপ্তার, মামলা দায়ের ও দলীয় কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তারই ধারাবাহিকতায় গভীর রাতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে তাদের নিজ নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। জনগণের এই ঐক্যকে কিছুতেই রুখে দেয়া যাবে না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার ও হয়রানি করে জনগণকে নেতৃত্ব শূন্য করার কোনো পদক্ষেপই সফল হবে না। জনগণ সম্মিলিতভাবে রাজপথে নেমে তাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় ছিনিয়ে আনবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে
পরবর্তী নিবন্ধ‘রোহিঙ্গাদের দেশে পাঠাতে দাঁড়াতে হবে বাংলাদেশের পাশে’