জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ উদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে গোসলের নির্দেশনা ও শরয়ী বিধান

পবিত্র কুরআনের আলোকে গোসলের বর্ণনা: মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের বহুস্থানে পবিত্রতা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন, শারিরীক পবিত্রতা, পোষাক পরিচ্ছদের পবিত্রতা, নামায আদায়ের জন্য স্থানের পবিত্রতাসহ অসংখ্য বিষয়ে পবিত্রতা অর্জনের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন। “গোসল” শব্দটি আরবি, পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফে ধৌত করার অর্থে শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। শরয়ী পরিভাষায় পবিত্রতা হাসিলের উদ্দেশ্য পবিত্র পানি দ্বারা সমস্ত শরীর ধৌত করাকে গোসল বলা হয়। (আল ফিকহুল ইসলামী, ১ম খন্ড)
গোসলের বিধান সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমরা জানাবত অবস্থায় থাকলে উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করবে” (৫:৬)
শরয়ী পরিভাষায় “জানাবত” অর্থ অপবিত্রতা বা নাপাকী, অর্থাৎ অপবিত্রতার এমন অবস্থা যে অবস্থায় নারী পূরুষের ওপর গোসল ফরজ হয়। বর্ণিত আয়াতের আলোকে মুজতাহিদ ফকীহগণের বর্ণনা মতে পূর্ণ শরীর ধৌত করা ফরজ। শরীরের কোন স্থান চুল পরিমান শুকনো থাকলে গোসল শুদ্ধ হবে না। (বাহরুর বায়েক, ১ম খন্ড)
হাদীস শরীফের আলোকে গোসলের তাৎপর্য: হাদীস শরীফের উল্লেখযোগ্য কিতাব সমূহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গোসলের নিয়ম কানুন পদ্ধতি সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে এ পর্যায়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কয়েকটি হাদীস শরীফ উপস্থাপন করছি। হযরত আবু উমামাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি হযরত ওমর ইবন খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্নণা করেন যে, হযরত ওমর (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট জানাবাতের (নাপাকির) গোসল সম্পর্কে জানতে চাইলেন, জবাবে নবীজি বললেন, নিশ্চয় আমি আমার মাথার উপর তিনবার পানি ঢেলে দিই। আর প্রতিবারই আমি মাথায় ঘষা মাজা করি। (সহীহুল বিহারী, ১ম খন্ড, পৃ: ৫৪৭)
গোসলের সময় পুরো শরীরে পানি প্রবাহিত করা হাদীস দ্বারা প্রমানিত। মানব দেহের কিছু অঙ্গ দৃশ্যমান আর কিছু অঙ্গ অদৃশ্য, শরয়ীভাবে গোসল সহীহ হওয়ার জন্য শরীরের প্রতিটি স্থানে পানি পৌছাতে হবে। কোন স্থানে যদি শুকনো থাকে গোসল পরিপূর্ণ হবে না। হাদীস শরীফে এরশদ হয়েছে, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি জানাবাতে (নাপাকির) গোসল করার সময় মাথা ধৌত করে সে অবশ্যই উত্তমরূপে ভালভাবে মাথা ধৌত করবে। অত:পর পুরো শরীর ধৌত করবে। (ইমাম আবদুর রাযযাক আল মুসন্নিফ, হাদীস নং: ১০০৭)
গোসলের সময় পর্দা করা প্রসঙ্গ: লজ্জাশীলতা ও শালীনতা ইসলামের সৌন্দর্য। উলঙ্গপনা ও নগ্নতা ইসলাম সমর্থন করেনা। গোসলের সময় কাপড় দিয়ে আড়াল করা এমনকি সংরক্ষিত রাথরুমেও নগ্নভাবে গোসল করা কুরুচিপূর্ণ ও অশুভনীয়।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত ইয়ালা ইবন মুনাব্বাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হে মানব মন্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভূ লজ্জাশীল ও দয়াবান। সুতরাং তোমাদের কেউ যখন গোসল করে সে যেন পর্দা করে। (কানযুল উম্মাল, হাদীস নং: ২৬৬০৭)
গোসলের সুন্নাত তরীকা: প্রথমে এভাবে নিয়্যত করুন, আমি অপবিত্রতা দূরীভুত করা জন্য গোসলের নিয়্যত করছি। অত:পর উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধৌত করবে। শরীরের কোথাও নাপাকী থাকলে তা ধৌত করুন। অত:পর নামাযের মত অযু করুন। ডান কাধে বাম কাধে মাথায় এবং সমস্ত শরীরে তিনবার করে পানি প্রবাহিত করুন। গোসলের স্থান থেকে সরে পা ধুয়ে নিন। পুরুষেরা গোসলের সময় নাভী থেকে হাটু পর্যন্ত কাপড় দ্বারা সতর ঢেকে নিন। মহিলাদের গোসলের সতর ঢাকার ক্ষেত্রে অধিক সতর্কতা আবশ্যক। (বাহারে শরীয়ত, ১ম খন্ড, পৃ: ৩১৭)
গোসলের প্রকার ভেদ: শরয়ী ভাবে গোসাল চার প্রকার। ১. ফরজ, ২. ওয়াজিব, ৩. সুন্নাত, ৪. মুস্তাহাব।
চার প্রকার গোসলের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা আলোকপাত হলো:
১। ফরজ গোসল: ১. বীর্যপাত হলে, ২. স্বপ্নদোষ হলে, ৩. মহিলার যৌনাঙ্গে পুরুষাঙ্গের প্রবেশ হলে বীর্যপাত হোক বা না হোক গোসল ফরজ হবে, ৪. হস্ত মৈথুনের মাধ্যমে বীর্যপাত ঘটালে গোসল ফরজ। হস্ত মৈথুন গুনাহের কাজ এর পরিণতি মারাত্নক ভয়াবহ, এর দ্বারা যৌন শক্তি হ্রাস পায়, দাম্পত্য জীবন সুখকর হয়না। হাদীস শরীফে হস্ত মৈথুন কারীকে অভিশপ্ত ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। (মারাকিউল ফালাহ, পৃ: ৯৬), ৫. হায়েজ তথা ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার পর, ৬. নিফাস তথা সন্তান জন্মের পর যে রক্ত বের হয় তা বন্ধ হওয়ার পর গোসল ফরজ। (বাহারে শরীয়ত, ১ম খন্ড)
২। ওয়াজিব গোসল: মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়া ওয়াজিব। অমুসলিম ব্যক্তি জানাবাত অবস্থায় ইসলাম কবুল করলে তার জন্য গোসল ওয়াজিব। পানির মধ্যে মুসলমানের মৃত লাশ পাওয়া গেলে তাকেও গোসল দেয়া ওয়াজিব। (আলমগীরি ১ম খন্ড, বাহারে শরীয়ত ২য় খন্ড, পৃ: ৪৯)
৩। সুন্নাত গোসল: সুন্নাত গোসলের বর্ণনা প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, সাহাবী হযরত ফাকিহী ইবন সাদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুম’আর দিন, আরাফার দিন, ঈদুল ফিতরের দিন ও ঈদুল আযহার দিন গোসল করতেন। (ইমাম আহমদ আল মুসনাদ হাদীস -১৬৭২০)
হযরত উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে নবীজি যখন মক্কা মুকাররমার দিকে যাত্রা করতেন ইহরাম পরিধান করার ইচ্ছা করলে গোসল করতেন। (ইমাম তাবরানী, মুজামুল আওসাত, হাদীস -৪৮৮৯)
৪। মুস্তাহাব গোসল: ১. আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের জন্য, ২. মুযদালিফায় অবস্থানের জন্য, ৩. হেরম শরীফে প্রবেশ করার জন্য, ৪.হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এর রওজা মুবারক যিয়ারতের জন্য, ৫. কাবা শরীফ তাওয়াফের জন্য, ৬. মিনাতে প্রবেশ করার জন্য, ৭. জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপের তিন দিন, ৮. শবে বরাতের রজনীতে, ৯. কদরের রজনীতে, ১০. আরাফার রজনীতে, ১১. মিলাদ শরীফের মাহফিলে উপস্থিতির জন্য, ১২.অন্যান্য বরকতময় মাহফিলে উপস্থিতির জন্য, ১৩. মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়ার পর, ১৪. পাগলের পাগলামী দুর হওয়ার পর, ১৫. সংজ্ঞাহীন ব্যক্তির সংজ্ঞা ফিরে আসার পর, ১৬. নেশাগ্রস্তের নেশা দূরীভূত হওয়ার পর, ১৭. গুনাহ থেকে তাওবা করার জন্য, ১৮.নতুন কাপড় পরিধানের জন্য, ১৯. সফর থেকে আগুন্তুকের সাক্ষাতের জন্য, ২০.ইস্তিহাযার রক্ত বন্ধ হওয়ার পর, ২১.২২. চন্দ্র গ্রহণ, সূর্য গ্রহণ এবং ইসতিসকা তথা বৃষ্টি প্রার্থনার নামাযের জন্য, ২৩. ভয়ভীতি থেকে মুক্তির নামায আদায়ের জন্য, ২৪.ভীষণ অন্ধকার ও প্রচন্ড বাতাস থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশে নামায আদায়ের জন্য, ২৫. শরীরে কোন স্থানে নাপাকী লেগেছে তা জানা না থাকলে, উপরোক্ত সব অবস্থায় গোসল করা মুস্তাহাব। (বাহারে শরীয়ত ২য় খন্ড, পৃ: ৪৯, দুররুল মুখতার ১ম খন্ড, পৃ: ৩৪০-৩৪৩)
কয়েকটি গোসলের নিয়্যত একটি গোসলে যথেষ্ট, কারো স্বপ্ন দোষের কারণে গোসল আবশ্যক হলো আবার ঈদের দিনও এবং জুমার দিনও সে ব্যক্তি তিনটি গোসলের নিয়্যত করে একবার গোসল করলে সবগুলোর সওয়াব পেয়ে যাবে। (বাহারে শরীয়ত ২য় খন্ড, পৃ: ৫০), হে আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর পথে সঠিক হিদায়াত দান করুন। ইসলামের উপর অবিচল থাকার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ আনিসুল ইসলাম
সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল্‌-কোরআন মানবতার চিরকাঙ্ক্ষিত সিরাতুল মুস্তাকিম
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে