দিপু ও ময়না পাখি

সুসেন কান্তি দাশ | বুধবার , ১১ মে, ২০২২ at ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

পাড়ার দুরন্ত ছেলে দিপু। ঢিল ছুঁড়ে আম পাড়া, পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা, কাবাডি খেলায় মেতে উঠা তার প্রতিদিনের কাজ। মা সারাগ্রাম তাকে খুঁজে হয়রান হয়। কোথাও দুদন্ড থামবে এমন আশা তার কাছে করা যাবে না। গ্রামের যে কারো কাজে তার উপস্থিতি অনেকের আশা জাগাতেও তার জুড়ি মেলা ভার। এই যেমন দিদিমা, খুড়িমার বাজার সদাই করে দেওয়া, গাছে উঠে ডাব পেড়ে দেয়া, ডাক্তার ডেকে আনা তার আচরণের মধ্যে পড়ে।

মার কাছে তার এমন ছুটোছুটি মোটেই ভালো লাগে না। মার ভীষণ দুশ্চিন্তা হয়, যখন ভাবে ছেলের লেখাপড়া যদি এমন দস্যিপনার কারনে কমে যায়।
দিপুর বাবা থাকে শহরে। একটি দোকান চালায়। দোকানে নানারকম খেলনাপাতি বিক্রি হয়। সারাবেলা দোকান চলে। গ্রামে ছেলের দস্যিপনার কথা শুনে বাবা মনে মনে ঠিক করে রাখলেন, ছেলেকে শহরে এনে রাখবে।

সেদিন ভর দুপুরে তালতলীর কাছে অগনিত মানুষের ভিড় জমে। দিপুও সেখানে উপস্থিত। দেখতে পায়, তালতলীর মোড়ের অশ্বত্থ গাছের খোপের কাছে একটি বিষধর সাপ। খোপের ভেতর একটি ময়না পাখি সাপের ভয়ে চেঁচামেচি করছে। সাপ খোপের ফাঁকে ছোবল মারছে, পাখি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। লোকেরা গাছে উঠে সাপ তাড়াতে সাহস পায় না। দিপু দ্রুত গাছ বেয়ে উপরে উঠে আসে। সাপের একদম মুখোমুখি। সবাই তাকে নেমে আসার জন্য ডাক পাড়ে। দিপু গাছের একটি ডাল ভেঙে নিয়ে সাপটির সামনে ধরে নড়াচড়া করে। একটু সময় পরে সাপ পাশ কেটে গেলো। ময়না পাখি ভয়ে খোপের একপাশে গুঁজে থাকে। একটি ছোট পাখি। খোপের পাশে ছড়ানো আরেকটি পাখির ছেঁড়া ডানা, আলগা পা। দিপু ভাবে, তবে কী এই পাখির সহপাঠীর এইরূপ অবস্থা করেছে। খোঁপে হাত রেখে আলতো করে পাখিকে হাতে নিয়ে দিপু নেমে এলো। সকালে তার প্রশংসা করতে লাগলো।

মাকে এনে হাতে তুলে দেয় ময়না পাখিটাকে। পাখির সমস্ত কথা শুনে মারও মন ভার হয়ে গেলো। পাখি ভালোমতো উড়তে জানে না, কেবল ডানা ঝাপটায়, কিচিরমিচির ডাকে।

পাখির জন্য খাঁচা আনা হলো। একটি রঙিন খাঁচা। তাতে খড়ের বিছানা করা হলো। খাবার জন্য আলাদা থালাবাটি দিয়ে সাজানো হলো। কদিনেই পাখিটি পোষমানা হয়ে গেলো। এই পাখির নাম দেয়া হয় “পিনু”। কালো পালকে ঢাকা ছোট্ট পাখির গা, লালচে তার ঠোঁট। মা ও দিপুর যত্নে-আদরে পাখি ক্রমেই বড় হতে থাকে। কিন্তু পাখির খাঁচা ভেঙে বের হয়ে যাবার চেষ্টা দিপুর ভালো লাগে না। এতো মায়া ছেড়ে পাখি উড়ে যেতে চায় কেনো তা সে ভেবে পায় না। দিপু মাঝে মাঝে পাখির পায়ে সুতো বেঁধে উড়িয়ে দেয়। খানিক বাদে আবার টেনে আনে, খাঁচায় ভরে রাখে, কিন্তু পিনু ঠোঁট দিয়ে সুতো ছিঁড়ে উড়ে যেতে চায়।
একদিন পড়ন্ত বিকেলে দূরে পথ ধরে বাবাকে আসতে দেখে দিপু। বাবার দুহাতে দিপুর পছন্দের সব খাবার আর খেলনাপাতি। দিপু অতি আনন্দে দৌঁড়ে এসে বাবাকে ঝাঁপটে ধরে। বাবা থলে রেখে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়।

