আবরার হত্যার রায় : একটি পর্যালোচনা

মুহাম্মদ মুসা খান | শুক্রবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার রায় দিয়েছে আদালত। রায়ে ২০ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন মাননীয় আদালত। উল্লেখ্য ২০১৯ সনের ৭ অক্টোবর বুয়েটের হোস্টেলে আবরারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্ররা সন্দেহ বশতঃ পিটিয়ে হত্যা করে। আবরার হত্যার রায় নিয়ে দেশের প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষ ফেসবুকে-টকশোতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, তাঁরা মনে করেন,‘ন্যায় বিচার’ হয়েছে। অন্যদিকে ৫% মানুষের প্রশ্ন-০১ জন আবরারের জন্য এত জনের ফাঁসি/যাবজ্জীবন কেন! প্রশ্নকারীদের কেউ কেউ বলছেন, মৃত্যুদণ্ড সমাধান নয়। আসামিদের আইনজীবী বলেছেন, তাঁরা রায়ে সন্তুষ্ট নন, কারণ আবরার মারা যাবে-আসামীরা জানতো না। অর্থাৎ হত্যার উদ্দেশ্যে আবরারকে পিটানো হয়নি বা এটা পরিকল্পিত হত্যা নয়। এটা ৩০২ ধারার মামলা নয়। সুতরাং মৃত্যুদণ্ড তাদের প্রাপ্য নয়। আইনজীবীরা বলেন,তাঁরা উচ্চ আদালতে যাবেন। কিন্তু দেশের খ্যাতনামা আইনজ্ঞদের অভিমত, আবরার হত্যা – একটা ক্লিন মার্ডার। ঘুমন্ত ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে ২৫/৩০ জন মিলে ৬ ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছিল। অথচ তাঁর যদি কোনো অপরাধ থাকে, তাহলে তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা যেতো। কিন্তু ‘পুলিশের কাছে দিলে ছাড়া পাবে’ মনে করে- তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। (তাকে বুয়েট হতে তাড়িয়ে দেয়ারও সুযোগ (?) ছিল। সেটাও করা হয়নি)। তাঁকে যখন রুমের ভিতরে পিটানো হচ্ছিল তখন খবর পেয়ে পুলিশ ক্যাম্পাসে আসে। কিন্তু তাঁদের হল-এ ঢুকতে দেয়নি আসামিরা। সে সময় তাঁকে উদ্ধার করা গেলে বা চিকিৎসা করা গেলে হয়তো সে বেঁচে যেতো। কিন্তু খুনিরা এতটাই হিংস্র ও বেপরোয়া ছিলো যে, মৃত্যু নিশ্চিত না করে তাঁরা তাঁকে ছেড়ে দেয়নি।
এমন নির্মমতার পরিচয়দানকারি খুনিদের জন্য কেন আমাদের মায়া কান্না! আমরা কেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভূগছি যে, এত গুলো ছেলেকে কেন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো! আমাদের চিন্তা করা উচিত যে, এরা খুনের সাথে সরাসরি যুক্ত। সুতরাং সঠিক বিচারই হয়েছে। এই খুনিরা যদি বেঁচে যায়, আগামীতে আরও বেপরোয়া হবে, আরও মানুষ খুনের নেশায় মেতে উঠবে – যা নিশ্চিত। আমরা কি খুনিদের কাছে জিম্মি হওয়া বাংলাদেশ দেখতে চাই! ৩০ লাখ শহীদ এজন্যই কি জীবন দিয়েছিলেন! জাতির জনক বংগবন্ধু কি এমন দেশ চেয়েছিলেন! নিশ্চয় নয়। তাহলে আমরা কেন খুনিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে মানসিক চাপে থাকবো! অনেকে বলেন, এরা মেধাবী। হাঁ, এরা মেধাবী। কিন্তু আবরারও মেধাবী ছিল। আর, রক্তের নেশায় উন্মুখ থাকা এসব মেধাবীরা দেশের কী কাজে আসবে!
একথা সঠিক যে, পৃথিবীর অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড নেই। কিন্তু সেসব দেশে অপরাধও আমাদের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। অনেক উন্নত দেশে বছরে একটি খুনের ঘটনা নেই। আর আমাদের এখানে দৈনিক ৮/১০জন খুন হয় এবং প্রায় ১৭ জন নারী ধর্ষিতা হোন (গত ২ বছরের পরিসংখ্যান)। চুরি-ডাকাতি তো নৈমিত্তিক বিষয়। মূলত ‘ছোট্ট দেশে’ অধিক জনসংখ্যা এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সুতরাং অন্য উন্নত দেশের উদাহরণ দিয়ে এদেশের খুনি/অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড মওকুফের কথা বলা মানে-খুন/অপরাধকে উৎসাহিত করা। একটু লক্ষ্য করলে আমরা বুঝতে পারব যে, আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত চাঁদাবাজি, টেণ্ডারবাজি, হল দখল-পৃথিবীর সভ্য/উন্নত দেশ সমূহে নেই। ছাত্র সংঘর্ষের জন্য উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয় না। সেখানে র‌্যাগিং এর নামে নির্যাতন হয় না। পৃথিবীর সভ্য দেশে চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্র নেতাদের দল হতে বহিষ্কার করার নজির নেই। (সেখানে আমাদের মত ছাত্র রাজনীতিও নাই)। সুতরাং তাদের সাথে আমাদের তুলনা ‘নেহায়াতই মূর্খতা’। আমাদেরকে তুলনা করতে হবে আমাদের দেশের অপরাধের পরিসংখ্যানের সাথে। তবেই আমরা বুঝতে পারবো যে, কেন খুনের বিচারে মৃত্যুদণ্ড প্রয়োজন।
আমরা জানি, অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে। থানার ওসি সাহেবরা সারারাত অপরাধি ধরার কাজ করে সকালে ঘুমাতে যান। র‌্যাবেরও একই চিত্র। (একবার আমি নিজে র‌্যাবের সাথে সারারাত জেগে মাদক চোরাচালানি ধরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম)। শিক্ষাঙ্গন গুলোতে প্রায়শই ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
দেশের এরূপ পরিস্থিতিতে যেকোনো অপরাধের বিচারে শিথিলতা করা হলে, অপরাধ আরও বাড়বে। আর খুনের অপরাধের বিচারের অনুকম্পা দেখানোর তো প্রশ্নই আসে না। আমরা যদি অপরাধের বিচারে শিথিলতা দেখাই তাহলে আমরা অসভ্য দেশে পরিণত হবো। (এমনিতে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে আমাদের হতাশা আছে। বলা হয়, জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড)। আজকের বাংলাদেশের এসিড সন্ত্রাস বন্ধ হয়েছে কঠোর আইন প্রয়োগের জন্য। জঙ্গী তৎপরতা বন্ধ হয়েছে কঠোর আইন প্রয়োগের জন্য। মাদক মামলা কমেছে ক্রসফায়ারের জন্য। এসব মিথ্যা নয়, বাস্তব সত্য। সুতরাং এটা প্রমাণিত যে, আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া আমাদের মত ‘জনবহুল অপরাধ প্রবণ’ দেশে অপরাধ বন্ধ হবে না।
তাই আইনের লম্বা হাতকে আরও শক্তিশালী করার জন্য এবং আইন প্রয়োগে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়ার জন্য -‘আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি’ বাহিনীকে উৎসাহ এবং সাপোর্ট দেয়া আমাদের সকলের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। এবং আমাদের সকলের উচিত, দেশকে অপরাধ মুক্ত করার জন্য বিচার বিভাগের ‘ন্যায় বিচারের’ প্রশংসা করা। (এব্যাপারে রাজনীতির উর্ধ্বে উঠা খুবই জরুরি)। সকলের আন্তরিক সহায়তায় দেশ অপরাধ মুক্ত হোক, এটাই আমাদের কাম্য। আমাদের স্লোগান হোক, ‘অপরাধ মুক্ত ন্যায় বিচারের বাংলাদেশ’।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅদম্য মেধাবীরা ক্রিমিনাল হিসেবে কেউ আসেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা