ছোটবেলার ঈদ

মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু | শুক্রবার , ২১ এপ্রিল, ২০২৩ at ১১:৪৫ পূর্বাহ্ণ

প্রায় ষাট বছর পূর্বের ছোটবেলার ঈদের স্মৃতি এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। রোজার মাসের পুরো মাসটাই রোজা পালন ও এবাদতের পাশাপাশি চলতো ঈদের দিনের আয়োজন। সেকালে ঈদের দিনের খাবারের তালিকা জুড়ে থাকতো হাতে তৈরি পিঠা। শরবত ও নানান রকমের চালের পিঠা। কিছু কিছু ময়দার পিঠাও তৈরি করা হতো। প্রথম রোজা থেকে বানানো শুরু হতো ‘চুটকি পিঠা’। বাড়ির ছোট বড় সব মেয়েরাই হাতের দু’আঙ্গুলে পিষে পিষে নিপুণভাবে তৈরি করতো এ পিঠা। গল্প গুজবের ফাঁকে ফাঁকে পুরো রোজার মাস অল্প অল্প করে ‘চুটকি পিঠা’ তৈরি হতো।

ঈদের দিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য পিঠা ছিল ‘ছেঁই পিঠা’। চালের গুঁড়া সিদ্ধ করে লতা বানিয়ে হাতের তালু দিয়ে ঘষে ঘষে এ পিঠা তৈরি করা হতো রোজার মাসের মাঝামাঝি থেকে। চুটকি পিঠার আকৃতির একটু বড় সাইজের এ ছেঁই পিঠা তৈরিটা ছিলো খুব উপভোগ্য। একেক দিন একেক ঘরে আয়োজন হতো এ পিঠা তৈরি। অন্যান্য ঘরের মহিলারাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ পিঠা তৈরিতে সাহায্যে এগিয়ে আসতো।

সবাই পিঠা বানানোর বেলুইনপিড়া নিয়ে গোল হয়ে বসতো। কেউ লতা বানাচ্ছে। কেউবা লতা থেকে পিঠা বানাচ্ছে। অপূর্ব এক দৃশ্য। পালাক্রমে সব ঘরেই চলতো এ পিঠা বানানোর আয়োজন। সেকালে সেমাই তৈরি হতো ঘরে ঘরে। পিতলের মেশিনে একজন ময়দার খামি ঢুকাতো। অন্যজন মেশিনটি ঘুরাতো। চিকন চিকন সেমাই মেশিন থেকে বের হতো। পরে এগুলো শুকিয়ে রাখা হতো। রোজা এলেই এর আয়োজন শুরু হতো। মেশিনগুলো দুষ্প্র্রাপ্য ছিলো। সারা গ্রামে বড়জোর ২/১টি মেশিন থাকতো। আমাদের বাবা তেমন একটি মেশিন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনিয়েছিলেন। এছাড়াও ঈদের দিন প্রায় ঘরেই তৈরি হতো ফিরনি, পায়েস, জর্দা, নারিকেল পিঠা, পুয়া পিঠা, ছাঁচি পিঠা, নারিকেলের চিরা ইত্যাদি। বর্তমান যন্ত্রের যুগে প্যাকেট সেমাই, লাচ্ছা সেমাই ঈদের দিনের আয়োজনের সে আনন্দটা ম্লান করে দিয়েছে।

সেহেরী ও ইফতারের সময় তখনকার দিনে বেশ সমস্যা হতো। এখনকার মত তখন টেলিভিশন ছিল না। গ্রামের ঘরগুলোতে রেডিও ছিল কদাচিৎ। মোবাইল তখন আবিষ্কার হয়নি। মসজিদগুলোতে মাইকের ব্যবহার শুরু হয়নি। ইফতার করার জন্য মসজিদের সামনে গিয়ে দেখে আসতে হতো ঈমাম সাহেব মাগরিবের আজান দিয়েছেন কিনা। নতুবা নির্ভর করতে হতো বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির উপর, তিনি ইফতার করেছেন কিনা। তখন একটা কথা প্রচলন ছিল ইফতার ও সেহেরী খাওয়ার সময় নির্ধারণ হতো শরীরের লোম দেখা না দেখা নিয়ে। আমরা সময় নির্ধারণ করতাম আমাদের এক দাদা মৌলভী কলিমউল্লাহকে দেখে।

