টিকটিকি ও তিশা

সরোজ আহমেদ | বুধবার , ২৫ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

টিকটিকিটা সবসময় তিশার আশপাশেই ঘুরঘুর করে। তাড়ালেও সরে না। লেজ নাড়ে আর চোখ দুটো ফিটফিট করে। মন ভালো থাকলে কখনো কখনো আঙ্গুল দিয়ে টিকটিকির গা ছুঁয়ে দেয় তিশা। তারপরও টিকটিকিটা একটুও ভয়ও পায় না তিশাকে।
আজ তিশার মন ভালো নেই। অনেকক্ষণ থেকে গোমরা মুখে বসে আছে সোফায়। মেঝেতে খেলনাগুলো পড়ে আছে এলোমেলো। একবার ছুঁয়েও দেখছে না। তিশার প্রায়ই এমন হয়। স্কুল থেকে ফিরে কিছু খায় না, খেলে না। চুপচাপ বসে থাকে। সুন্দরী কিছু বললেই মেজাজ দেখায়।
তিশার আব্বু-আম্মু দু’জনই ব্যাংকার। আব্বু ভোরে তিশাকে স্কুলে পৌঁছে দেয়। বাওয়া স্কুলে প্রেপ-টুতে পড়ে তিশা। সকাল সাতটায় ক্লাস। সাড়ে দশটায় ছুটি। তখন আব্বু-আম্মু দু’জনই থাকেন অফিসে। স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সুন্দরীর। এরপর সারাদিন বাসায় সময় কাটে সুন্দরীর সঙ্গে। হলিডে ছাড়া আব্বু-আম্মুকে দিনে পাওয়া মুশকিল।
সুন্দরীকে গ্রাম থেকে আনা হয়েছে তিশার দেখভালের জন্য। মেয়েিিট খুবই ভালো এবং শান্ত। তিশার যত্নে ত্রুটি করে না। তিশাও সুন্দরীকে খুব পছন্দ করে। ওর হাতে গোসল করা, জামা পরা, চুল বিনি করা, খাওয়া দাওয়া- সব। ভালোই সময় কাটে দু’জনের। কিন্তু সুন্দরী যখন ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়, তখন একা একা তিশার ভালো লাগে না। মন খারাপ করে বসে থাকে।
‘তিশা মণি, ও তিশা মণি।’ তিশা চমকে উঠে। মিহি সুরে কে যেন তিশাকে ডাকছে। কিন্তু রুমে কেউ নেই, তিশা একা। সুন্দরীও আশপাশে নেই। গলা বাড়িয়ে দেখে সুন্দরী রান্না ঘরে কাজে ব্যস্ত।
‘তিশা মণির কী মন খারাপ?’ তিশা আবার তাকায় এদিক ওদিক। এবারও কাউকে দেখতে পায় না।
‘এইতো আমি। তোমার বাঁ পাশে দেয়ালে।’ আরে! এইতো সেই টিকটিকি। সারাদিন দেয়ালে দেয়ালে ঘুরঘুর করে। টিকটিকিকে কথা বলতে দেখে তিশা অবাক হয়ে যায়!
‘ও মা, তুমি কথা বলতে পারো!’
‘হুম, পারি তো। তোমার কাছ থেকেই শেখেছি।’ টিকটিকি জবাব দেয়।
তিশা বললো, ‘তুমি আর কী কী পারো?’
‘অনেক কিছুই পারি। এই যেমন নাচতে পারি, গাইতে পারি।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ। নাচ দেখবে?’ এই বলে লেজ দুলিয়ে নাচতে শুরু করে টিকটিকি। তিরিং বিরিং নাচ দেখে তিশা হাসতে হাসতে খিল। তিশার খুশি দেখে টিকটিকির আরও বেশি লাফাতে থাকে।
‘তুমি আমার বন্ধু হবে?’ জানতে চায় টিকটিকি। তিশা বললো, ‘হবো। কিন্তু….।’
‘আবার কিন্তু কেন! আমি তোমাকে সময় দেবো। তোমার সঙ্গে গল্প করবো, নাচবো। তোমার আর মন খারাপ হবে না, প্রমিজ।’
‘ও মা, তুমি তো দেখি ইংরেজিও বলতে পারো?’
