দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

বন্ধুত্ব ও অধিকারে উজ্জ্বল হোক বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক

রাষ্ট্রপতি ভবন চত্বরে বঙ্গবন্ধু-কন্যা বলেন, ‘ভারত আমাদের বন্ধু। আমি যখনই ভারতে আসি, আমার দারুণ লাগে। তার কারণ এখানে এলেই আমার মনে পড়ে যায় আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কথা। আমাদের মধ্যে বরাবর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে। আমরা পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে চলি।’ শেখ হাসিনা এও মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘বন্ধুত্বের মাধ্যমে যে কোনও সমস্যার সমাধান সম্ভব।’ ভারত এবং বাংলাদেশের সামনে এই মুহূর্তে বেশ কয়েকটি সমস্যা রয়েছে। গরু পাচার, তিস্তা জলবণ্টনসহ রোহিঙ্গা সমস্যার মতো একাধিক বিষয়ের আলোচনা হতে পারে। হাসিনা অবশ্য বলেছেন, ‘দারিদ্রই আমাদের মূল সমস্যা। অর্থনৈতিক ভাবে আমরা ভারতের সঙ্গে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে চাই।’
দেশের ভেতর আমাদের জনগণ যতো ভারত বিরোধিতা করুক না কেন তাদের চিকিৎসার জন্য ভারত যাবার বিকল্প নেই। ধনী আমলা বা রাজনীতির বড় বড় নেতারা সিঙ্গাপুর বা লন্ডন আমেরিকা যেতে পারেন কিন্তু সাধারণ মানুষের সাধ্য নাই তাই তাদের গন্তব্য ভারত। এছাড়াও সংস্কৃতি শিল্প সাহিত্য রাজনীতি সব বিষয়ে আমাদের সাথে জড়িয়ে ভারত। ফলে ঝগড়া বা সম্পর্ক খারাপ করে লাভ হবে না। চাই সমঝোতা। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো মনভোলানো কথার কুফল ও আমরা জানি। বেচারা এবার ভারত সফরে বাদ পড়েছেন। যা তার প্রাপ্য ছিল। সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের সামনে মনে একটাই প্রশ্ন কতটা সফলতা আর কতোটা লাভালাভ হলো এই সফরে? কী পেলো জনগণ? আমাদের সমাজ দেশ কতটা উপকৃত হলো এবার? মনে রাখতে হবে শেখ হাসিনা ছেড়ে কথা বলেন না। দরকারে আইনী আশ্রয় নিয়ে তিনি কি করতে পারেন তার প্রমাণ সমুদ্রসীমা নির্ধারণ। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বাংলাদেশ লাভ করেছিল ছিটমহল। সে কথা বিএনপি ভুললেও ইতিহাস বা রাজনীতি ভুলতে পারে না। তা ছাড়া এমন টনাপোড়েনের পরও শেখ হাসিনাই পেরেছেন সবকিছু সামাল দিয়ে বন্ধুত্ব অটুট রাখতে। মোদীর মতো ঝানু আর চতুর রাজনীতিবিদের সামাল দেয়াও কঠিন কাজ। বাংলাদেশ তা ভালো ভাবেই করছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে কুশিয়ারা নদীর পানি ভাগাভাগি কিংবা ভারত থেকে বাংলাদেশের জ্বালানি তেল কেনার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও তিস্তা কিংবা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের মতো ইস্যুতে জটিলতা রয়েই গেল।
দিল্লিতে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী হাসিনার পাশে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশকে এই অঞ্চলে ‘ভারতের বৃহত্তম উন্নয়ন ও বাণিজ্য সহযোগী’ বলে বর্ণনা করেছেন, শেখ হাসিনাও জানিয়েছেন, এই দুই বন্ধু দেশ যে কোনও অমীমাংসিত বিষয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মেটাতে সক্ষম। বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়েও যে এই দুই নেতার মধ্যে কথাবার্তা হয়েছে ভারত তা প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছে।
ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের রসায়ন ৫৪টি অভিন্ন নদীর মতো প্রবহমান। এগুলো যেমন সত্য তেমনি সত্য ইতিহাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত অভিন্ন তাই অনেক সময় আমরা ছাড় দেই। এক কোটি বাঙালিকে আশ্রয় খাদ্য চিকিৎসা দেয়া যুদ্ধে সাহায্য করা ভারত আমাদের বন্ধু ছিলো। কিন্তু সময় অনেক কিছু বদলে দেয়। অমীমাংসিত ফারাক্কার পর এখন তিস্তা আমাদের গলার কাঁটা। ভারত সেদিক থেকে এখনো উদার মনের পরিচয় দেয় নি। তারপর ও শেখ হাসিনার অর্জন কম কিছু না। তিনি ছিটমহল থেকে অনেক কিছু আদয় করে নিতে পেরেছেন। বিএনপি বাইরে যা বলুক তারা ভালো জানে তাদের আমলে তারা মুখে বিরোধিতা করলেও আসলে কিছুই পায় নি। এই না পাওয়া আর তিক্ততা তাদের গদী হারানোর অন্যতম কারণ। শেখ হাসিনা ঝানু রাজনীতিবিদ। দেশের হাল একা শক্ত করে ধরে রাখার পাশাপাশি চীন ভারতের রসায়ন ও সামাল দিচ্ছেন। যারা বাংলাদেশকে শ্রীলংকা হবে বলে ভয় দেখিয়েছিল তারা এখন গর্তবাসী। তারা ভুলে গেছে তাদের কথা কাজে আসে নি।
