ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা

টিসিবির বস্তার সূত্রধরে রহস্য উদঘাটন, গ্রেপ্তার দোকানের কর্মচারী

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

নগরীর জামালখান লিচু বাগান এলাকার সিকদার হোটেলের পেছনের নালা থেকে উদ্ধার হওয়া শিশু মারজানা হক বর্ষা (৭) হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের শিকার শিশুটির বাসার অদূরে শ্যামল স্টোর নামের একটি দোকানের কর্মচারী এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে শ্যামল স্টোর থেকে কর্মচারী লক্ষণ দাশকে (৩০) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার লক্ষণ দাশ লোহাগাড়ার উত্তর পুদয়া ৩ নং ওয়ার্ডের মনি মিস্ত্রির বাড়ির ফেলোরাম দাশের ছেলে। সে সিকদার হোটেলের পেছনের গোপাল মুহুরীর গলির একেএম জামাল উদ্দিনের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় শ্যামল স্টোরের গোডাউনে থাকতো। গতকাল দুপুরে আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিংয়ে গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানান সিএমপির উপকমিশনার (দক্ষিণ) মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, গত ২৪ অক্টোবর মারজানা হক বর্ষাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না উল্লেখ করে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তার পরিবার। এরপ্রেক্ষিতে পুলিশ তদন্ত কাজ শুরু করে। এর মধ্যে গত ২৭ অক্টোবর বেলাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ এ ফোন করে ড্রেনে বস্তাবন্দি লাশ দেখার সংবাদ জানান। কোতোয়ালী থানা পুলিশ পরবর্তীতে ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহের সুরতহাল করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। নিহত শিশুটির মরদেহ যখন বস্তা থেকে বের করা হয় তখন আমরা বস্তাতে টিসিবি’র সীল দেখতে পাই। বস্তার সেই টিসিবি’র সীলকে টার্গেট করে আমরা এগোতে থাকি।

টিসিবি’র সীলযুক্ত বস্তায় মালামাল বিক্রয়ের দোকান ও আশেপাশের বিভিন্ন রেস্তোরার গোডাউনে টিসিবি’র সীলযুক্ত বস্তা খুঁজতে থাকি। এক পর্যায়ে শ্যামল স্টোর নামের দোকানের গোডাউন চেক করার সময় একটি খালি টিসিবি’র সীলযুক্ত বস্তা খুঁজে পাওয়া যায়। পরবর্তীতে আমরা ওই দোকানের মালিক ও কোন কোন কর্মচারী কাজ করে তাদের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করি। একইসাথে ঘটনাস্থলের আশেপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করি। টিসিবির সীলযুক্ত বস্তা ও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনায় আসামি লক্ষণ দাশকে শনাক্ত করি। পরবর্তীতে শ্যামল স্টোরের গোডাউনে অভিযান চালিয়ে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দেড়টায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে লক্ষণ দাশ আমাদের জানিয়েছে- সে বিভিন্ন সময় শিশুটিকে দোকান থেকে চিপস, চকলেট দিত। ঘটনার দিন গত ২৪ অক্টোবর বিকেল পৌনে ৫টার দিকে সে ১০০ টাকার লোভ দেখিয়ে ডাক দিয়ে দোকানের গোডাউনে নিয়ে যায়। গোডাউনে নেওয়ার পর নাক, মুখ চেপে ধরে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের ফলে রক্তপাত হওয়ায় লক্ষণ দাশ ভয় পেয়ে যায়। এক পর্যায়ে সে শিশুটির শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং গোডাউনে রাখা টিসিবি’র সীলযুক্ত প্লাস্টিকের বস্তার ভিতরে মরদেহ ভরে নালায় ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ পরে সে ভিকটিমের কাপড়চোপড় পেঁয়াজের খোসার বস্তার ভিতর খোসাসহ ঢুকিয়ে নালায় নিক্ষেপ করে। একইভাবে শিশুটির ব্যবহৃত স্যান্ডেলও নালায় ফেলে দেয় সে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপকমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘটনার পর পরই সে শিশুটির লাশ নালায় ফেলে দিয়েছিল। কারণ তার আশঙ্কা ছিল যে অপেক্ষা করলে এখানে অন্য কোনো লোক আসতে পারে। এমনকি এই এলাকায় সিসিটিভি ক্যামরা রয়েছে, এটিও তার নলেজে ছিল। যার ফলে লাশটি নালার পেছনে ফেলেছে যাতে সিসিটিভিতে না আসে। এক ঘণ্টার মধ্যে লাশটি নালায় ফেলে দেয়। তিনদিন ধরে নালাতে পড়ে ছিল লাশটি। ঘটনা পর পর সে স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু তার আচরণে পরিপূর্ণ স্বাভাবিকতা ছিল না। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদেও আমরা তার অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করি।

ব্রিফিং শেষে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (দক্ষিণ) নোবেল চাকমা বলেন, আসামি লক্ষণ দাশ আমাদের কাছে স্বীকার করেছে শিশুটিকে সে ডেকে নিয়ে নির্যাতন করে। এ সময় তার রক্তক্ষরণ হলে সে ভয়ে পেয়ে মুখ চেপে ধরে হত্যা করে। পররবর্তীতে টিসিবির সীলযুক্ত একটি বস্তায় ভরে পাশের নালায় ফেলে দেয়। নালাটি দোকানের সাথে লাগানো। তবে অভিভাবকদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। এই মেয়েটির যে বাসা আমরা দেখেছি, সেখান থেকে গলির মুখের মোটামুটি দূরত্ব আছে। মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, না যাচ্ছে সেটি পরিবারকে খেয়াল রাখতে হবে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাজীব নামে এক ব্যক্তি বর্তমানে শ্যামল স্টোরের মালিক। তবে তিনি দোকানে বসেন না। বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে থাকেন। নিউটন দাশ সুজন নামের এক ব্যক্তি ব্যবস্থাপক হিসেবে দোকানটি পরিচালনা করেন। ঘটনার পর সুজনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তার কাছ থেকে কোনো তথ্য না পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে পুলিশ যখন শিশুটির লাশ উদ্ধার করতে আসে, সে সময়ও ঘটনাস্থলে উৎসুক মানুষদের সাথে লক্ষণ দাশকে দেখা যায়। এমনকি শিশুটির পরিবারকে জিডি করার পরামর্শও দেয় লক্ষণ দাশ।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নগরীর কোতোয়ালী থানার জামালখান এলাকায় ব্রিজ গলির বড় নালা থেকে মৃত মারজান হক বর্ষা (৭) নামে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। সে নগরীর কুসুমকুমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। তার বাবা আব্দুল হক মারা গেছেন। মা ঝর্ণা বেগম ও সৎ বাবা মোহাম্মদ ইউছুপের সঙ্গে জামালখান সিকদার হোটেলের পেছনে ব্রিজ গলির বাসায় থাকতো। তার আরও দুই বোন রয়েছে। লাশ উদ্ধারের পর শিশুটির মা একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণে বাধা সৃষ্টিকারীরা ধর্মের লেবাসধারী
পরবর্তী নিবন্ধআবারো পিছিয়ে যেতে পারে মহানগর ও দক্ষিণ জেলা আ. লীগের সম্মেলন