টানা ছয়দিন মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ

চট্টগ্রামে ১৫ বছরেও এমন রেকর্ড নেই গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন কাল রাতে বৃষ্টির সম্ভাবনা

মোরশেদ তালুকদার | মঙ্গলবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

নগরে গতকাল সোমবার পর্যন্ত টানা ছয়দিন মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। গত ১৫ বছরেও চট্টগ্রামে এমন টানা তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার রেকর্ড নেই আবহাওয়া অধিদপ্তরের। এছাড়া চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনের প্রতিদিনই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে শহরে, যা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পেরিয়েছে। ফলে বেশি তাপমাত্রার কারণে তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। এছাড়া বাতাসের গতিবেগ কম থাকায় তীব্র গরমের সাথে বাড়ছে অস্বস্তিও। প্রখর রোদ ও গরম দুইয়ের প্রভাবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে জনজীবন।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, সাধারণত এপ্রিল মাসে আবহাওয়ায় যে উত্তাপ থাকে তা বৃষ্টি হলে কমে যায়। কিন্তু এ মাসের ১৫ দিনে মাত্র একদিন বৃষ্টিপাত হয়েছে নগরে। ফলে কমছে না তাপমাত্রা। বাড়ছে গরম। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তারা বলছেন, আজ মঙ্গলবারও তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। তবে আগামীকাল বুধবার রাতে চট্টগ্রামের কোথাও কোথাও বৃষ্টিপাত হতে পারে। বৃষ্টি হলে কমে আসতে পারে তাপমাত্রাও।

এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, গরমের প্রভাবে জ্বর ও কাশিসহ নানা রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে লোকজন। এক্ষেত্রে শিশু ও বয়স্কদের আক্রান্তের হার বেশি। এছাড়া বড়দের হিট স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। তাই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ভাগ্যধন বড়ুয়া আজাদীকে বলেন, গরমের কারণে শিশুদের মধ্যে জ্বরকাশি একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, গরমের কারণে শিশুদের ঘাম হচ্ছে। ঘাম জমে থাকলে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে, কাশি হতে পারে। শিশুদের ঠাণ্ডা গরম কন্ট্রোল করতে হবে। বার বার ঘাম মুছে দিতে হবে। আবার ঘামের জন্য শরীর থেকে পানি বের হয়ে যায়। তাই পানি খাওয়ানোর ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী পানি খাওয়াতে হবে।

টানা ছয়দিন তাপপ্রবাহ : তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে তাকে তাপপ্রবাহ বলা হয়। এর মধ্যে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু এবং ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি, ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র এবং ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। এদিকে নগরে গত ১০ এপ্রিল থেকে গতকাল পর্যন্ত টানা ছয়দিন তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। অর্থাৎ এ সময়ে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে নগরে। এর মধ্যে একদিন মাঝারি এবং এবং বাকি পাঁচদিন ছিল মৃদু তাপপ্রবাহ। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ১১ এপ্রিল তাপমাত্রা ছিল ৩৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৭ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। অর্থাৎ ওইদিন মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। বাকি পাঁচদিনের মধ্যে গতকাল সোমবার তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। আগের দিন রোববার (১৪ এপ্রিল) ছিল ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এছাড়া ১৩ এপ্রিল ছিল ৩৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ১২ এপ্রিল ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এছাড়া ১০ এপ্রিল ছিল ৩৭ দশমিক ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এদিকে গতকাল সীতাকুণ্ডে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ সীতাকুৃণ্ডে গতকাল মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে।

স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা : চলতি এপ্রিল মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু চলতি মাসের প্রথম ছয়দিন তাপপ্রবাহ বয়ে গেলেও বাকি ৯ দিনও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে নগরে। ফলে এ সময়েও গরমে অস্থির ছিল নগরবাসী।

যেমন গত ৯ এপ্রিল তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এর আগে ৮ এপ্রিল ছিল ৩৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ৭ এপ্রিল ছিল ৩৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ৬ ও ৫ এপ্রিল ছিল ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ৪ এপ্রিল ছিল ৩২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ৩ এপ্রিল ছিল ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ দশমিক ৪ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ২ এপ্রিল ছিল ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে শূন্য দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ১ এপ্রিল ছিল ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

বৃষ্টিপাতও কম : এপ্রিল মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে ১৪৭ দশমিক ৪ মিলিমিটার। অথচ এ মাসে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে নগরে। গত ৮ এপ্রিল বিকেল ৩টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় এ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস।

অতিষ্ঠ নগরবাসী : আবহাওয়াবিদরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে নগরে গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে। তাছাড়া মেঘমুক্ত আকাশ থাকার ফলে সূর্যের তাপ বেশি অনুভূত হচ্ছে। এমনকি বাতাসের যে গতি থাকা দরকার, তা নেই। তাই গরম বেশি লাগছে। এদিকে তীব্র গরমের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন নগরবাসী। বিশেষ করে দিনমজুর ও পথচারীরা ভুগছেন বেশি। এছাড়া বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বাসাবাড়িতেও গরমে অস্থির হয়ে উঠছেন সবাই। এ চিত্র বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে গ্রামে।

কী বলছে আবহাওয়া অফিস : পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা ও আবহাওয়াবিদ আবদুল হাই আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামে টানা তাপপ্রবাহের রেকর্ড খুব কম। আমার জানা মতে চট্টগ্রাম শহরে গত ১৫ বছরেও এবারের মতো টানা তাপপ্রবাহ হওয়ার রেকর্ড নেই।

কয়েকদিনের মধ্যে তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা আছে কীনা জানতে চাইলে বলেন, পরশু (বুধবার) রাতে বৃষ্টি হতে পারে। এরপর তাপমাত্রা একটু কমতে পারে। বৃষ্টি শহরের মধ্যে না হলেও চট্টগ্রাম রেঞ্জের মধ্যে হতে পারে। টানা তাপপ্রবাহের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে। মধ্যপা্রচ্যে সাধারণত বৃষ্টিপাত হতো না। সেখানে রেকর্ড ভেঙে বন্যা হয়ে গেছে। একইভাবে চট্টগ্রামে টানা তাপ প্রবাহের রেকর্ড খুব কম। কিন্তু এবার হচ্ছে। তাই এটাই বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব বলা যায়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম জানান, আজ দেশের মধ্যে ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটে সামান্য বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। যেখানে বৃষ্টি হবে সেখানে তাপমাত্রা একটু কমতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যান্য এলাকায় তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে।

গত কয়েক বছর ধরে বাড়ছে তাপমাত্রা : গত কয়েক বছর ধরে বাড়ছে চট্টগ্রামের তাপমাত্রা। ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে কানাডার ক্যালগভরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের গবেষকদের সম্পৃক্ততায় পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে চট্টগ্রামে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে আসে। ভূউপগ্রহ থেকে দিনের ও রাতের তাপমাত্রার ধরন বিশ্লেষণ করে পরিচালিত ওই গবেষণায় দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ২০ বছরে চট্টগ্রামের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৯২ ডিগ্রি বেড়েছে।

ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের রাতের তাপমাত্রা রাতের ঢাকার তাপমাত্রার চেয়েও বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, বঙ্গোপসাগর থেকে রাতের বেলায় যে বায়ু চট্টগ্রাম শহরের উপর দিয়ে বয়ে যায় সেটি ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে। তাছাড়া এখানে দক্ষিণপশ্চিম মৌসুমি বায়ু দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এবং পাহাড় কাটায় আগের মতো বৃষ্টিপাত না হওয়াকেও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ বলা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআ.লীগ নেতাকে সেবা দিতে দেরির অভিযোগ, চিকিৎসককে মারধর
পরবর্তী নিবন্ধআগুনে পুড়ে ছাই কারো বই, কারো মেয়ের বিয়ের টাকা