‘তুমিও তো বলো। আব্বু-আম্মুর সঙ্গে যখন মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলো, তখন একটু একটু ইংরেজিও বলো। আমি শুনে শুনে শিখেছি।’
‘তাই নাকি? ভেরি গুড। আজ থেকে তুমি আমার গুড ফ্রেন্ড।’ এই বলে টিকটিকির লেজটা নাড়িয়ে দেয় তিশা। খুশিতে টিকটিকি তিরিং বিরিং করে দেয়াল থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামে। আবার দেয়াল বেয়ে দৌঁড়ে উঠে যায় উপরে। টিকটিকির কাণ্ড দেখে খুব মজা পায় তিশা। হাসতে হাসতে ‘ভেরি গুড’ বলে তালি দেয়। টিকটিকিও ‘ঠিক-ঠিক’ করে শব্দ তোলে নাচতে থাকে।
তিশার এখন আর মন খারাপ হয় না। স্কুল থেকে ফেরার পর টিকটিকির সঙ্গে সময় কাটায়। টিকিটিকিও তিশাকে পেলে আর কোথাও যায় না। সারাদিন তিশার চারপাশের দেয়ালে ঘুরে আর মজার মজার গল্প করে। একটু পর পর তিরিং বিরিং নাচ তো আছেই।
তিশাও মাঝে মাঝে টিকটিকির মতো নাচে, খাটে গড়াগড়ি খায়, লাফঝাপ করে। এ জন্য সুন্দরী বকাঝকাও করে। বলে কীনা, ‘দৌড়ঝাপ করা ভালো না, ব্যথা পাবে।’ কিন্তু তিশা ব্যথা পাবে না বললেও শুনতে চায় না সুন্দরী। একটু কিছু করা যায় না, সব কিছুতেই বারণ! দুপুরে ঘুমাতে একদম মন চায় না তিশার। কিন্তু সুন্দরী জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কথাটা টিকটিকিকে বলেও লাভ হয় নি। সে আরও উল্টো বলে কী না, ‘ঘুম স্বাস্থ্যের ভালো। স্কুলের জন্য তোমাকে সেই ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠতে হয়। দুপুরে একটু না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে। তাছাড়া রাতে তো হোম ওয়ার্ক করতে হয়, তাই না। ঘুম যদি কম হয় এনার্জি পাবে কোত্থেকে বলো?’
তিশা গাল ফুলিয়ে বলে, ‘কিন্তু তখন যে তোমার সঙ্গে খেলতে পারি না?’
‘লক্ষ্মি মেয়েটা বলে কী! তাই বলে না ঘুমালে চলবে?’ টিকটিকি একটু থেমে আবার বলে, ‘শোন, যখন যে কাজ তখন সে কাজ করতে হয়। তা নাহলে আর সবার থেকে পিছিয়ে পড়বে। আমি চাই না আমার বন্ধুটা পিছিয়ে থাক।’
টিকটিকি এত সুন্দর করে কথা বলে শুনে অবাক হয়ে যায় তিশা।
‘আচ্ছা ওকে, তোমার কথায় মানলাম। দুপুরে ঘুমোতে যাবো। আবার সন্ধ্যার আগে ঘুম থেকে জাগতেও চাই। কিন্তু আব্বু-আম্মু না ফেরা পর্যন্ত সুন্দরী আমার ঘুম ভাঙাতে চায় না।’
শুনে টিকটিকি জবাব দেয়, ‘কোনো সমস্যা নেই। আজ থেকে আমি তোমাকে ঘুম থেকে জাগাবো।’
‘সত্যি?’ জানতে চায় তিশা।
‘সত্যি। ঘুম থেকে যখন তোমার উঠার সময় হবে, তখন আমি তোমার কানের কাছে গিয়ে ‘ঠিক ঠিক’ শব্দ করবো, তখন তোমার ঘুম ভেঙে যাবে।’
এভাবে রোজ তিশার ঘুম ভাঙে টিকটিকির ‘ঠিক ঠিক’ শব্দে। শুধু তাই নয়, তিশা যখন মনে মনে কিছু ভাবে আর সেই ভাবনা যদি সঠিক হয় টিকটিকি আপনা আপানি বলে ওঠে-‘ঠিক ঠিক’। আর সঠিক না হলে বলে-‘চিক চিক’।
তিশা স্কুল থেকে ফিরেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু টিকটিকির দেখা নেই। আজ টিকটিকিকে একটা কথা বলবে বলে সেই কখন থেকে মন ছটফট করছে। রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। স্কুলেও মন বসেনি। কথাটা না বলা পর্যন্ত শান্তি নেই। স্কুল থেকে এসে জামাটাও খোলা হয়নি। এসেই টিকটিকিকে খোঁজাখুঁজি। টিকটিকিটাও যে কী! অন্যদিন আগেভাগে এসে হাজির। আজ কোনো খবর নেই। অভিমান ঝরে ঝরে পড়ে তিশার চোখে মুখে। এমন সময় লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে আসে টিকটিকি। এসেই টুক করে একটা মশা চালান করে দেয় পেটে। আরেকটা শিকার করতে যাবে এসময় চোখ যায় তিশার দিকে। তিশা মন খারাপ করে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। টিকটিকি কানের কাছে গিয়ে ‘ঠিক ঠিক’ শব্দ করতেই ফিরে তাকায় তিশা। কিন্তু কিছু না বলে অভিমানে আবার মুখ ফিরিয়ে নেয়। টিকটিকি ঘটনা বুঝে ফেলে। কি করা যায় একটু চিন্তা করে হঠাৎ মেঝেতে লাফ দিয়ে কয়েকবার গড়াগড়ি দেয়। তাতেও তিশার মান ভাঙে না। টিকটিকি এবার চিৎ হয়ে লেজের মাথাটা মুখে পুরে বলের মত গোল হয়ে গড়াতে গড়াতে তিশার পায়ের কাছে এসে তিরিং বিরিং করতে থাকে। তিশা এবার ফিক করে হেসে উঠে। ‘হয়েছে। হয়েছে। আর কমিক দেখাতে হবে না। এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’
‘ভাইকে নিয়ে একটু ঘুরিয়ে গিয়েছিলাম।’ টিকটিকি জবাব দেয়।
‘তোমার ভাই আছে বুঝি?’