আমার ধারণা ভারত সফরের কারণ সম্পর্কের নবায়ন ও কিছু জরুরি আলাপ। যা আগামী নির্বাচনে প্রভাব রাখবে। আমেরিকার বগল তলায় থেকে যেমন তার বিরোধিতা করা যায় না রাশিয়ার কাছে থেকে বিরোধিতা করলে যেমন ইউক্রেন হতে সময় লাগে না তেমনি আমাদের অবস্থান ও নিরাপদ রাখা জরুরি। যা শেখ হাসিনা জানেন। খেয়াল করবেন ইউক্রেনের কাছে অস্ত্র বিক্রি আর মৌখিক ভরসা দেয়া ছাড়া ন্যাটো কিছুই করতে পারে নি। আমাদের দেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া এবং আওয়ামী লীগের ইমোশনাল ভুলে মানবিকতার নামে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গা ও কিন্তু বিষফোঁড়া। এদের বিদায় সহজ হবে না। সবচেয়ে বড় বিষয় অর্থনৈতিক মুক্তি।
করোনা উত্তর দুনিয়ায় মুদ্রাস্ফীতি আর বাজারের অস্থিরতা সব দেশে সব জাতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এর দায় চুকাচ্ছে জনগণ। বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ এর বাইরে নয়। যদিও ভারত তার নিজের বড় বাজার আর রাজ্যগুলোর উৎপাদনজনিত বাস্তবতায় ভালো জায়গায় আছে। আমাদের সাথে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক ভালো এবং সুষম না হলে লাভ নেই। বরং চাপ বাড়বে। এসব বিষয় বিবেচনার পাশাপাশি এই সফর আরো বহু কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সবচেয়ে অধিক মনে লেগেছে শেখ হাসিনার মমত্ব আর কৃতজ্ঞতাবোধ।
কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা এখন প্রায় উধাও হবার পথে। দেশে দেশে মানুষে মানুষে অকৃতজ্ঞতা আর বিস্মরণের নমুনায় ঈশ্বর ও ভয়ার্ত আজ।
একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধ না হলে বাংলাদেশ হতো না। মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও ইন্দিরা গান্ধী না থাকলে বিজয় হতো? পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার মিত্র আমেরিকা, চীনের জাল ছিন্ন করে মুক্ত হবার সংগ্রামে ইন্দিরা ছিলেন ভ্যানগার্ড। পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের অপমান হজম করেও তিনি মাটিতে নাক গুঁজে অপেক্ষা করতেন। তাঁর সময়মতো সিদ্ধান্ত ও কৌশলে বিজয় ধরা দিয়েছিল।
যে কারণে পাকিস্তানের নিহত নেত্রী ভুট্টো তনয়া বেনজির গিয়েছিলেন ইন্দিরা দর্শনে। পিতার সাথে হেলিকপ্টার থেকে দেখতে পাওয়া ছিপছিপে এই সহজ নারীকে দেখে তাঁর বিস্ময় বাধ মানে নি। এমন হাওয়ায় উড়ে যাওয়া নারীর কাছে কপোকাত হলো পাক রাজনীতি, বলশালী পাক সেনাবাহিনী? পরে কথা বলে বুঝেছিলেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনে বড় হওয়া ইন্দিরা নেহেরুর কন্যা। তাঁর পা যেমন মাটিতে দৃষ্টি তেমনি আকাশে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় তো বটেই পঁচাত্তরের পর বেঁচে যাওয়া তাঁর দুই কন্যাকেও ভোলেন নি ইন্দিরা। তাদের আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তা ও জীবন চলমান রাখায় পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মায়ের মতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা ভোলেন নি। যতোবার তিনি ভারত সফরে যান সরকারি বা বিরোধী দল সেটা বড় বিষয় না কংগ্রেসের এই পরিবারের সাথে তিনি দেখা করেন।
এই সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতা এখনো পৃথিবীতে আছে বলেই মানুষ বেঁচে আছে। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।
আমাদের দেশে এখন রাজাকার বা স্বাধীনতা বিরোধীরা সমুখে নেই কিন্তু ঘাপটি মেরে আছে সব জায়গায়। এরা সমাজিক মিডিয়াকে ভর করে নিন্দা কুৎসা আর দেশ বিরোধিতায় লিপ্ত। এদের কথা শুনলে লোকসান ছাড়া এগুনো যাবে না। তাই সময় তার নিয়মে আসবে যাবে। সময়ে বদলে যাবে অনেক কিছু। কিন্তু এসব ঘটনা লিখা থাকবে আমাদের ইতিহাসের খাতায়। যে দেশ ও জাতি রক্তস্নানে মুক্তি পেয়েছিল যার স্বাধীন মাটি ভিজেছিল জনকের রক্তে। চার জাতীয় নেতার রক্তে তার আগামীকাল মনে রাখবে শেখ হাসিনার উদারতা আর সম্মানবোধ। সে কারণে রাহুল গান্ধীর সাথে এবারের দেখা ও কুশল বিনিময় মনে করিয়ে দিল, অতীতও ইতিহাস কখনো মুছে যায় না। সময়ের দাগ থাকে ভবিষ্যতের পাতায় পাতায়।
লেখক : সিডনি প্রবাসী প্রাবন্ধিক, কবি ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধট্রেলারে নজর কাড়লেন ঐশ্বরিয়া