নির্মাণাধীন ক্যান্সার ভবন দৃশ্যমান চিকিৎসায় নতুন দিগন্তের আশা

বিশ্ব ক্যান্সার দিবস আজ

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৪:৫২ পূর্বাহ্ণ

কয়েক বছর আগেও মানুষ মনে করত ক্যান্সার মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। অবশ্য এখন সে ধারণা বদলে গেছে। ক্যান্সারের চিকিৎসা এগিয়েছে অনেক দূর। সম্ভব হচ্ছে এর প্রতিরোধ। আছে প্রতিকারও। ক্যান্সারের আভিধানিক অর্থ কর্কট। সারা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ক্যান্সারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। শরীরের যেকোনো অংশেই হতে পারে ক্যান্সার। প্রতিবছর বিশ্বে ১২ কোটিরও বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সারের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন অব ইন্টারন্যাশনাল ক্যান্সার কন্ট্রোল (ইউআইসিসি)ও ডব্লিউএইচও’র উদ্যোগে ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর ৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব ক্যান্সার দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য– ‘দূর হোক ক্যান্সার চিকিৎসার সকল অন্তরায়।’ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেডিওথেরাপি (ক্যান্সার) বিভাগও দিবসটি উদযাপন করছে। দিনের শুরুতে বর্ণাঢ্য র‌্যালি চমেক ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করবে। সকাল দশটা থেকে ওয়ার্ডে বিনামূল্যে স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি রাখা হয়েছে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ স্ক্রিনিং কর্মসূচি চলবে। থাকছে আলোচনা সভাও।

দেশের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ক্যান্সারে ভুগছে এমন রোগীর সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক কোনও পরিসংখ্যান নেই। তবে বলা হয়, বর্তমানে দেশে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা ১২ থেকে ১৪ লাখ। প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখের মতো মানুষ। আর আক্রান্তদের মাঝে প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ১ লাখ। তবে মরণঘাতী এই রোগ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত হয়নি। অপ্রতুল চিকিৎসা সেবাও। সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতেদেশের ১২/১৩ লাখ ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় আনুমানিক প্রায় ২০০ জন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ও ২০ জনের মতো শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত আছেন। আর দেশে মোট ২২টির মতো হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার কমবেশি সুবিধা রয়েছে। তবে এসবের অধিকাংশতেই রয়েছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম স্বল্পতা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যান্সার আক্রান্তদের প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীকে রেডিওথেরাপি নিতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি ১ মিলিয়ন (১০ লাখ) মানুষের জন্য অন্তত একটি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র থাকা বাঞ্ছনীয়। যাতে রেডিওথেরাপি মেশিন অবশ্যই থাকবে। সে হিসেবে ১৫/১৬ কোটি মানুষের জন্য বাংলাদেশে ন্যূনতম ১৫০ থেকে ১৬০ টি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র থাকার কথা। কিন্তু সারা দেশে রেডিওথেরাপি মেশিন সমৃদ্ধ চিকিৎসা কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ১৩টি। আর দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৫ কোটি মানুষের জন্য মেশিনসহ চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে মাত্র একটি। এটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। তাতেও ক্যান্সারের চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রকট অভাব দীর্ঘদিন ধরে। যদিও বর্তমানে এ সংকট অনেকটাই দূর হয়েছে। দিন দিন ক্যান্সার চিকিৎসায় সুযোগও বাড়ছে চট্টগ্রামে। হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগে বর্তমানে রেডিওথেরাপি সেবা চালু রয়েছে। আগে রেডিওথেরাপি মেশিন অকেজো হলেই দীর্ঘদিন সেবা বন্ধ থাকতো। এতে করে রেডিওথেরাপি সেবা নিতে ঢাকায় ছুটতে হতো রোগীদের। তবে বেশ কয়বছর ধরে অনেকটা ধারাবাহিকভাবে এ সেবা পাচ্ছে চট্টগ্রামের রোগীরা। বেশ কয়বছর চালু থাকলেও ব্র্যাকিথেরাপি সেবা বর্তমানে বন্ধ। মেশিন অকেজো থাকায় এর সেবা বঞ্চিত হচ্ছে চট্টগ্রামের রোগীরা। অন্যদিকে, বিভাগে সমপ্রতি যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক সিটি স্টিমুলেটর মেশিনও। এতে ক্যান্সারের চিকিৎসা সেবা অনেকটা বেড়েছে।

নির্মাণাধীন বিশেষায়িত ক্যান্সার ভবন এখন দৃশ্যমান : চমেক হাসপাতালে নির্মাণাধীন বিশেষায়িত ক্যান্সার ভবন এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। গত বছরের (২০২২ সালের) ৯ জানুয়ারি ভার্চুয়ালি এ ভবনের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর থেকে ভবনটির নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। এরই মাঝে দুটি বেইজমেন্ট স্থাপনের কাজ শেষে আরো দুটি ফ্লোর বর্তমানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামসহ ৮টি বিভাগীয় শহরের (ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও খুলনা) মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একশ শয্যার একটি করে ক্যান্সার ইউনিট স্থাপনে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১৯ সালে। ডিপিপি অনুযায়ী একশ শয্যার ক্যান্সার ইউনিট স্থাপনের জন্য ২টি বেইজমেন্ট (বাংকার)সহ ১৫ তলা বিশিষ্ট একটি করে ভবন নির্মাণের কথা ছিল। তবে পরবর্তীতে একশ শয্যার বিশেষায়িত ক্যান্সার ইউনিটের পরিবর্তে সমন্বিত ক্যান্সার, কিডনি ও হৃদরোগ বিভাগের জন্য এ ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে ভবনটিতে মোট ৪৬০ শয্যা সংস্থানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভবনটির ৭ম তলা পর্যন্ত থাকছে ১৮০ শয্যার বিশেষায়িত ক্যান্সার ইউনিট। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে গণপূর্ত বিভাগ। দুই বছরের মধ্যে ভবনটি নির্মাণের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে বলে গণপূর্ত বিভাগ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এটি চালু হলে চট্টগ্রামের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে মনে করেন চমেক হাসপাতাল ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ। বিশেষায়িত এই ইউনিটে ক্যান্সারের চিকিৎসায় অত্যাধুনিক সব চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকবে জানিয়ে ডা. সাজ্জাদ বলেন, ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় যা প্রয়োজন, এক কথায় সব কিছুই ওখানে থাকবে। দক্ষ চিকিৎসকনার্সের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জনবলও নিশ্চিত করা হবে। মোটকথা, বিশেষায়িত ক্যান্সার ইউনিটটি চালু হলে চট্টগ্রামে ক্যান্সারের চিকিৎসায় আমূল পরিবর্তন আসবে। কোনো রোগীকে আর রাজধানী ঢাকায় ছুটতে হবে না। সরকারের বিশেষায়িত এই ক্যান্সার ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ চট্টগ্রামবাসীর জন্য বড় ধরণের আর্শিবাদ বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী। মোটকথা, নির্মাণাধীন বিশেষায়িত এ ক্যান্সার ইউনিটটি চট্টগ্রামের জন্য আশার আলো হয়ে দেখা দেবে বলেও মন্তব্য এ চিকিৎসকের।

চট্টগ্রামে ক্যান্সারের চিত্র : এই মরণঘাতী রোগ নিয়ে চট্টগ্রামের চিত্র সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য পাওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের ধারণাবৃহত্তর চট্টগ্রামে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ। আর বছরে এ অঞ্চলে নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষ। তবে উদ্বেগের বিষয় যেক্যান্সার আক্রান্তদের প্রায় ৫০ ভাগ রোগীই কোনও ধরণের চিকিৎসা সেবা পায় না। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরীর মতেব্যয়বহুল হওয়ায় চিকিৎসা সেবার আওতার বাইরেই রয়ে যায় অধিকাংশ রোগী। আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রোগী সরকারি চিকিৎসা সেবা নিতে হাসপাতালে আসে। আর চিকিৎসার জন্য বিদেশকে বেছে নেন সামর্থ্যবান রোগীরা। যাদের সংখ্যা মোট আক্রান্তের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। আর বাদ বাকি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ রোগী এখনো কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তারা ঝাড়ফুঁক, তাবিজ ও কবিরাজি চিকিৎসাতেই ভরসা খুঁজে। অসচেতনতাই এর মূল কারণ।

বাংলাদেশের নারীদের সাধারণত জরায়ু ও স্তন ক্যান্সার এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে মুখ গহ্বর, ফুসফুস, মূত্রনালী ও পাকস্থলীতে ক্যান্সার বেশি হয়ে থাকে। বেশিরভাগ রোগীই শেষ মুহূর্তে চিকিৎসকের কাছে আসেন জানিয়ে এই চিকিৎসকদ্বয় বলেন, রোগীরা এমন পর্যায়ে আমাদের কাছে আসেন যখন তাদের তুলে আনা যায় না। কারণ এদেশে যথাযথ স্ক্রিনিং পদ্ধতি নেই, স্বাস্থ্যনীতিতেও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মধ্যে থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার ধরা পড়ে না।

চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে ওয়ার্ডে চিকিৎসা সেবা নেয়া নতুন ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ২৭৪ জন। আর গতবছর (২০২২ সালে) নতুন এ রোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ৫১০ জন। হিসেবে চট্টগ্রামে ক্যান্সার আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএমপিদের জন্য আসতে পারে কঠোর বার্তা
পরবর্তী নিবন্ধএপ্রিলেই মিলবে ক্ষতিপূরণের ১২০ কোটি টাকা