দুদিন পর দিপুকে শহরে নিয়ে খাবার দিন ধার্য্য হয়। দিপু খুব খুশি। শহরে আছে চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, অনেক সুন্দর ইশকুল। বাবা দিপুকে নিয়ে যথাসময়ে চলে আসে, সঙ্গে নিয়ে আসে পোষাপাখি পিনুকে। মায়ের আদেশ হয়, বাবার কথা শুনবে, পড়াশুনা করবে।

শহরের একটি ইশকুল দিপুকে ভর্তি করে দেয় বাবা। এখানে তার পছন্দের সব খাবার। কিন্তু এসব খাবারে তার আগ্রহ কমে আসে। গাছে উঠে আম পেড়ে খাওয়া হয় না, পুকুর জলে সাঁতার কাটার সুযোগ নেই। আছে বড় বড় বাড়ি আর গাড়ির শব্দ।

বাবা নতুন ইশকুলে দিপুকে ভর্তি করে দেয়। এখানে কঠিন নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। দিপুর এসব একদম ভালো লাগে না। ইশকুল থেকে ফিরে বাবার সাথে দোকানে বসে। বাবা দোকান চালানোর ফাঁকে ফাঁকে দিপুকে পড়া বুঝিয়ে দেয়। দোকানের পেছনে থাকার রুম। এখানে তার প্রিয়সাথী পিনুকে নিয়ে তার অবসর কাটে। পিুন দিলে রাতে কিচিমিচি ডাকে আর খাঁবার চতুপার্শে ঘুরে বেড়ায়। দিপু খাঁচার ভেতরে নরম হালুয়া, ছোলার দানা দেয় পাখি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খায়।
এভাবে কেটে গেলো অনেক দিন। শহরের পাথর ইটে গড়া দালানের ভিড়ে মন কেমন চুপসে আসে। দিনে দিনে পাখি কেমন খাপছাড়া হয়ে উঠে। শরীরের কালো পালকগুলি খসে পড়তে শুরু করেছে। ইদানিং পাখি সুর তুলতে জানে, সুরে সুরে নিজের ভাষা প্রকাশ করতে জানে। দিপু তার ভাষা বুঝতে চেষ্টা করে। পাখি যেনো বলে যায় আমার মুক্ত করে দাও, আমি উড়ে চলে যাই।

সেবার গ্রীষ্মের ছুটির ঘোষণা এলো। ইস্কুল বেশ কদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো। এবার দিপুর বাড়িতে যাবার পালা। মনপ্রাণ বাঁধন মুক্তির আনন্দ ছেয়ে উঠলো দিপুর।

সকাল বেলায় ট্রেনে চড়ে বাবার সাথে বাড়ি ফিরলো দিপু। পাড়ার যতো শিশু কিশোর দিপুর সালে দেখা করতে এলো। ময়না পাখি খাঁচা ছেড়ে বেবোবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে উঠে।

দুপুরের তপ্ত রোদের সীমানা বেরিয়ে উঠোনে এলো এক ঝাঁক পাখি, বারান্দায় খাঁচায় ঝোলানো পাখির করুণ সুর আর্তনাদ ভেসে আসে। দিপু বেশ বুঝতে পারলো, পিনু তার পুরানো সাথীদের দেখে এমনটি করছে।মনের খেয়ালে দিপু পাখির খাঁচা খুলে দেয়। পাখি এক পা দুপা করে খাঁচা থেকে বেরিয়ে উড়াল দেয়। বহুদিনের বন্দী পিনু উড়ে চলেছে। মুহূর্তেই একরাশ অশ্রু তার দুচোখে গড়িয়ে আসে। ভাবে, পিনু কী তাকে এভাবে ভুলে যেতে পারবে। এসময় অবাক করে দিয়ে পিনু আবার দিপুর কাঁধে এসে বসে। পিনুর ঠোঁটে আনন্দের সুর। দিপু পাখির গায়ে হাতবুলিয়ে দেয়, বলে, যা রে যা, তুই উড়ে যা যেখানে খুশি যা। পিনু ডানা মেলে আবার উড়াল দেয় আকাশে। দেখে পিনু উড়ে উড়ে একরাশ সাদা মেঘ মিশে গেলো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুর্ভোগের ফেরি আর কতদিন
পরবর্তী নিবন্ধকালবোশেখি