জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ

সূরা হুমাযাহ’র তাৎপর্য ও শিক্ষা

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহর আযাবকে ভয় করুন। প্রতিদান দিবসে কর্মফলের কথা চিন্তা করুন। পরনিন্দা, কুৎসা রটনা ও মানুষকে অসম্মান করার মনোবৃত্তি ও ঘৃণ্য মানসিকতা পরিহার করুন। জেনে রাখুন! মানবতাবোধ, সম্মানবোধ ও উত্তম আচরণ, উৎকৃষ্ট মানসিকতার পরিচায়ক, অসদাচরন এক ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট স্বভাব যা সর্বদা পরিত্যজ্য।
সূরা হুমাযাহ প্রসঙ্গ: মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ১০৪ তম “সূরা হুমাযাহ” মক্কী সূরা হিসেবে গণ্য। এতে রুকু সংখ্যা এক, আয়াত সংখ্যা নয়, শব্দ সংখ্যা ত্রিশ, বর্ণ একশ বত্রিশটি।
আনুবাদ: ১. ধ্বংশ ঐ ব্যক্তির জন্য যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে, ২. যে ব্যক্তি সম্পদ সঞ্চয় করেছে এবং গুণে গুণে রেখেছে, ৩. সে কি একথা মনে করে যে, তার সম্পদ তাকে পৃথিবীতে অমর করে রাখবে, ৪. কখনো না অবশ্যই সে চুর্ণ বিচুর্ণকারী আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে, ৫. তুমি কি জানো চুর্ণ বিচুর্ণকারী আগুন কি? ৬. আল্লাহ তা’আলার আগুন যা প্রজ্বলিত হচ্ছে, ৭. যা (মানুষের) অন্তর সমূহের উপর সমুদিত হবে, ৮. নিশ্চয় ওটা তাদের উপর বন্ধ করে দেয়া হবে, ৯. দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে;
সূরার আলোচ্য সূচি: ১. সম্মুখে ও অগোচরে পরনিন্দা, কুৎসা রটনাকারীদের শাস্তির আলোচনা, ২. হুতামা জাহান্নামের শোচনীয় বর্ণনা, ৩. প্রজ্বলিত হুতাশন ভীতিপ্রদ আগুনের বর্ণনা, ৪. সম্পদ পুঞ্জিভূতকারীদের কঠোর হুশিয়ারী, ৫. একাধিক শব্দে তাশদীদ ব্যবহার দ্বারা আযাবের কঠোরতা ও নির্মমতার বর্ণনা।
সূরার শানে নুযুল: সূরাটি প্রসিদ্ধ কাফির আখনাস ইবনে শুরায়ক, ওমাইয়া ইবনে খালাফ ও ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা প্রমূখ কাফিরদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। এসব কুলাঙ্গার কাফিররা সর্বদা সৈয়্যদুল মুরসালীন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও প্রিয় রাসূলের সম্মানিত সাহাবীদের বিরুদ্ধে গীবত সমালোচনা কুৎসা রটনা ও ধৃষ্ঠতাপূর্ণ অসম্মানজনক কথাবার্তা বলে বেড়াতো, তাদের এহেন ঘৃণ্য নিকৃষ্ট আচরণের প্রতিবাদে আল্লাহ তা’আলা উপরোক্ত সূরা নাযিল করেন। কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক গীবতকারী, চোগলখোর ও কুৎসারটনাকারী ঘৃণিত ব্যক্তিদের জন্য উপরোক্ত আয়াত সমূহের বিধান সমভাবে প্রযোজ্য। (তাফসীর খাযাইনুল ইরফান, কৃত: সদরুল আফাযিল সৈয়দ নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী (র.), তাফসীরে ফুয়জুর রহমান, কৃত: আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়েসী, পারা: ৩০, পৃ: ১০৩১)
হুমাযাহ ও লুমাযা অর্থ: সামনা সামনি সম্মুখ নিন্দা করাকে হুমাযাহ বলা হয়, অগোচরে পশ্চাতে আড়ালে নিন্দা করাকে লুমাযা বলে। হযরত কাতাদা (রা.)’র বর্ণনা মতে মুখের ভাষায়, মন্দ কথায় চোখের ইংগিতে গীবত করা, অপবাদ দেয়া, অংগ ভঙ্গি দ্বারা উপহাস করাকে হুমাযাহ বলে, হযরত মুজাহিদ (র.)’র বর্ণনা মতে হুমাযাহ এর সম্পর্ক হাত ও চোখের সঙ্গে, আর লুমাযা’র সম্পর্কে জিহবার সঙ্গে। মানুষের ইজ্জ্বত সম্মান নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা, কথায় ও ইঙ্গিতে মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, তিনি আরো বলেন, এ ধরনের ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী সকলেই আয়াতের বিধানের অন্তর্ভূক্ত। আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে অকল্পনীয় ভীতিপ্রদ শাস্তি।
অঢেল সম্পদ পুঞ্জিভূতকারীদের জন্য কঠোর হুশিয়ারী: অর্থলোভী, পুজিপতি, শিল্পপতি, ভোগ বিলাসী, সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গ যারা আল্লাহর দেয়া সম্পদের হক আদায় করেনা, আল্লাহর বিধান মোতাবেক সঠিকভাবে যাকাত আদায় করেনা সমাজের দরিদ্র, নি:স্ব, ফকীর মিসকীন, অনাথ অবহেলিত, অধিকার বঞ্চিত অসহায় মানুষকে তাদের স্বার্থ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেশ ও জাতির কল্যাণ উন্নতি ও অগ্রগতির কথা চিন্তা করেনা। সম্পদের উপর সম্পদ সঞ্চয় করে, সম্পদের প্রকৃত মালিক মহান প্রভূ আল্লাহকে ভুলে বসেছে। তাদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ও কঠোর হুঁশিয়ারী। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনাহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছে, কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি। কিয়ামতের দিন ঐ ধন সম্পদ এমন বিষধর সর্পে পরিণত হবে। যার মাথার উপর থাকবে দু’টি কালো দাগ। সর্প তার গলায় পেঁছিয়ে দেয়া হবে। সর্প তার গলায় ঝুলে দু’চোয়ালে কামড়াতে থাকবে এবং বলবে আমি তোমার মাল আমি তোমার সঞ্চিত সম্পদ। (বুখারী শরীফ)
হুতামা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে: দোজখ সাতটি ১. জাহান্নাম, ২. হাবিয়াহ, ৩. জাহীম, ৪. সাক্বার, ৫. সায়ীর, ৬. হুতামা, ৭. লাযা। প্রখ্যাত তাফসীরকার আল্লামা ইসমাঈল ইবনে কাসীর (র.)’র বর্ণনা মতে হুতামা জাহান্নামের একটি স্তরের নাম। বিপুল সম্পদ সঞ্চয়কারীকে হুতামায় নিক্ষেপ করা হবে। জাহান্নামের ঐ স্তরে জাহান্নামের প্রজ্বলিত আগুন হাড় ও পাজরগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলবে। (তাফসীরে খাযাইনুল ইরফান, তাফসীরে ইবনে কাসীর, একাদশ খন্ড, পৃ: ৫৯০)
হযরত সাবিত বুনানী (রা.) বর্ণনা করেন, জাহান্নামের অগ্নি তাদের হৃদয় গ্রাস করবে। বরং এ আগুনকে তার উপর আবদ্ধ করে দেয়া হবে। তাদের কষ্টের ও যন্ত্রনার সীমা থাকবেনা। জাহান্নামীরা অনন্তকাল জাহান্নামে জ্বলতে থাকবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, জাহান্নামের আগুনকে হাজার বছর পর্যন্ত প্রজ্বলিত রাখা হয়েছে, এ পর্যায়ে তা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। পূনরায় হাজার বছর প্রজ্বলিত করা হয়েছে, অবশেষে তা শ্বেত বর্ণ ধারণ করেছে। শেষ পর্যন্ত কালো রং ধারণ করেছে। অবশেষে তা প্রচন্ড অন্ধকারে পরিণত হয়েছে। (তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, পারা-৩০, পৃ: ১০৪১)
হাদীস শরীফের আলোকে পরনিন্দা (গীবত) কবীরা গুনাহ: গীবত আরবী শব্দ, কারো অনুপস্থিতে তার কুৎসা রটনা করা, অন্যের দোষ ত্রুটি প্রকাশ করা, এটি একটি সামাজিক ব্যাধি, জগন্যতম অপরাধ। ইসলামে এটি কঠোরভাবে হারাম করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু সাঈদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, গীবত হলো ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্নক। সাহাবারা বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ গীবত কি করে ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্বক? নবীজি বললেন, কোন ব্যক্তি যদি ব্যভিচার করার পর তাওবা করে আল্লাহ তার তাওবাহ কবুল করেন কিন্তু গীবতকারীকে যার গীবত করা হয়েছে সে ক্ষমা না করা পর্যন্ত আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। (বায়হাকী শরীফ : ৬৩১৫)
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তোমরা ধারণা থেকে বেচে থাকো। কারণ ধারনা বড় মিথ্যা ব্যাপার। তোমরা কারো দোষ ত্রুটি অনুসন্ধান করোনা, গোয়েন্দাগিরি করোনা, একে অন্যের সাথে প্রতারণা করোনা, পরস্পর হিংসা করোনা, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করোনা, পিছনে লেগে থেকোনা। সকলে আল্লাহর বান্দা ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাও। (বুখারী শরীফ: ৬০৬৬)
হে আল্লাহ আমাদেরকে আপনার মকবুল বান্দাদের পথে পরিচালিত করুন। সকল প্রকার গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা পরিহার করার তাওফিক দান করুন। উন্নত নৈতিকতা ও চারিত্রিক গুণাবলী আমাদের নসীব করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন
রিজার্ভ বাজার পার্বত্য জেলা, রাঙামাটি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবরার হত্যার রায় : একটি পর্যালোচনা
পরবর্তী নিবন্ধঅরুণ দাশগুপ্ত : জ্ঞানে পাণ্ডিত্যে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব