ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ড. আ. ম. কাজী মুহাম্মদ হারুন উর রশীদ

| মঙ্গলবার , ৯ এপ্রিল, ২০২৪ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

একমাস সিয়াম সাধনার পর আমাদের মাঝে এসেছে অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। অনাবিল আনন্দ ও উল্লাসের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় এ ঈদুল ফিতর। এ ঈদ আমাদের মুসলিমদের জাতীয় উৎসব। এ ঈদুল ফিতর মুসলিমদের জীবনে অশেষ তাৎপর্য ও মহিমায় অনন্য। একমাস রোজা পালনের পর এক ফালি উদিত চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ ও খুশির ঈদের আগমনী বার্তা। আমাদের মুসলিমগণের বছরে দু’টি উৎসব রয়েছে। একটি হচ্ছে ১ শাওয়াল তারিখে ঈদুল ফিতর এবং অপরটি হচ্ছে ১০ জিলহজ দিবসে ঈদুল আজহা। মুসলিম মিল্লাতের কাছে এ উৎসব প্রতিবছর আনন্দের দিন হিসেবে আসে। রোজা পালনের মাধ্যমে রোজাদার যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার সৌন্দর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, ইসলামের যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগতিতিক্ষা, উদারতা, ক্ষমা ও মহানুভবতা মনুষ্যত্বের গুণাবলী বিকশিত হয় এবং গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর আমাদের কাছে আসে।

ঈদ’ আরবি শব্দ। এর অর্থ খুশি। আর ‘ফিতর’ মানে ভঙ্গ করা। দীর্ঘ একটি মাস কঠোর সিয়াম সাধনা ও ইবাদতবন্দেগির পর বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ রোজা ভঙ্গ করে আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নিয়ামতের শুকরিয়াস্বরূপ যে আনন্দ উৎসব পালন করে সেটিই ঈদুল ফিতর।

ঈদুল ফিতর ইসলামের রীতিনীতি অনুযায়ী ধর্মীয় দায়িত্বসমূহ পালন করার মধ্যেই প্রকৃত শান্তি নিহিত রয়েছে। ঈদুল ফিতর মুসলিমদেরকে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য এবং ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ শিক্ষা দেয়। এভাবে ঈদুল ফিতরের উৎসব ইসলামি জীবন পদ্ধতির ভিত্তিতে একটি বিশ্বজনীন নীতির ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকে। এ আনন্দের দিনে প্রতিটি মুসলিম তার সামাজিক অবস্থান ভুলে যায় এবং ভ্রাতৃত্ববোধের পর তৃপ্তিতে একে অপরকে আলিঙ্গন করে। পার্থক্য থাকে না ধনীদরিদ্র, শিক্ষিতঅশিক্ষিত, সবলদুর্বল, বংশ গৌরব, কৌলিন্য ও মানমর্যাদা। ঈদগাহে ময়দানে সারিবদ্ধভাবে জামাতের সঙ্গে ঈদুল ফিতরের দ’ুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষেই সাম্যের অতুলনীয় বাস্তব দৃশ্যের চিত্র ফুঠে ওঠে।

এ ঈদুল ফিতরের আগমনের পেছনে নাতিদীর্ঘ ইতিহাসও রয়েছে। তা হলো হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) হিজরতের পর দেখতে পেলেন মদিনার অধিবাসীরা বছরে দু’টি আনন্দ উৎসব পালন করছে। তখন রাসুল (সা.) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনতোমাদের এ দু’টি দিন কিসের? তখন তারা বললোআমরা জাহেলী যুগেও এ দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন তাদের এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন– ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এ দু’টি দিবসের বিনিময়ে আরো উত্তম দু’টি আনন্দপূর্ণ দিবস দান করেছেন। তন্মধ্যে একটি হলো ঈদুল আজহা এবং অপরটি হলো ঈদুল ফিতর।’ -(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং১১৩৪)

এ ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের কাছে নেমে আসে এক অনুপম ও অনাবিল আনন্দের জোয়ারধারা। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) বলেছেন– ‘ঈদুল ফিতরের রাতে ফিরিশতাদের মাঝে আনন্দ ও খুশির হিল্লোল বইতে থাকে। এক পর্যায়ে মহান আল্লাহ ফিরিশতাদের জিজ্ঞেস করেনযারা আমার কাজ করেছে তাদের কি পুরষ্কার দেয়া যেতে পারে? তখন ফেরেশতারা বলেনওহে আল্লাহ তায়ালা! তাদেরকে পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করছি। তখন আল্লাহ তায়ালা বলেনতোমরা সাক্ষী থেকো, আমি সকলকে ক্ষমা করে দিলাম। -(মিরকাতুল মাফাতিহ শারহে মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং২০৯৬)