রেডিও, টেলিভিশনের অভাবে ১৯৬৭ সনে একবার রোজার ঈদ নিয়ে সবাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ২৯ রোজার সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখা না যাওয়াতে রোজাদাররা যথা নিয়মে তারাবীর নামাজ পড়েছে এবং সেহেরী খেয়ে রোজা রেখেছেন। ভোর রাতে রেডিওতে ঘোষণা দিয়েছে দেশের কোথাও কোথাও চাঁদ দেখা গিয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায়। তখন এক দেশ। সুতরাং আগামীকাল ঈদ। যে সব গ্রামে / বাড়িতে রেডিও ছিল তারা ঈদ করার সিদ্ধান্ত নিল। তাও গ্রামের অনেক লোক এটা মানতে রাজি হয়নি। নিজ চোখে চাঁদ না দেখে তারা ঈদ করবেন না। ফলে কোনো কোনো গ্রামে ঈদ হলো, কোনো কোনো গ্রামে ঈদ হলো না। দুদিন ঈদ করলো গ্রামবাসীরা। প্রথম দিন ঈদ উপলক্ষ্যে কোনো কোনো বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দেখা গেল তারা রোজা পালন করছে।

সেকালে ঈদগাহের জামাতগুলো অনেক জায়গায় পরিবার নির্ভর ছিল। বেশির ভাগ ঈদগাহ ছিল বড় বাড়িগুলোর দানে প্রতিষ্ঠিত। সেজন্য ঈদ জামাতে তাদের প্রভাবও ছিল উল্লেখ করার মত। ঐ সব বাড়ির লোকজন না আসা পর্যন্ত ঈদ জামাত হতো না। জামাতের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নির্ধারিত থাকতো না। ঐ সব বাড়ির অনেক সদস্য ঈদের দিন সকাল বেলা বাজারে গিয়ে চুল কাটাতো। এ সব কারণে জামাত শুরু হতে অনেক সময় দেখা গেছে বেলা১১টাসাড়ে ১১টা বেজে গেছে। ঈদ উপলক্ষে চুল কাটানোও তখন খুব উপভোগ্য ছিল। এখনকার মত তখন কোনো সুদৃশ্য সেলুন ছিল না। সাতাশ রোজা থেকে নাপিত তাদের সরঞ্জামাদি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরতো। বাড়ির ছেলে বুড়ো সবাই এক এক করে কাছারী ঘরের সামনে চৌকিপিড়াতে বসে চুল কাটাতো। চুল কাটার নির্দিষ্ট কোনো ফি ছিল না। নাপিতরা ধান/চাল বা টাকা বখশিস নিয়ে চলে যেত।

ঈদের দিন ফজরের নামাজের পর থেকেই বাড়ির শান বাধানো ঘাটে গোসলের ধুম পড়ে যেতো। ছোটরা আগে, তারপর বড়রা। শহর থেকে আনা সুগন্ধি সাবান ব্যবহার করা হতো। একই সাবান সবাই ব্যবহার করতো।

ঈদের নতুন পোষাকের জন্য আমরা উন্মুখ থাকতাম। সবাই নতুন জামা পড়তাম। সাদা পাঞ্জাবী অথবা হালকা রং এর চেক শার্ট। কোনো ফ্যাশনের বালাই ছিল না। বাবামা ভাইবোনদের জন্য আলাদা ডিজাইনের একই কাপড় কিনতেন। যেন স্কুল ড্রেস। এ নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ ছিল না।

অনেক বাড়িতে তখন সাতাশ রোজার দিন মেজবান হতো। ঐ বাড়ির ও সমাজিদের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকতো। কোনো কোনো বাড়ির সাতাইশা অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা ধানের জমি ও পুকুর ছিলো। যার আয় দিয়ে ঐ মেজবানের খরচ নির্বাহ করা হতো। পুকুর থেকে সদ্য তোলা মাছ আর তাজা সবজির তরকারি সবাইকে রসনাতৃপ্ত করতো। খুব মজা হতো। এ যেন ঈদের আগে সৌহার্দ্যের প্রস্তুতি। কালের আবর্তে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ঐ প্রথা এখন অনেক জায়গায় বিলীন হতে চলেছে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে এ আয়োজনগুলো ছিল।

গ্রামের ঈদগুলোতে জমজমাট ভাব শুরু হয় স্কুল কলেজগুলো বন্ধ হওয়ার পর থেকেই। স্কুল কলেজ বন্ধ হলে শহরে অবস্থানরত পরিবারগুলো ঈদকে সামনে রেখে গ্রামের বাড়িতে আসতে শুরু করে। তখন বাড়িতে আসার ঝক্কিঝামেলাও কম ছিলো না। রাস্তাঘাট তেমন উন্নত ছিলো না। ঢাকাচট্টগ্রামের ট্রাঙ্ক রোড ছিলো অপ্রশস্ত। ব্রিটিশ আমলের সিমেন্টকংক্রিটের ঢালাই করা। মাঝে মাঝে ফাটা ফাটা। বাসগুলোও ছিল বেডফোর্ড ইঞ্জিনের এবং কাঠের বডির। সিটগুলো চারিদিকে বেঞ্জ বসানোর মত। এখনকার মত এত উন্নতমানের দূরপাল্লার কোনো বাস ছিলো না।

ঢাকাচট্টগ্রাম থেকে পরিবারগুলো আসতো বেশির ভাগই ট্রেনে। কয়লার ইঞ্জিনের ট্রেন কালো ধোঁয়া তুলে হিস্‌ হিস্‌ আওয়াজ করে চলতো। ঢাকা থেকে সন্ধ্যার দিকে একটি ট্রেন ছাড়তো লোকাল ট্রেন। সেটি প্রতিটি স্টেশনে থেমে থেমে আমাদের মিরসরাই স্টেশনে এসে থামতো পরদিন কাক ডাকা ভোরে। মিরসরাই স্টেশন থেকে বাড়িতে আসতে হতো গরুর গাড়িতে। স্টেশন থেকে ট্রাঙ্ক রোড পর্যন্ত ছিল মাটির রাস্তা। ঝুঁপড়ি দেয়া গরুর গাড়ি হেলেদুলে কেঁত কেঁত শব্দ করে করে চলতো। বাড়ি আসার আমেজটাই ছিল আলাদা। এছাড়া মহিলাদের স্টেশন থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য ছিল পালকি। পালকির বেয়ারারা হেঁইও হেঁইও সুর করে করে দৌড়াতো। পরবর্তীতে রাস্তায় ইট বসে। রিক্সারও প্রচলন শুরু হয়। পর্দা প্রথার কারণে তখন মহিলা যাত্রিদের রিক্সা শাড়ি দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। গরুর গাড়ি, পালকি ও রিক্সার ভাড়া নির্দিষ্ট ছিলো না। গাড়োয়ান, বেয়ারা ও রিক্সা চালকরা আবদার/খুশী করে বখশিস নিয়ে যেতো। চট্টগ্রাম থেকেও বেশির ভাগ যাত্রী আসতো ট্রেনে। লোকাল ট্রেন, প্রতিটি স্টেশনে থেমে থেমে চলতো।

ঈদের দিন ঘরে ঘরে গিয়ে বাড়ির সবাইকে ফজরের নামাজের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ডাকা হতো। ফজরের নামাজ পড়া হতো জামাতে। দু’এক ঘরে ঈদের সেমাই, পিঠা তৈরি হয়ে যেতো আগে ভাগেই। ঐ ঘরগুলো থেকে আপ্যায়নের জন্য হাঁক ডাঁক শুরু হয়ে যেতো। গোসল করে নতুন জামা কাপড় পড়ে গায়ে আতর, চোখে সুরমা লাগিয়ে বাড়ি থেকে ছেলেবুড়ো সবাই দল বেঁধে ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হতো। বুড়োরা সবার আগে, সবার পেছনে ছোটরা।

আগেই উল্লেখ করেছি ঈদ জামাত হতে হতে ১১টাসাড়ে ১১টা বেজে যেতো। সবাই অপেক্ষা করতো চারিদিক থেকে মুসল্লিরা আসা শেষ হওয়া পর্যন্ত। মুসল্লিরা চারিদিক থেকে মেঠোপথ বা ধানক্ষেতের আইল দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসতেন।

নামাজ শেষে ঈদের মাঠে কোলাকুলি, বাড়িতে প্রবেশ করার আগে পারিবারিক কবরস্থানে গিয়ে মুরুব্বীদের কবর জেয়ারত করা হতো। তারপর ফিরে এসে ঘরে ঘরে মা, দাদী, চাচী আর ভাবীদের কদমবুচির পালা। সালাম করার পর সবাইকে কোলে নিয়ে দোয়া করতেন তাঁরা। বড় দেবরদের ভাবীদের কোলে বসা নিয়ে ঠাট্টাদুষ্টুমিও হতো। তারপর চলতো ঘরে ঘরে খাওয়া দাওয়ার পালা।

ঈদের সালামীর প্রচলন সব সময়ই ছিলো। তখনকার দিনে সালামের পর এক আনা/দু’আনা করে সালামী দেয়া হতো। তা নিয়ে বাজারে বা ঈদ মেলাতে যাওয়া হতো। মোয়া, চিরার নাড়ু, বুট, নকলদানা (চিনি মিশ্রিত বুট) আঙ্গুরী, মিঠাই ইত্যাদি কিনে খেতো ছেলেমেয়েরা।

সফট ড্রিংকস হিসেবে পাওয়া যেতো এক ধরনের সোডা ওয়াটার। সোডা ওয়াটারের বোতলের মুখে ছিপি হিসেবে থাকতো একটি মার্বেল। ক্রেতাকে দেয়ার আগে মার্বেলে চাপ দিতো। ফস করে আওয়াজ হয়ে মার্বেল ভিতরে চলে যেতো। ঝাঁঝাঁলো সোডা ওয়াটার ঠিকই তৃষ্ণা মেটাতো। পরবর্তীতে ভিটাকোলার প্রচলন ছিলো অনেকদিন। ফান্টা, কোকপেপসির প্রচলন শুরু হয় আরো অনেক পরে।

ঈদ উপলক্ষে আয়েজন হতো ফুটবল ও ভলিবল খেলার। এক বাড়ির সঙ্গে অন্য বাড়ি বা এক গ্রামের সঙ্গে অন্য গ্রামের ফুটবল খেলা নিয়ে পুরো বিকেল মেতে থাকতো সবাই। খেলায় পারদর্শিতা যত নাআয়োজনের ঘটা থাকতো তার চাইতে অনেক বেশি। এছাড়াও বাড়িতে ছেলেমেয়েরা খেলতোএক্কাদোক্কা, মার্বেল, সাতচারা, লুকোচুরি, আঁকাআঁকি (আড়ালে থেকে বিভিন্ন দাগ দিয়ে তা খুঁজে বের করা), দুদ্ধা খেলা (গাছে গাছে লুকোচুরি), খাদদা (তেতুল বিঁচি বা খেজুর বিচি দিয়ে ছোট ছোট গর্তে এক ধরনের খেলা), ডাংগুলি ইত্যাদি নানা ধরনের মজার মজার খেলাগুলো। জমির ধান কাটা হলে নানা রকম ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবও চলতো।

টিভি তো ছিলোই না, রেডিও ছিলো খুব কম। তাই সন্ধ্যার পর বসতো বাড়ির উঠোনে বা ডেলায় (বাহির বারান্দা) ধাঁ ধাঁর আসর (ভাঙানি কিস্‌সা), গল্পের আসর। মজার মজার সব গল্প। ছেলেমেয়েরা গল্প শুনতে শুনতে বিচরণ করতো কল্পনার রাজ্যে। টেপ রেকর্ডারের তখন প্রচলন হয়নি। তবে বনেদি দু/এক পরিবারে কলের গান ছিলো। ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’ এর রেকর্ডের পুরানো দিনের গানগুলো সবাইকে বিমোহিত করতো। কলের গান শোনার আয়োজন হতো সন্ধ্যার পর উঠোনের মাঝখানে। ঈদের পরের দিন থেকে শুরু হতো নানার বাড়ি, ফুফুর বাড়ি আর খালার বাড়িতে বেড়ানোর পালা। দীর্ঘ আমেজে এভাবেই একসময় শেষ হতো তখনকার দিনের ঈদগুলো।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, প্রকাশক ও সংগঠক, সিনেট সদস্যচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকায়াহীন অধর
পরবর্তী নিবন্ধআহা ঈদ!