দোলাদি ও একুশ

বিপুল বড়ুয়া | বুধবার , ৩ মার্চ, ২০২১ at ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

বুলা-দোলাদিকে মনে পড়ে।
ধলপহরের আলো আঁধার আকাশের দিকে চোখ রেখে বিড়বিড় করে বলে উঠে সুমি।
বুলা চমকাল। শিরদাঁড়ায় কেনো সরীসৃপ যেনো সির সির করে হেঁটে যায়।
একুশের ভোর। আকাশ ছুঁইয়ে যেনো কুয়াশার কাঁদন অবিরল ঝরে পড়ে। পাতায় পাতায় তার অদ্ভুত টুপটাপ শব্দ।
চারপাশ নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে। কাছাকাছি হরচন্দ্র মুন্সেফ লেন-ব্রিকফিল্ড রোড, গির্জা পাড়ায় সুনসান নীরবতা। সুপার হাউসের বহুতলা অ্যাপার্টমেন্টটি তার বিশাল অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাথলিক ক্লাবের মোড় ঘেঁষে। সুরমা টেইলার্সের কালো সাইনবোর্ডের বাতিটি টিম টিম করে জ্বলছে।
কিছুই বলা হয় না বুলার সুমিকে। বুলার চোখে অস্পষ্টতা। আলো আঁধারি লুকোচুরি। ঝিম মারা চারদিক।
দুচোখ জ্বলে ভরে আসে বুলার। সুমিকে কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। ফিরে যায় বুলা একুশের রক্তঝরা দিনগুলোর কাছে।
দোলাদির কাছে কী এক অদৃশ্য আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায় একুশের স্মৃতি। দোলাদির কতো গল্প-টুকরো টুকরো কথা আজ আবছায়া মনে পড়ে বুলা। একুশের মিছিলে সেই কবে হারিয়ে যাওয়া রক্তের বন্যায় দোলাদি আজ যেনো কবেকার ঝলমলে মুখ-উজ্জ্বল দুটি চোখ নিয়ে আজো মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় দোলাদি। ভাবি আহ্লাদী চেহারার দোলাদি।
কী দারুণ গানের গলা দোলাদির। দোলাদির ইশকুলের একুশের অনুষ্ঠানে করা সেই সুরের ব্যঞ্জনা ছড়ানো গান-‘নয়নমণি দেশ আমার/সোনা মণির দেশ…’ এতসব খুব খুব মনে পড়ে সুমির। সুমির সাথে যেনো পথ চলছে দোলাদিও।
বাসার ঝুল বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বুলা। সুমির চোখে মুখে ইতিউতির কাহন। সুমিও ঠিক বুঝে নেয় বুলার হৃদয়েও এই মুহূর্তে দারুণ রক্তক্ষরণ।
চুপচাপ সেই দোলাদি-কেমন করে অতো সাহসী হয়ে মিছিলে আগেভাগে থেকে গেলো-রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই-স্লোগান তুললো-তা ভাবতে অবাক হয়ে যায় সুমি।
মিছিলের রাজপথ-উত্থাল ছাত্র জনতা-মায়ের ভাষা-বর্ণমালার মান রাখতে উদ্যত সঙ্গীনের মুখে বুক পেতে দেওয়া-এক ঝলক তপ্ত সীসার মচ্ছব-অতপর ইতিহাস দোলাদি। সব-সব একে একে ছবির মতো চোখের পাতায় ভেসে ওঠে সুমির।
অতসব ভাবতে ভাবতে বিষণ্নতায় ভরে যায় সুমির মন। আর ভাবা হয় না-সুমির।
আড় চোখে দেখে কালো পাড়ের শাদা শাড়ির আঁচল বুলা চোখে তোলছে। বুলার চোখেও জল।
নীল কুয়াশা ঝরা ধলপহরের ফুটি ফুটি ভোর, বুলার চোখে লুকোচাপা জল, হারিয়ে যাওয়া কতো চেনা দোলাদি এবং দুঃখিনী বর্ণমালা একসূত্রে বাধা হয়ে আছে।
সুমির দু’হাত হাতে নেয় বুলা। ‘কাঁদিস না সুমি। বুলাদি তো হারেনি। আজ বাংলাভাষা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। বুলাদির রক্ত ঝরার জয় হয়েছে…।’
বুলা-সুমি একসময় পায়ে পায়ে রাস্তায় নামে। দূর থেকে মিছিলে প্রভাতফেরির অমর সঙ্গীত-স্লোগান ভেসে আছে বুলা-সুমি দোলাদির আত্মত্যাগের স্মৃতি-হৃদয়ের যন্ত্রণা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় একুশের মিছিলের দিকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবোয়ালখালীতে বিআরটিসি বাস চালু
পরবর্তী নিবন্ধসোনার বাংলাদেশ