‘তোমাকে বলিনি বুঝি?’
‘নাতো। কখনো বলোনি।
‘এখন বলছি, আমরা দু’বোন এক ভাই। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাইটা সবার ছোট।’
‘ভাইকে একদিন সঙ্গে করে নিয়ে এসো। সবাই মিলে একসঙ্গে খেলবো।’
টিকটিকি বলে, ‘আচ্ছা, নিয়ে আসবো একদিন। এখন বলো কি খবর?’
‘একটা দারুন খবর আছে।’
‘ও মা তাই নাকি? খবরটা আগে বলবে তো?’
‘কি করে বলবো? সেই কখন থেকে বসে আছি, তোমার তো কোনো পাত্তাই নেই!’
‘সরি। ছোট ভাই হঠাৎ বেড়াবে আবদার করলো তাই।’
‘হয়েছে। হয়েছে। এবার শোন, কাল আব্বু-আম্মু তোমাদের অনেক প্রশংসা করলো।’
‘আমাদের প্রশংসা! কি রকম?’
‘তোমরা টিকটিকিরা নাকি আমাদের উপকারি বন্ধু।’
‘যেমন?’ টিকটিকি প্রশ্ন করে। তিশা বলে, ‘যেমন- তোমরা মানুষের ক্ষতি করছো না। বরং ক্ষতিকর মশা-মাছি, পোকা-মাকড় খেয়ে পরিবেশকে সুন্দর রাখছো। তাই আব্বু-আম্মু বলেছে, তোমরা টিকটিকিরা মানুষের উপকারি বন্ধু।’
‘আব্বু-আম্মুকে আমাদের বন্ধুত্বের কথা বলেছো নাকি?’ টিকটিকি আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়।
‘না। এখনো বলিনি। বলবো একদিন।’
‘আচ্ছা তা না হয় বলবে একদিন। এখন যাও, গোসল সেরে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাবে। বিকেলে এসে তোমার ঘুম ভাঙাবো।’ এই বলে টিকটিকি লেজ নাড়িয়ে চলে যায়। তিশা আর দেরি না করে স্কুল ড্রেস খুলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।
একদিন দুপুরে রিডিং রুমে বসে ছবি আঁকছিল তিশা। টিকটিকি দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে পোকা-মাকড় শিকারে ব্যস্ত। এমন সময় রুম পরিস্কার করতে আসে সুন্দরী। ঘরে কোণায় পুরানো ঝুলগুলো পরিস্কার করতে গিয়ে হঠাৎ আঘাত করে বসে টিকটিকির গায়ে। ঝাড়ুর আঘাতে টিকটিকির শরীর থেকে লেজ আলাদা হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। সুন্দরী আবারও আঘাত করতে যায় টিকটিকির গায়ে। ‘না’ বলে আর্তনাদ করে ওঠে তিশা। সুন্দরীর হাত থেকে ঝাড়ু কেড়ে নিয়ে তিশা বলে, ‘টিকটকিটাকে কেন মারছো! ও তোমার কি ক্ষতি করেছে? তুমি জানো, টিকটিকি আমাদের কত উপকারি বন্ধু?’
সুন্দরী হা করে তাকিয়ে থাকে তিশার মুখের দিকে। এদিকে টিকটিকির কাটা লেজটা সমানে লাফাতে থাকে। তিশা আলতুভাবে লেজটা কুড়িয়ে নেয়। তারপর টেবিলে পরে থাকা টিকটিকির শরীরের সঙ্গে লেজটা লাগিয়ে দেয়। আর ম্যাজিকের মত সঙ্গে সঙ্গে কাটা লেজটাও জোড়া লেগে যায়। আর অমনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে লেজ নাড়াতে নাড়াতে আবার দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে যায় টিকটিকিটা। তখন খুশিতে সুন্দরীকে জড়িয়ে ধরে তিশা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগন্ডামারায় ১ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সড়ক সংস্কার
পরবর্তী নিবন্ধপ্রকৃতির প্রতিশোধ