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মোল্লা আলি কারি (রহ.) বলেছেন, ‘সাদাকাতুল ফিতর’ দ্বিতীয় হিজরিতে ধার্য করা হয়েছে। হানাফি মাজহাব মতে সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব। ইমাম শাফেয়ির মাজহাব মতে ফরজ। ঈদের দিনের আগেই ‘সাদাকাতুল ফিতর’ আদায় না করলে ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার আগেই ‘সাদাকাতুল ফিতর’ আদায় করতে হয়। ইমাম বুখারি (রহ.) হাদিসে উল্লেখ করেছেন, হজরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) লোকদেরকে নামাজে যাওয়ার আগেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। -(সহিহ আলবুখারি, হাদিস নং১৫০৯) এ সাদাকা দুঃস্থগণকে ঈদ উৎসব যোগদানের সুযোগ দেয় এবং তা সিয়ামকে ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে পবিত্র করে। সাদাকাতুল ফিতরকে সাধারণত ‘ফিতরা’ বলা হয়। এটা প্রকৃতপক্ষে রমজান মাসেরই নির্ধারিত সাদাকা। রমজান মাস শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন উপলক্ষে মাথাপিছু যে নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক সাহায্য গবিরমিসকিনকে সাদাকা করা হয় তাকে সাদাকাতুল ফিতর বলে। রমজানে পুরো একটি মাস মুমিনগণ রোজা পালন করেন এবং ইবাদতবন্দেগিতে মশগুল থাকেন। রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার ফরজ ইবাদতগুলো যথাসাধ্য আদায় করার চেষ্টা করেন। তারপরও এ দায়িত্বগুলো পালনের ক্ষেত্রে অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা এ ত্রুটিবিচ্যুতির ক্ষতিপূরণের জন্যে শরিয়তে রমজানের শেষে সাদাকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন।

যে ব্যক্তির কাছে ঈদের দিন সুবহি সাদিকের সময় জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ ছাড়া সাড়ে সাত তোলা সোনা অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা সমমূল্যের সম্পদ থাকে তাঁর ওপর সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। এ সব সম্পদ বা অর্থ যদি কারও হাতে ঈদের দিন সুবহি সাদিকের সময়ও আসে তাঁকেও ফিতরা দিতে হয়। ছোটোবড়ো, স্ত্রীপুরুষ প্রত্যেকের পক্ষে এ সাদাকা আদায় করা ওয়াজিব। নিজের ও নাবালেগ সন্তানাদির পক্ষ থেকেও সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। গৃহকর্তা এবং তার পোষ্যদের সংখ্যাকে হিসাব করে প্রতিজনের বিপরীতে নির্ধারিত মূল্য সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। সাদাকাতুল ফিতর যা দিয়ে আদায় করা যাবে তা হচ্ছেগম, আটা, ময়দা, যব, কিসমিস, খেজুর ও পনির ইত্যাদি পণ্যগুলো দিয়ে। এবার জাতীয় ফিতরা নির্ধারণ কমিটির মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ফিতরা নির্ধারণ করেছেন জনপ্রতি সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৭০ টাকা। আটার ক্ষেত্রে ফিতরা ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম। এর সর্বোচ্চ বাজার মূল্য ১১৫ টাকা। যবের ক্ষেত্রে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য ৪০০ টাকা ফিতরা দিতে হবে। এছাড়া কিসমিস দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা বাজারমূল্য ২ হাজার ১৪৫ টাকা। আর খেজুর দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ২ হাজার ৪৭৫ টাকা। পনির দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ২ হাজার ৯৭০ টাকা ফিতরা দিতে হবে। তবে উচ্চবিত্ত ও বিত্তশালীদের জন্যে পনির দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হবে। ফিতরা আদায় করার সময় টাকা দেওয়াই উত্তম। কারণ নগদ টাকা দিয়ে অভাবী মানুষ তাঁর যে কোনো প্রয়োজন পূরণ করতে পারবেন।

এবারের ঈদে আমাদের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনাপৃথিবীর সব মানুষের সুখশান্তি, কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি। আগামি দিনগুলো সত্য, সুন্দর ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হোক। হাসিখুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক এটাই হোক ঈদ উৎসবের কামনা।

লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক ; প্রফেসর, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদ হোক সবার জন্য সমান খুশির
পরবর্তী নিবন্ধঈদ উৎসবের অ আ ক খ