আহ্লান সাহ্লান মোবারক হো মাহে রমজান। মাহে রমজান উম্মাতে মুহাম্মাদী (সা.)-এর জন্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর প্রতিশ্রুত বেহেশত লাভের সওগাত। রমজান মাসের রোজা মানব জীবনের পূত পবিত্র এবং সুন্দর করে জীবন গড়ার একটি কার্যকরী পন্থা। এ মাহে রমজানে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন
নাজিল করেছেন। তাই এ মাসের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য অপরিসীম। রমজানে রোজা মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং সংযম শিক্ষা দেয়। পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ রমজানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘এটি এমন এক মাস এর প্রথম দশ দিন রহমতের ঝর্ণাধারায় পরিপূর্ণ।
দ্বিতীয় দশ দিন ক্ষমা ও মার্জনার জন্যে এবং শেষ দশ দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও নিষ্কৃতি লাভের উপায়রূপে নির্ধারিত। যে ব্যক্তি এ মাসে নিজের অধীনস্থ লোকদের শ্রম হালকা করে দেবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন।’ অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমার উম্মত যদি মাহে রমজানের গুরুত্ব বুঝতো, তাহলে সারা বছর রমজান কামনা করতো।’
রোজা ফার্সি শব্দ। অর্থ উপবাস। রোজার আরবি শব্দ হচ্ছে ‘সাওম’। আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায়– আল্লাহ্ তায়ালার নির্দেশ পালনার্থে সুব্হি সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে ‘সাওম’।
এ রমজানে সিয়াম পালনের তাগিদ দিয়ে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন– ‘রমজান মাস, যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াতের জন্য এবং হিদায়াতের সুসপষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য–মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাস পায় সে যেনো রোজা পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে
অথবা সফরে থাকবে তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান এবং কঠিন করতে চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করো এবং তিনি তোমাদের যে হিদায়ত দিয়েছেন, তার জন্যে আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা
আল–বাকারা, আয়াত– ১৮৫) যে ব্যক্তি রমজান মাসে রোজা পালন করবে, আল্লাহ্ তায়ালা তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন– ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’-(সহিহ আল–বুখারি, হাদিস নং– ১৯০১)
রোজার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন– ‘আস–সাওমু জুন্নাতুন’ অর্থাৎ, রোজা ঢাল স্বরূপ। -(সুনান ইব্ন মাজাহ, হাদিস নং– ১৬৩৯) রোজাকে ঢাল বলার কারণ হচ্ছে, যুদ্ধে ঢাল যেমন তলোয়ার, তীর ও বল্লম থেকে যোদ্ধাকে হেফাজত করে; তেমনি রোজাও রোজাদারকে গুনাহের
কাজ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে। আর রাসুলুল্লাহ (সা.) সাওমের গুরুত্বে আরো বলেছেন, আল্লাহ্ নিজ হাতেই এর প্রতিদান দেবেন। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন– ‘আদম সন্তানের প্রতিটি ভালো আমল দশ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত
বৃদ্ধি করা হয়। মহান আল্লাহ্ বলেন, তবে রোজা ব্যতীত। কেননা তা আমার জন্য, আমি নিজ হাতেই এর প্রতিদান দেবো। সে তো তার প্রবৃত্তি ও পানাহার আমার জন্যই বর্জন করেছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং– ২৭০৭)
রোজাদারগণকে আল্লাহ্ তায়ালা বিশাল সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, হজরত সাহ্ল (রা.) হতে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেছেন– ‘জান্নাতে এমন একটি দরজা আছে যার নাম হলো রাইয়ান। কিয়ামাতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল রোজাদার ব্যক্তিগণই প্রবেশ করতে পারবে, অন্যরা কেউ এ দরজা দিয়ে
প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে– রোজাদারগণ কোথায়? তারা ছাড়া কেউ এতে প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর যখন রোজাদারগণ সেখানে প্রবেশ করবে, তখন তার দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে কেউ এতে প্রবেশ করতে না পারে।’ -(সহিহ আল–বুখারি, হাদিস নং– ১৮৯৬) মানুষ যখন রোজা রাখে,
সারাদিন উপবাস থাকার কারণে মানুষের মুখে দুর্গন্ধ হয়। এ দুর্গন্ধ আল্লাহ্র কাছে খুবই পছন্দনীয়। এ দুর্গন্ধ আল্লাহ্র কাছে মিস্কের সুগন্ধির চেয়েও খুশবো। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন– ‘সে সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন। রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ্র নিকট মিস্কের সুগন্ধির চেয়েও বেশি সুগন্ধিযুক্ত।’ -(সহিহ আল–বুখারি, হাদিস নং– ১৯০৪)
আমরা যে রোজা পালন করছি, আমাদের জন্য কতইনা সৌভাগ্যের। এ রোজা কিয়ামতের দিন আমাদের জন্য সুপারিশ করবে। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইব্ন আমর (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন– ‘রোজা ও কুরআন বান্দার জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রোজা বলবে– হে রব!
আমি তাকে পানীয় ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আল–কুরআন বলবে– আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি (সে আমাকে তিলাওয়াত করেছে)। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অতঃপর তাদের
উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ -(মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং–৬৬২৬) রোজাদারগণ রোজার কারণে পিপাসার্ত থাকেন। পিপাসার্তগণকে আল্লাহ্ তায়ালা কিয়ামতের দিন পানি পান করাবেন। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় বরকতময় মহান আল্লাহ্ নিজের
ওপর বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন, যে বান্দা তার জন্য গ্রীষ্মকালে (রোজার কারণে) পিপাসার্ত থেকেছে, তিনি তাকে পিপাসার্তের দিন (কিয়ামতের দিন) পানি পান করাবেন।’ -(মুসনাদ আল–বাজ্জার, হাদিস নং– ৪৯৭৪)
আমাদের কাছে রমজান মাস এসেছে। এ মাসে যদি আমরা আল্লাহ্র কাছে গুনাহ মাফ করাতে না পারি তাহলে আমাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কে হতে পারে? হাদিসের মধ্যে এসেছে, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিগণকে বললেন– ‘তোমরা মিম্বরের কাছে এসো। তখন সাহাবিগণ মিম্বরের কাছে আসলেন। তারপর
রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলেন। অতঃপর বললেন– আমিন। এরপর দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন। তখন বললেন– আমিন। তারপর তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন। তখনও বললেন– আমিন। যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) খুতবা ও বয়ান শেষ করে মিম্বর থেকে নামলেন তখন সাহাবিগণ বললেন– হে আল্লাহ্র
রাসুল (সা.)! আমরা আপনাকে মিম্বরে ওঠার সময় কিছু বলতে শুনেছি, যা আগে কখনও শুনিনি। উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এইমাত্র জিবরাইল (আ.) আমার কাছে এসেছিলেন। আমি যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখি, তখন তিনি বললেন– ধ্বংস হউক ঐ ব্যক্তি, যে রমজান মাস পেলো; কিন্তু তার গুনাহ মাফ
করাতে পারলো না। তখন আমি বললাম– আমিন। যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন জিবরাইল (আ.) বললেন– ধ্বংস হউক ঐ ব্যক্তি, যে ব্যক্তি আপনার নাম উচ্চারণ করে; কিন্তু সে আপনার ওপর দরুদ পাঠ করে না। তখন আমি বললাম– আমিন। যখন তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন জিবরাইল (আ.)
বললেন, ধ্বংস হউক ঐ ব্যক্তি; যে পিতা–মাতা উভয়কে অথবা তাদের কোনো একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেলো; কিন্তু তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালো না তখন আমি বললাম– আমিন।’ -(সুনান আল–কুবরা, হাদিস নং– ৮৫০৪)
রোজাদারদের জন্যে দু’টি আনন্দ রয়েছে। হাদিসের মধ্যে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন– ‘রোজাদারদের জন্য আনন্দের সময় হলো দু’টি। ১. যখন সে ইফতার করে তখন সে ইফতারের আনন্দ পায়। ২. যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে তখন তার রোজার কারণে আনন্দিত হবে।’ -(সহিহ আল–বুখারি, হাদিস নং– ১৯০৪)।
মুমিনের জীবনে বছরের মধ্যে রমজান মাসটি এক দুর্লভ সুযোগ এনে দেয়। তাই এই পুণ্যময় মাসে আমাদের ইবাদত বন্দেগি তথা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতের সাথে, সাহরি, ইফতার, তারাবিহ, তাহাজ্জুদ, কুরআন তিলাওয়াত, ইতিকাফ, দান–সাদাকা প্রভৃতি আদায়ে সামগ্রিক প্রস্তুতি নিতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক; প্রফেসর, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।