দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। বিমানযাত্রা যে কত ধরনের ভোগান্তির সৃষ্টি করে তা এসবের মুখোমুখি না হলে বিশ্বাস করা কঠিন। পরনের জুতা মোজা থেকে শুরু করে বেল্ট হাত ঘড়ি থেকে শুরু করে সবই খুলে ফেলতে হয়। বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য এসব করা হয়। যাত্রীদের স্বার্থেই করা হয়, করা হয় দেশের স্বার্থে। কিন্তু কত আর সহ্য করা যায়! ভালো লাগে না। আমরা একে একে সব খুলে নিরাপত্তা তল্লাশী সম্পন্ন করলাম। স্ক্যানারের ভিতর দিয়ে পুরো শরীর ঢোকানোর পর নতুন করে বেল্ট খোলার প্রয়োজনটাই বা কি তা বুঝতে পারি না। জুতা খোলার প্রয়োজনটাই বা কি তাও বুঝিনা। একসময় এসব করা হতো না। বিশ্বব্যাপী জঙ্গি তৎপরতা শুরু হওয়ার পর থেকে শুধু আমাদের দেশেই নয়, পুরো পৃথিবীতে সিকিউরিটি চেকের নামে যাত্রীদের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা ডোমেস্টিক রুটের যাত্রী। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাবো। তবুও সবকিছু খুলে টুলে আমরা বিমানে চড়লাম। আমাদের নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং উপরের দিকে উঠছিল। দুবাই থেকে আসা আন্তর্জাতিক একটি ফ্লাইটের ডোমেস্টিক যাত্রী হিসেবে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। বিষয়টি দারুণ। এত বড় এয়ারক্রাফট সচরাচর ডোমেস্টিক রুটে পরিচালিত হয়না। সৌদি আরব এবং দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের বড় ফ্লাইটগুলো চট্টগ্রামের যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে অনেকটা খালি অবস্থায় ঢাকায় ফিরে যেতো। কারন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে চট্টগ্রামে আসা ফ্লাইটগুলোর বেশিরভাগ যাত্রীই চট্টগ্রামে নেমে পড়েন। পুরো বিমানে ঢাকার দশ বিশজন যাত্রী হয়তো থাকেন। প্রায় খালি ফ্লাইটটি ঢাকায় উড়ে যায়, ওখান থেকে আবার অন্য কোন রুটে যাত্রা করে। চট্টগ্রাম থেকে খালি ফ্লাইট না নিয়ে এখান থেকে যাত্রী নিয়ে গেলে উভয়পক্ষেরই সুবিধা হয়। এতে চট্টগ্রামের সাথে ঢাকার যোগাযোগ যেমন সুবিধা হয় তেমনি বিমানের আয় রোজগারও কিছুটা বাড়ে। শুরুতে মাত্র দেড় হাজার টাকায় টিকেট দেয়া হলেও ক্রমে তা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা তো স্বাভাবিক ভাড়ায় টিকেট করেছি। তবে সুবিধা হচ্ছে বড় ফ্লাইটে কিছুটা আয়েশ করে যাচ্ছি। এই ধরনের আধুনিক এবং নতুন এয়ারক্রাফটগুলো অভ্যন্তরীন রুটে চলাচলকারী পুরানো এবং ছোট এয়ারক্রাফট থেকে নিরাপদ বলে মনে করা হয়। অবশ্য আকাশ থেকে নিচে পড়লে এয়ারক্রাফটের সাইজ খুব বেশি কাজে লাগবে না। সময়মতো চাকা না নামলে ছোট বড় ব্যবধান ঘুচতেও সময় লাগবে না।
আমরা ভালোয় ভালোয় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। আমাদেরকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ডোমেস্টিক টার্মিনালে এবং দুবাই থেকে আসা যাত্রীদের আন্তর্জাতিক টার্মিনালে পাঠানো হলো। বিষয়টি ভালো, তবে এই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের কিছুটা সুবিধা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে স্বর্ণ চোরাচালান। দেশের দাগী স্বর্ণচোরাচালানীরা বিদেশ থেকে আন্তর্জাতিক যাত্রীর মাধমে স্বর্ণ এনে তা ডোমেস্টিক যাত্রীর মাধ্যমে পাচার করে এমন একটি অভিযোগও পুরানো।
আমরা আমাদের লাগেজ নিয়ে ডোমেস্টিক টার্মিনাল থেকে বের হয়ে গেলাম। ঢাকার গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হেলাল ইউ আহমেদ এবং আরিফ মঈনুদ্দীন আমাদের জন্য গাড়ি পাঠিয়েছেন। আমাদেরকে বেশ চমৎকার একটি অফিস কাম বাসায় নিয়ে যাওয়া হলো। বায়িং হাউজের অফিস। বিশাল ফ্ল্যাটের দুইটি রুমে বেশ গোছানো অফিস, পাশের তিনটি বেড়রুম চমৎকার করে সাজানো। দামী বিছানা থেকে শুরু করে অন্যান্য আসবাবও চোখে পড়ার মতো। ফ্রিজ এসি সবই তকতকে ঝকঝকে। বিদেশী বায়ারেরা আসলে নাকি এখানে থাকেন। অন্যথায় ফাঁকা পড়ে থাকে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সব ধরনের আয়োজনই রয়েছে। আমাদের সবার জন্য রাতের খাবারের জমজমাট ব্যবস্থা করা হলো। বিশ্রামেরও। উত্তরার এই অফিস কাম বাসায় আমরা গল্পে গল্পে ঘন্টা তিনেক সময় অনায়াসে কাটিয়ে দিলাম।
আবারো বিমানবন্দরে আমরা। ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এবার ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে। ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে লাগেজ বুকিং দিলাম আমরা। গ্রুপ চেকইন করা হলো। এতে বহুমুখী সুবিধা রয়েছে। লাগেজে কারো কমবেশি হলে ওজন নিয়ে ঝামেলা হয়না। সিটও একই সাথে দেয়া হয়। নিজেদের মতো করে আড্ডা দিয়ে ফ্লাইটের কষ্টের সময়গুলো পার করে দেয়া যায়। ‘ফ্লাইটে কষ্টের সময়’ শুনে কি চমকালেন? আসলেই, বিমান জার্ণির মতো কষ্টকর আর কোন জার্ণিই হতে পারে না। বিশেষ করে আমরা যারা ইকোনমি ক্লাসে ভ্রমন করি তাদের জন্য। এই পথে কষ্টের যেন অন্ত থাকে না। এর থেকে ট্রাকের ছাদের জার্ণিও অনেক ভালো বলে মনে হয় আমার। তবে সময় এবং দূরত্বকে জয় করার জন্য বিমান জার্ণির কোন বিকল্প নেই। তাই বাধ্য হয়েই চড়তে হয়, চড়ি।
লাগেজ বুকিং দিয়ে আমরা ইমিগ্রেশন ডেস্কের দিকে চলে গেলাম। তেমন কোন বাক্য ব্যয় না করে ইমিগ্রেশন অফিসার সীল মেরে দিলেন। ইমিগ্রেশন পুলিশের এসআইকে আমার বেশ বিরক্ত বলেও মনে হলো। তার চেহারায় সাত রাজ্যের বিরক্তি। বাসায় ঝগড়া ঝাটি করে এসেছেন কিনা কে জানে! তিনি কোন কথা না বলে শুধু সীল মেরে আমাকে সামনের দিকে যাওয়ার জন্য হাত ইশারা করলেন। আমি থ্যাঙ্কু বলে সামনে এগুলেও তিনি কোন উত্তর দিলেন না।
আমরা ফ্লাইটে চড়ে বসলাম। সাড়ে তিন ঘন্টার ফ্লাইট। দেশীয় কোম্পানির ফ্লাইটে বিদেশ যেতে অন্যরকমের আনন্দ লাগে। গর্বে বুক ফুলে উঠে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোতে বিদেশী এয়ারলাইন্সের মতো সার্ভিস পাওয়া যায় না। নানা সীমাবদ্ধতা থাকে, ঘাটতি থাকে। মাঝে মধ্যে বিরক্তিও লাগে। আবার ভুলে যাই। নিজেদের এয়ারলাইন্স। অনেককিছু সয়ে নিতে হয়, নিই। এই যাত্রায়ও আমরা আমাদের পতাকাবাহী ফ্লাইটের নানা সীমাবদ্ধতার দিকে খেয়াল না করে নিজেদের ক্যারিয়ারে যাওয়ার ব্যাপারটিকে উপভোগ করছিলাম।
