ফারুক হাসান : অকালে ঝরে পড়া বিশাল প্রতিভা

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ২৪ মার্চ, ২০২৩ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

মেডিকেলের ছাত্র থাকাকালীন সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক ছিল বেশি আমার। বিভিন্ন ছড়াকবিতা পাঠের আসরে বসতাম আর হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে শুনতাম আর উপলব্ধি করতাম বাস্তব জীবনের স্বকীয়তায়। তেমনি একটি সৃজনশীল সাহিত্য সংস্থা ছিল স্বকাল। বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক,

 

কবি ও ছড়াকার, শ্রদ্ধাভাজন রাশেদ রউফের অনুপ্রেরণা আমাকে আরও একধাপ এগিয়ে দেয়। যখন স্বকালের আসরে বসতামরাশেদ ভাই আমাকে ছড়া সাহিত্যের ব্যাপারে সাহস যোগাতেন, প্রেরণা দিতেন। চট্টগ্রামের নামিদামি ছড়াকারেরা এই আসরে বসতেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে স্বকাল সাহিত্য সংস্থা

ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ সাহিত্যশালা। কবি ও ছড়াকার তৈরির একটি প্রসিদ্ধ কারখানা। এখানে যোগ দিতেন সদ্য প্রয়াত ফারুক হাসান, রহীম শাহ, জসীম মেহবুব, প্রয়াত রমজান আলী মামুন, বিপুল বড়ুয়া, আবুল কালাম বেলাল, বশির উদ্দিন কনক, আবদুল বাকি বাদশা, ইফতেখার মারুফসহ অনেক নামীদামি ছড়াকার।

আমি মেডিকেলে পড়ার পাশাপাশি যে সময়টুকু পেতাম সেটুকু কবিতা ও ছড়া সাহিত্য কর্মে ব্যয় করতাম। এটি আমার অত্যন্ত প্রেরণাধর্মী ঝোঁক ছিল। তখন সবচেয়ে বেশি ছড়া লিখতাম এবং তা ছাপা হতদৈনিক নয়াবাংলা, আজাদী ও পূর্বকোণ পত্রিকায়। জাতীয় দৈনিক সমূহের মধ্যে দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক

মিল্লাত, দৈনিক সংগ্রাম ইত্যাদি। কিছু লিটল ম্যাগাজিনেও ছাপা হত আমার ছড়াগুলো। লেখা প্রকাশিত হলে নিজে খুব গর্ববোধ করতাম এবং আরও বেশি লেখালেখির ব্যাপারে উৎসাহ পেতাম। যদিও মেডিকেল পড়াশোনা খুবই কঠিন ও নিয়মতান্ত্রিক। এর ফাঁকেও সাহিত্য চর্চার লোভটা সামলাতে পারতাম না।

সেজন্যে দুর্বার গতিতে ছুটে যেতাম স্বকালের সাহিত্য আসরে। মেডিকেল পড়াশুনার ব্যস্ততার মাঝেও আমার উপস্থিতিকে তাঁরা সাধুবাদ জানাতেন। সেই সাহিত্য আসরের একজন নিয়মিত যাত্রী ছিলেন ফারুক হাসান। লেখালেখির সুবাদে পরিচয়এরপরে হৃদ্যতা আর সখ্যতা। টেরিবাজারের একটি মার্কেটের নিচ

তলায় উনার পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। মাঝে মাঝে যাওয়া হত। গল্পস্বল্প চলতো দীর্ঘক্ষণ। অকৃত্রিম হাসি লেগেই থাকতো সর্বদা। নাম একই হওয়াতে আমাকে মিতাই বলে ডাকতেন। পুরো ছাত্রজীবন একটা সম্পর্কের সূতিকাগার ছিল। মাঝখানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, বিশাল শূন্যতা ও কঠিন বাস্তবতা। ইন্টার্ন

জীবনের মোড় ঘুরে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট জীবন এর পরে সরকারি চাকরি জীবনসর্বোপরি পেশাগত জীবনের বিশাল উদ্যানে প্রবেশ। অথৈই সাগরে সাঁতরাতে থাকি আর অতীত জীবনের মধুময় ও বিষাদময় স্মৃতিগুলোর জাবর কাটি। খুব একটা কথা হতো না এবং দেখাও হতো না। উচ্চ শিক্ষার কারণে ঢাকায় দীর্ঘদিন

অবস্থানসবকিছু মিলিয়ে অনেকদিন দেখা হয়নি এই নিরহংকার মানুষটির সাথে। অবশ্যই দু’তিন বছর ধরে একটু একটু যোগাযোগ শুরু হয়। আন্দরকিল্লা ও চেরাগীপাহাড় এলাকায় মাঝে মাঝে দেখা হত। কুশলাদি হত, অতীত কথামালায় ফিরে যেতাম। তৃপ্তির ঢেকুর তুলতাম কখনোসখনো। অতি প্রাচীন লিটল

ম্যাগাজিন কথন পত্রিকার এক অনবদ্য সমপাদক ছিলেন তিনি। চট্টগ্রামের নামিদামি ছড়াকারগণ লিখতেন সেখানে। একবার কথার ফাঁকে বলেছিলেনআমি কথন পাঠিয়েছি আপনার ঠিকানায়। অবশ্যই মেডিকেল প্রধান ছাত্রাবাসে থাকাকালীন উনার পত্রিকাটি নিয়মিত পেতাম। গত বছরের মার্চে চট্টগ্রামের

