জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৪ মার্চ, ২০২৩ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

রহমত, বরকত ও নাজাতের মাস রমজানুল মুবারক

 

 

পবিত্র কুরআনের আলোকে সিয়ামের গুরুত্ব: ইসলামে সিয়াম সাধনার ধর্মীয় ও আধ্যাত্নিক গুরুত্ব অপরিসীম। তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনের প্রত্যয়ে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য মাস ব্যাপী ট্রেনিং কোর্সের নাম রমজানুল মুবারক। আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালনা করার সামগ্রিক নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণের মাসই সিয়াম সাধনা।

 

আল্লাহ তা’আলা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সূরা: বাক্বারা: ১৮৩)

রোজা পূর্ববর্তী উম্মতদের উপরও ফরজ ছিল: হযরত আদম আলাইহিস সালাম প্রতি মাসের ১৩,১৪, ১৫ তারিখে রোজা পালন করতেন, হযরত নুহ আলাইহিস সালাম সারা বৎসর রোজা রাখতেন। হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম একদিন পরপর রোজা রাখতেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম দুই দিন পর পর একদিন রোজা রাখতেন। (তাফসীরে আজিজি, খন্ড: , পৃ: ৬৩৯)

হাদীস শরীফের আলোকে রোজার ফযীলত: পবিত্র রমজান আল্লাহর অবারিত রহমতের বারিধারায় স্নিগ্ধ এ মাস বিশ্ববাসীর জন্য অফুরন্ত কল্যাণ মুক্তি ও সাফল্যের মাস। এ মাসের প্রতিটি মূহুর্ত রহমতের ঝর্ণাধারায় দ্বীনি চেতনায় উদ্ভাসিত। এ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, নিম্নে কয়েকটি হাদীস শরীফ উপস্থাপন করা হলো।

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের নিকট রমজান সমাগত। এটি অতীব বরকতময় মাস আল্লাহ তা’আলা এ মাসে তোমাদের উপর রোযা ফরজ করেছেন, এ মাসে তোমাদের উপর রোযা ফরজ

করেছেন, এ মাসে আসমানের দরজা সমূহ উন্মুক্ত হয়ে যায়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে অবাধ্য শয়তানদের আটক করে রাখা হয়। এ মাসে একটি রজনী আছে যা হাজার মাসের চেয়েও অনেক উত্তম। যে লোক এ রজনীর কল্যাণ হতে বঞ্চিত হলো সে সত্যই বঞ্চিত হলো। (নাসায়ী, হাদীস: ২১০৬)

প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব দশ থেকে সাত’শ গুণ: এ মাসের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব অপরিসীম। হাদীস শরীফে প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব দশগুণ

হতে সাত’শ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, রোযা এর ব্যাতীক্রম, কেননা রোযা একান্তভাবে আমারই জন্য অতএব আমিই এর প্রতিদান দিব। রোজাদার আমারই সন্তুষ্টি লাভের জন্য স্বীয় প্রবৃত্তি পরিত্যাগ করে থাকে। রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে একটি ইফতারের সময় অন্যটি তার প্রভূ আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভের সময়। নিশ্চয়ই জেনে রাখো রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের চেয়েও সুগন্ধিময়। (বুখারী, মুসলিম)

রমজানের প্রতিটি ভাল কাজই ইবাদত: রমজান এমন তাৎপর্যপূর্ণ বরকতময় মাস এর প্রতিটি দিন ও রাত ইবাদতে বেষ্ঠিত, রোজা ইবাদত, ইফতার ইবাদত, তারাবীহ ইবাদত, তারবীহ আদায়ের পর নিদ্রা যাওয়া ইবাদত। সেহেরী খাওয়া ইবাদত, পবিত্র কুরআনুল করীমের তিলাওয়াত ইবাদত। (তাফসীরে নঈমী, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: , পৃ: ২২)

রমজান ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে: হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রোজা ও কুরআন রোজাদার বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে হে আল্লাহ! আমি এ ব্যক্তিকে দিনের

বেলা পানাহার ও কামনা বাসনা থেকে বিরত রেখেছি। আপনি তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে হে আল্লাহ! আমি এ ব্যক্তিকে রাতের বেলা নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। আপনি তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। আল্লাহ তা’আলা তাদের সুপারিশ কবুল করবেন। (মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, খন্ড: , পৃ: ৫৮৬)

রোজাদারের জন্য পাঁচটি পুরস্কার:

রমজান আরবি শব্দটি পাঁচটি বর্ণের সমষ্টি, রা, মীম, দ্বোয়াদ, আলিফ, নূন, প্রতিটি বর্ণ অর্থ জ্ঞাপক, “রা” দ্বারা আল্লাহর রহমত, “মীম” দ্বারা মহব্বত আল্লাহর ভালোবাসা “দ্বোয়াদ” দ্বারা যিমানে এলাহী আল্লাহর বদান্যতা, নূন দ্বারা আল্লাহর নূরএর প্রতি ইঙ্গিতবহ, যে ব্যক্তি পবিত্র রমজানে ১. রোজা, . তারাবীহ, .

তিলাওয়াতে কুরআন, . ইতিকাফ, . শবে কদরের ইবাদতসহ একাগ্রচিত্তে এ পাঁচটি ইবাদত করবে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে উপরোক্ত পাঁচটি পুরস্কারে ধন্য করবেন। (তাফসীরে নঈমী, খন্ড: , পৃ: ২০৮)

রমজান মাসে নবীজির দান সাদকা: প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, যখন রমজান মাসের আগমন হতো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক কয়েদীকে মুক্ত করে দিতেন এবং প্রত্যেক ভিক্ষুক কে দান করতেন। (শুয়াবুল ঈমান, খন্ড:পৃ: ৩১১, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: , পৃ: ২৩)

রমজান মাসের একটি নফল ইবাদত অন্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমতুল্য:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো সুন্নাত বা নফল ইবাদত করবে তাকে অন্যমাসে আদায়কৃত ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো ফরজ ইবাদত করবে সে অন্য মাসে কোনো ফরজ ইবাদত করবে সে অন্যমাসে আদায়কৃত সত্তরটি ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবে। (বায়হাকী)

ইচ্ছাকৃত রোযা না রাখার পরিণাম:

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি শরয়ী কারণ ছাড়া এবং রোগাক্রান্ত হওয়া ছাড়া রোজা রাখেনি তবে যুগ যুগ যাবৎ রোযা রাখলেও এর কাযা আদায় হবেনা। যদিও বা পরবর্তীতে রেখেও নেয়। (বুখারী, হাদীস : ৭২৩)

পরবর্তীতে রোযা রাখলেও রমজানুল মুবারকের রোযা রাখার যে ফযীলত নির্ধারিত ছিলো তা পাওয়া যাবেনা। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ১ম, পৃ: ৯৮৫)

রোযা হচ্ছে শরীরের যাকাত:

প্রতিটি বস্তুর যাকাত রয়েছে শরীরের যাকাত হচ্ছে রোজা রাখা। রোজা হচ্ছে ধৈর্যের অর্ধেক। (ইবনে মাযাহ, হাদীস: ১৭৪৫)

রমজান মাসে তাসবীহ আদায়ে হাজার গুণ সওয়াব:

রমজানের রোযা ও তাসবীহ তাহলীল এবং নেক আমলের সওয়াব হাজার গুণ বেশী। এ প্রসঙ্গে বুজুর্গানে দ্বীনের আমলের বর্ণনা রয়েছে, হযরত ইব্রাহীম নাখয়ী () বর্ণনা করেন, রমজান মাসে এক দিন রোজা রাখা, হাজার দিনের রোজা অপেক্ষা উত্তম। রমজান মাসে একবার তাসবীহ (সুবহানাল্লা, আলহামদুলিল্লাহ) পাঠ করা এক হাজার বার তাসবীহ পাঠ করার চেয়ে উত্তম। রমজানে এক রাকাত নামায অন্য মাসের হাজার রাকাতের চেয়ে উত্তম। (তাফসীরে দুররে মনসুর, ১ম খন্ড, পৃ: ৪৫৪)

রমজানে অধিক পরিমাণ নেকী অর্জন করুন:

পবিত্র রমজান তাকওয়া অর্জনের মাস, এ মাসে অধিক পরিমাণ তাওবা এস্তেগফার করুন। অধিক পরিমাণ কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অধিক পরিমাণ দরুদ শরীফ পাঠ করুন। সামর্থ অনুপাতে অসহায় দরিদ্র ফকির মিসকীন কে মুক্ত হস্তে দান করুন।

সমাজের অনাথ এতিম দুস্থ অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে আসুন। যাকাত ফিতরা সঠিকভাবে আদায় করুন। রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করুন। সকল প্রকার অন্যায় পাপাচার মিথ্যাচার অশ্লীলতা ও শরীয়ত বিরোধী অনৈসলামিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকুন, তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনে আত্ম নিয়োগ করুন।

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহিমান্বিত বরকতময় মাস রমজানুল মুবারকের আদর্শ ও শিক্ষা আমল করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম, খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

আখতারুজ্জামান সোহেল

বাহুলী, পটিয়া, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: ইসলামের দৃষ্টিতে কুকুর পোষা বা পালন করা জায়েজ কিনা? জানালে কৃতার্থ হব।

উত্তর: গরু, ছাগলভেড়া ইত্যাদি প্রাণীর হেফাজতের জন্য, ক্ষেত ও জমির ফসল হেফাজতের জন্য, ঘর বাড়ী দোকান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পাহারার জন্য অথবা শিকার করার জন্য কুকুর পোষা জায়েজ। বর্ণিত উদ্দেশ্য ছাড়া কুকুর পালন করা জায়েজ নয়। তবে যে সব কারণে কুকুর পালন করা জায়েজ সে ক্ষেত্রেও কুকুরকে ঘরের ভেতরে রাখা যাবে না। তবে চোর ডাকাত বা শত্রুর ভয় ভীতির আশঙ্কা থাকলে তখন ঘরের ভেতরে রাখা জায়েজ। (ফতহুল কাদীর, বাহারে শরীয়ত, একাদশ খন্ড, পৃ: ১৬৮, ১৬৯, ফতোওয়ায়ে আলমগীরি, খন্ড: , পৃ: ২৪২)

বোখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, গবাদি পশু পাহারা দেয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া শখ করে ঘরে কুকুর রাখা, পালন করা, ইসলাম অনুমোদন করে না। শখ করে কুকুর পোষা ও ঘরে রাখার কারণে প্রতিদিন ওই ব্যক্তির দুই কিরাত পরিমান নেকী কমে যাবে। (মুসলিম, হাদীস: ১৫৭৫)

এক কিরাত হলো ওহুদ পাহাড়ের সম পরিমাণ। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ৪৬৫০, বাহারে শরীয়ত: ১৬৮)

পূর্ববর্তী নিবন্ধফারুক হাসান : অকালে ঝরে পড়া বিশাল প্রতিভা
পরবর্তী নিবন্ধআহ্‌লান সাহ্‌লান মাহে রমজান