সহযাত্রীদের অনেকেই ব্যবসায়ী। ছাত্র ছাত্রীও রয়েছেন। চীনের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করেন এমন শত শত মানুষের পাশাপাশি চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়ন করেন এমন অনেক ছাত্রছাত্রী এই রুট ব্যবহার করেন। এই ফ্লাইটও। একই রুটে বাংলাদেশ বিমানেরও ফ্লাইট রয়েছে। রয়েছে সাদার্ন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট। ফ্লাইটের ভিতরে আমাদের মতো আচরণ দেখছিলাম। সিট এবং কেবিন ব্যাগ রাখা নিয়ে হুড়োহুড়ির কমতি ছিল না।
নির্ধারিত সময়ে ফ্লাইট উড়াল দিল। চীনের গুয়াংজুর পথে আমাদের এয়ারক্রাফট কেবলই ছুটছিল। বিমানবালারা এদিক থেকে ওদিক, আবার ওদিক থেকে এদিকে হাঁটাহাটি করে নিজেদের কাজ সারছিলেন। যাত্রীদের চা কফি জুস এবং মদ বিয়ার সার্ভ করা হচ্ছিল। আমি বেশ কড়া করে এক কাপ কফি দেয়ার অনুরোধ করলাম। কিন্তু আমার পাশ দিয়ে একাধিকবার ওই কেবিনক্রু আসা যাওয়া করলেও আমাকে কফি সার্ভ করা হলো না। তিনি ট্রে তে মদের গ্লাস সাজিয়ে কেবলই আসা যাওয়া করছিলেন। আমার মনে হলো কফি না খেয়ে মদ খেলে আগে গ্লাস পাওয়া যেতো। আমি ধৈর্ষ ধরে অপেক্ষা করছিলাম। বেচারি মদের গ্লাস সার্ভ করতে বেশী আনন্দ পাচ্ছেন বলেও আমার মনে হলো। কারো আনন্দ নষ্ট করতে ইচ্ছে করলো না। আমি অন্য কোন কেবিনক্রুকে কফির জন্য বলতে পারতাম। কিন্তু আমি অপেক্ষা করছিলাম।
আরো বেশ কিছুক্ষণ পর নতুন করে তরুণীর দৃষ্টি আকর্ষন করলাম এবং বললাম যে, আমি এক কাপ কফি চেয়েছিলাম। তরুণী আমার দিকে তাকালেন এবং কি বুঝে যেন কিছুটা লজ্জিত হলেন। বললেন, সরি স্যার, ভুলে গেছিলাম। এক মিনিট লাগবে। সত্যি সত্যি মিনিট খানেকের মধ্যে বেশ গরম এক কাপ কফি তিনি আমার সামনে ধরলেন। এতক্ষণের অবহেলা আমি ভুলে গেলাম।
ধুমায়িত কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আমি আসন্ন চীন ভ্রমন নিয়ে রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। ঢাকা থেকে গুয়াংজু কম দূরে নয়। আকাশ পথে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার। ঢাকা থেকে পূর্বমুখী যাত্রা করে মায়ানমারের উপর দিয়ে চীনের সীমানায় প্রবেশ করে বেশ কিছু দূর গিয়ে প্রায় হংকং এর কাছাকাছিতে দেখা মিলে গুয়াংজুর। মাঝারী আকৃতির এয়ারক্রাফটের সাড়ে তিন ঘন্টার মতো সময় লাগে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে। বিমানযাত্রার জন্য সাড়ে তিন ঘন্টা মোটামুটি সহনীয় সময়। তেমন বেশী কষ্টকর হয়ে উঠেনা, অসহ্যও লাগে না। তবে ১৭/১৮ ঘন্টার জার্ণিতে বিমানে বসে থাকতে হলে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। একটু পরেই আমাদের খাবার সার্ভ করা হলো। ফ্রাইড রাইসের সাথে চিকেন এবং ভেজিটেবল। ডেজার্ট হিসেবে দেয়া হলো দই। খাবার শেষে আমি এক কাপ চা চেয়ে নিলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমি সাড়ে তিন ঘন্টা সময় কখন ফুরোবে সেই অপেক্ষা করছিলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগণপরিবহন কবে গণমানুষের হবে
পরবর্তী নিবন্ধশহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী : এক সংগ্রামী নারীর বিদায়