চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস কাল : গৌরবোজ্জ্বল পথচলার ৫৪তম বছর

সফিক চৌধুরী | মঙ্গলবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:২২ পূর্বাহ্ণ

বিদ্যা সাধনায় চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এখানকার শিক্ষা প্রধানত ধর্মভিত্তিক তিনটি ধারায় চলছিল। মুসলমানদের জন্য মক্তব-মাদ্রাসা, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য পাঠশালা-টোল-চতুষ্পাঠী এবং বৌদ্ধদের জন্য কেয়াং বা বিহার ছিল বিদ্যা অর্জনের পঠন-পাঠন কেন্দ্র। এছাড়া চতুর্থ একটি ধারাও বিদ্যা সাধনায় কাজ করেছিল বলে জানা যায়, যা ছিল গণ পর্যায়ে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির যৌথ মিশেল। বিশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এখানকার সচেতন শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী নাগরিক সমাজ বৃহত্তর চট্টগ্রামে বহু অনুষদ ভিত্তিক কোন গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যা পরবর্তীতে বহু ঘাত-প্রতিঘাত ও নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের তৎকালীন বিশিষ্টজন ও স্থানীয় দৈনিক আজাদী’র ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।
চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে প্রায় ১৭৫০ একর ভূমি নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শহর হতে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে শাটল ও ডেমু ট্রেন। ১৯৮০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একমাত্র বাহন হিসেবে শাটল ট্রেনের প্রথম যাত্রা শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর কর্তৃক এ বছর প্রকাশিত চবি তথ্য নির্দেশিকা হতে জানা যায়, শুরুতে অল্প কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৪ হাজার (ছাত্রী প্রায় ৩৬ শতাংশ), শিক্ষক প্রায় ৯০০ জন (নারী শিক্ষক প্রায় ২১ শতাংশ), ৯টি অনুষদ, ৪৮টি বিভাগ, ১৩টি হল (ছাত্র-৮টি, ছাত্রী ৫টি) ও হোস্টেল ১টি। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছে ৬টি ইনস্টিটিউট ও ৫টি গবেষণা কেন্দ্র।
শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ততা। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ জন শিক্ষক, ১১ জন ছাত্র এবং ৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী সহ সর্বমোট ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অকাতরে বিলিয়ে দেন নিজেদের জীবন। তাঁদের এই আত্মত্যাগ আর বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথেই নির্মিত হয়েছে স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ। ভূমি থেকে স্মরণের মূল বেদি পর্যন্ত সর্বমোট চারটি ধাপ, যার প্রতিটি ধাপ বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। প্রথম ধাপ ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, দ্বিতীয় ধাপ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, তৃতীয় ধাপ সত্তরের নির্বাচন ও চতুর্থ ধাপে প্রতিফলিত হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্মৃতিস্তম্ভে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার নাম ও ছবি রয়েছে। এছাড়াও চবিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধু’র ম্যুরাল সংবলিত বঙ্গবন্ধু চত্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল। আর এগুলোই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ও অহংকারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর।
যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্যই শুধু পঠন-পাঠন নয়। একটি পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান অর্জন, সৃষ্টি ও তা বিতরণের পাশাপাশি গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আর তা যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল তা টের পাওয়া যায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত প্রাক্তন অধ্যাপক বিশ্বখ্যাত ড. জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের গবেষণাকর্মে, মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি সারাবিশ্বে বিশেষভাবে খ্যাত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর হতে এ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য হিসেবে যাঁদের পেয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই দেশ বরেণ্য শিক্ষাবিদ। এই বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য হিসেবে পেয়েছেন এ.আর মল্লিক, শিক্ষাবিদ আবুল ফজল, অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন, অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, অধ্যাপক মোহাম্মদ ফজলী হোসেন, ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীসহ এমন আরও অনেক দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে। বর্তমান অষ্টাদশ উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এর আগে প্রথম নারী উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক ড. শিরীন আখতার। যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসে একজন প্রথম নারী উপাচার্যও।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষক ছিলেন, তাঁর গ্রামীণ ব্যাংকের ধারণাও প্রতিষ্ঠা পায় তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন। এছাড়াও প্রয়াত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আহমদ শরীফ, ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ড. জামাল নজরুল ইসলাম, ড. হুমায়ুন আজাদ, ড. অনুপম সেন, ড. মাহবুবুল হক, ড.মইনুল ইসলামসহ এমন আরও অনেকে শিক্ষক হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় গবেষণার প্রজনন ক্ষেত্র। গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি, উদ্ভাবনী চিন্তা চেতনার বিকাশ প্রধানতঃ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য আধুনিক বিশ্বের জন্য সময়োপযোগী জ্ঞান ও গবেষণাধর্মী শিক্ষার বাতাবরণ তৈরি করা। কিন্তু শিক্ষার এই বাতাবরণ তৈরি করতে হলে দরকার আধুনিক ও অবকাঠামোগত প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৪তম বর্ষের এমন ক্ষণে আমাদের প্রত্যাশা, শিক্ষা বিস্তারে বিগত দিনের ধারাকে অক্ষুণ্ন রেখে আরও বিকশিত ও নবপ্রাণ সৃষ্টি করবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। সেই সাথে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনের জন্য এবং ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনায় যোগ্য নেতা সৃষ্টির লক্ষ্যে হল ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে নিয়মিত এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সকলের থাকবে প্রাণবন্ত উপস্থিতি। সবচেয়ে বড় কথা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হবে সম্পূর্ণ সেশনজটমুক্ত।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় যখন জ্ঞান ও গবেষণায় এগিয়ে যায়, তখন মূলত এগিয়ে যায় দেশ ও সভ্যতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাদের প্রত্যাশা, দেশের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি এ বিশ্ববিদ্যালয় বিগত দিনের মত ভবিষ্যতেও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : প্রাক্তন ছাত্র-চবি, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘মহানবীর আদর্শ অনুসরণ করলে মাদক সন্ত্রাস ও নারী নির্যাতন থাকবে না’
পরবর্তী নিবন্ধমাওলানা ভাসানী ও ফারাক্কা লং মার্চ