প্রকল্প বাস্তবায়নে সব অন্তরায় চিহ্নিত করার উদ্যোগ

হবে ক্রাশ প্রোগ্রাম ।। শনিবার চট্টগ্রামে বসছে উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক ।। জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্প

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৪ জুন, ২০২১ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার। জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহিত প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের অন্তরায়গুলো চিহ্নিত করে এই ক্রাশ প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে এসব অন্তরায় চিহ্নিত করা হবে। আগামী শনিবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রী এবং বেশ কয়েকজন সচিবসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা চট্টগ্রামে এক বৈঠকে বসছেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে মনিটরিং টিম গঠনের দিন দশেকের মধ্যেই মন্ত্রী এবং সচিবদের চট্টগ্রামে মিলিত হয়ে সমস্যা চিহ্নিত করার এই উদ্যোগ নতুন আশার সঞ্চার করছে।
সূত্র জানিয়েছে, ভয়াবহ রকমের জলাবদ্ধতা মহানগরীর প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে শহরের একটি বড় অংশ দিনে দিনে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। কর্ণফুলী নদীর ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় শহরের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। প্রতিদিনই তীব্র হচ্ছে সংকট। বাড়ছে মানুষের দুর্ভোগ। এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর খাল পুনঃখনন, সমপ্রসারণ ও সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার এই প্রকল্পের আওতায় নগরীর ৩৬টি খাল সংস্কার, খনন এবং সম্প্রসারণ ছাড়াও খাল দখল করে থাকা প্রায় ৩ হাজার ১৫০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ রয়েছে। খাল ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার ২৪০ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কার, খালের পাড়ে ১৭৬ কিলোমিটার রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণ, খালগুলোর এক পাশে ১৫ ফুট চওড়া রাস্তা এবং অপর পাশে ৫ ফুট ওয়াকওয়ে নির্মাণ, ৫৪টি ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত পাঁচটি খালের মুখে স্লুইচ গেট নির্মাণ প্রকল্পটিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ২০১৭ সালে নেয়া প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুন মাসে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০২০ সালের জুনে প্রকল্প মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব করা হয়। সরকার এক বছর মেয়াদ বাড়ায়। এতে করে আগামী ৩০ জুন প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হচ্ছিল। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার প্রকল্প মেয়াদ আরো এক বছর বাড়িয়েছে।
এর পাশাপাশি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কালুরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত সড়ক কাম বেড়িবাঁধ নির্মাণের আলাদা একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২৩শ কোটি টাকার এই প্রকল্পটিও জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য নেয়া হয়। এই প্রকল্পেও সাতটি স্লুইচ গেট নির্মাণসহ বিভিন্ন খাল ও বেঁড়িবাধে প্রচুর কাজ রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই হাজার কোটিরও বেশি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের আওতায়ও স্লুইচ গেট নির্মাণ, বেড়িবাঁধ সংস্কারসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ রয়েছে।
সবগুলো প্রকল্পের কাজ চলছে। টাকাও খরচ হচ্ছে। প্রকল্পগুলোরও ব্যয়ও বাড়ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও শহর জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। ঘন্টা দুয়েকের টানা বৃষ্টিতে শহরের বড় এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর পানি থৈ থৈ করে। মানুষের বাসা বাড়ি থেকে শুরু করে হাসপাতালে প্রবেশ করে পানি। মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠে।
ভয়াবহ রকমের এই দুর্ভোগ থেকে বাঁচতে চট্টগ্রামের মানুষ বহুদিন ধরে নানাভাবে আকুতি জানিয়ে আসছেন। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর পর্যন্ত তৎপর হয়ে উঠে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে গত ১৬ জুন উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ওই বৈঠকে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে একটি মনিটরিং টিম গঠন করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগের উপরও ওই বৈঠকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল।
এর মধ্যে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিষয়টি নিয়ে আবারো তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়। সরকারের পক্ষ থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের অন্তরায়গুলো চিহ্নিত করে সমন্বিত একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালনার উপর জোর দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে নগরীর বিভিন্ন খাল এবং কর্ণফুলী নদী দখল করে গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ, খাল সংস্কার ও খনন, প্রকল্পের কাজে গতিশীলতা তৈরি করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হবে। বিশেষ করে খাল নালা দখলকারীদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান পরিচালিত হবে। পুরো বিষয়গুলো ঠিকঠাক করে প্রকল্প তিনটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন এবং এর সুফল ঘরে তোলার লক্ষেই মূলত চট্টগ্রামে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক বসছে। আগামী ২৬ জুন সকালে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা এবং কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা নিয়ে এই বৈঠকে প্রধান অতিথি থাকবেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। বৈঠকে স্থানীয় সরকার সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা যোগ দেবেন। বিভাগীয় কমিশনারের সভাপতিত্বে এই বৈঠকে চসিক মেয়র, সিডিএ চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিএমপি কমিশনার, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। উচ্চ পর্যায়ের এই বৈঠকে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহিত তিনটি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করা হবে। এতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের অন্তরায়গুলো চিহ্নিত করে সমন্বিতভাবে ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালিত হবে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র আভাস দিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেশ অসন্তুষ্ট। এত টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েও জলাবদ্ধতা থেকে কেন নিস্তার মিলবে না তা তিনি জানতে চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বেশ তৎপর হয়ে উঠেন। সবার অংশগ্রহণে সমন্বিতভাবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালিত হবে। চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে বলেও সূত্রটি জানিয়েছে। তিনি বলেন, দখল থেকে খাল নালা উদ্ধার করে শহরের পানি নামার পথ করে দিতে হবে। দখল দূষণ থেকে কর্ণফুলীকে উদ্ধার করে সে পানি যাতে নদী ধারণ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আর আগামী ২৬ জুনের বৈঠক থেকে এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যা করতে হয় তা করার অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হবে। তিনি আভাস দিয়ে বলেন, প্রয়োজনে এই ধরনের সিরিজ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। তবুও চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতার কবল থেকে রক্ষা করতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনির্দেশনা মানার বালাই নেই
পরবর্তী নিবন্ধধৈর্য ধরুন, টিকা পাবেন : প্রধানমন্ত্রী