লোহাগাড়ায় এক মারাত্নক সড়ক দুর্ঘটনায় মেজ ছেলেকে হারিয়ে অনেকটা নির্বাক ছিলেন তিনি। নিঃসাড় মনে বেদনার আকুতি যেন। সাথে সাথে ফোন দিয়ে সমবেদনা জানিয়েছিলাম এই অভিমানী ফারুক ভাইকে তাঁর স্নেহধন্য ছেলের জন্য এবং মহান আল্লাহর কাছে জান্নাতে যেন তাঁর ছেলের স্থান হয় সেই দোয়াটুকু

শেয়ার করেছিলাম। ফারুক ভাইয়ের অসুস্থতা সম্ভবত কিছুটা শেয়ার করেছিলেন আমার সাথেএখন খুব একটা মনে পড়ছে না। উনার সম্ভবত হার্টের বাইপাস সার্জারী কিংবা এনজিও প্লাস্টি হয়েছিলো। Acute Myocardial Infarction – এ আক্রান্ত হয়ে জীবনের পাঠ চুকেছেন। ছেলে হারানোর শোক সইতে না

সইতেই মহান আল্লাহ রব্বুল ইজ্জতের কাছে চলে গেছেন এই খ্যাতিমান ছড়াকার। ফারুক ভাই আর আসবে না এই তল্লাটেকর্মমুখর জীবনে আর হাঁটাহাঁটি করবে না। গতবছর সাফা আর্কেডে আয়োজিত রাউজান ক্লাব এর ইফতার মাহফিলে এই গুণী ছড়াকারকে আমি দাওয়াত দিয়েছিলাম এবং উপস্থিতও

হয়েছিলেন। ইফতার শেষে দরজার মুখে আমার সাথে দেখা। সালাম বিনিময়ের পর যে কথাটি বলেছিলেন উনি, ‘আপনি তো শুধু মেহমানদারীই করেছেনমুখে তো কিছুই নিলেন না। আমি দূর থেকে সব কিছু দেখেছি’। সেই শেষ কথন। আর কোনো কথন হবে না কথন সম্পাদক ফারুক হাসানের সাথে। উনি চলে

গেছেন দূর নিলয়েযেখান থেকে ফেরে না কেউ আর। একজন নিরেট ভদ্রলোকের প্রস্থান খুব বেশি ভাবিয়ে তোলে আমাদের। এই তো গত ৯ মার্চ ছড়াকার আহসানুল কবির রিটনের পেইজে তাঁর মৃৃত্যু সংবাদটা দেখলাম। ভেতরে ছলাৎ করে ঢেউ গভীরতম বেদনারউচ্ছ্বাসময় অনুরাগ লাফিয়ে তুলে শরীরময়।

ভেতরে ঢুকরে কেঁদে উঠি। হঠাৎ এই করুণ সংবাদে খুব কষ্ট করে সামলিয়ে নিয়েছি নিজেকে। এর পর পর অনেকের পেইজে সংবাদটি সারাবেলা দেখেছি। ফারুক ভাই চট্টগ্রাম অঙ্গনের অত্যন্ত দামী ছড়াকার এতে কোন সন্দেহ নেই। চট্টগ্রামের বরেণ্য ছড়াকারের হৃদয়ে এখন শোকাবৃত বেদনার ঢেউ। তাঁর

অনুপস্থিতি ভীষণভাবে ক্ষতবিক্ষিত করবে তাদের কিন্তু এটাই সত্যি এবং একমাত্র সত্য, ‘কারো সময় যখন এসে যাবে, তখন আল্লাহতায়ালা কখনই তাকে অবকাশ দিবেন না; তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহতায়ালা সেই সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত রয়েছেন’সূরাআল মোনাফেকুন১১। মহান আল্লাহতায়ালা যেন

ফারুক ভাইয়ের পরিবারকে অসীম ধৈর্য ও সাহসের ক্ষমতা দিন। একে একে ছেলে ও বাবার মৃত্যু অবশ্যই বেদনাবিধূর, তবুও মানতে হবে এবং মানাতে হবেএটাই চিরন্তন, ‘কোনো প্রাণীই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মরবে না, দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট’সূরাআল ইমরান১৪৫। সবার কাছেই আসবে মালাকুল মাওতকেউ

এড়িয়ে যেতে পারবে না। এটাই আমার আল্লাহতায়ালার ঘোষণা। এই ক্ষণস্থায়ী আনন্দ ছেড়ে আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে দূর দূরান্তের তেপান্তরেআখেরাতের সীমাহীন ঠিকানায়। সেখানেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সকলের, ‘মৃত্যু যন্ত্রণার মূহূর্তটি এসে হাজির হবে, এই হচ্ছে সেই মুহূর্তটিযা থেকে তুমি পালিয়ে

বেড়াতে’সূরাক্বাফ১৯। এই মৃত্যুর সাথেই শুরু হয়ে যাবে কেয়ামতের প্রথম ধাপযেখানে ফয়সালা হবে ভালো ও মন্দ কাজের। অথচ আমরা এখনো সেই নির্মম সত্য কথাটা লুকিয়ে রেখেছি সংগোপনে। আমরা আরো বেশি পরিশুদ্ধ করবো নিজেদেরকে। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী নিজের জীবনকে চালাবো,

পরিবারকে চালাবো, সমাজ ও রাষ্ট্রকে চালাবো আর এই পৃথিবীর একমাত্র দামী কিতাব কোরআনকে আমৃত্যু সঙ্গী করে রাখবোতাহলেই হয়তো ভোরের আকাশে সূর্যের হাসি দেখতে পাবো নচেৎ গহীন অন্ধকারে হবে আমাদের স্থায়ী ঠিকানা। আমাদের ফারুক ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস এর উচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),

রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধধেয়ে আসছে শরণার্থী তরঙ্গ
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা