মাওলানা ভাসানী ও ফারাক্কা লং মার্চ

জসিম উদ্দিন চৌধুরী | মঙ্গলবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ

মাওলানা ভাসানীর মতো নেতা বিশ্বে বিরল।এমন সাদাসিধে বিলাসবিহীন নেতা পাওয়া যাবেনা। রাজনীতি করে অথচ ক্ষমতার ধার ধারে না এমন মানুষও কি আছে?
আছে কিনা জানিনা তবে একদা ছিল। তিনি আর কেউ নয়। আফ্রো এশিয়া ল্যাটিন আফ্রিকার নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের প্রিয় নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অসংখ্য বিষয় আছে। যেমন লাহোর প্রস্তাবের সাবজেক্ট কমিটির সদস্য হিসেবে পাকিস্তান প্রস্তাব উপস্থাপনে ভূমিকা, আওয়ামী লীগ গঠন, কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানীদের আসসালামু আলাইকুম বলা,হক ভাসানী সরোয়র্দী জোট গঠন, সরকার গঠন, নিজে সরকারে না থাকা, ‘৬৯এর গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে শেখ মুজিবের মুক্তি,’৭০ সালে পৃর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা, ভোটের বাঙে লাথি মার, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার আহ্বান,যুদ্ধের সময় ভারতে নজরবন্দি, নজরবন্দি থাকাকালীন মুক্তিযুদ্ধের উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া, বামপন্থীদের বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া,যুদ্ধ পরবর্তী সরকারের একদলীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমালোচনা করা ও সতর্ক করা, দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে ভূখা মিছিল করাএবং ফারাক্কা মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়াসহ আরো কত কি? বলে শেষ করা যাবে না। আজ শুধু ফারাক্কা মিছিল নিয়েই কিছু বক্তব্য আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তাসহ প্রায় ৫৬টি নদীর উৎপত্তি স্থল প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, চীন ও ভুটান এবং এগুলো বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক নদীগুলো কোন দেশের একক সম্পদ নয় সুতরাং সম্পৃক্ত দেশের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সুষম পানি বন্টনের জন্য আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে কিন্তু ভারত আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে নদীগুলোর মধ্য বাঁধ দিয়ে পানি ভিন্ন পথে প্রবাহিত করছে। গঙ্গা নদীর উপর বাঁধ দিয়ে সে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ১৯৬১ সালে শুরু করে ১৯৭৪ সালে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রাজমহল ও ভগবান গোলার মাঝে ফারাক্কা নামক স্থানে বাংলাদেশের মরণবাঁধ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শেষ করে। তৎকালে পাকিস্তান সরকারের বিরোধীতা অগ্রাহ্য করে পরবর্তীতে ইন্দিরা-মুজিব বিবৃতিতেও ভারত কোন পানি বন্টন চুক্তি ছাড়া এই বাঁধ চালু না করার অঙ্গীকার করলেও তা পরীক্ষামুলক চালুর কথা বলে স্থায়ীভাবে চালু রেখেছিল।
বাংলাদেশের জন্য এই বাঁধ মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনবে এটা বুঝে দূরদর্শী, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিবাদের ঝড় তুললেন। তিনি ভারতের এহেন শত্রুতামূলক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিশ্বনেতাদেরকে তার বার্তা পাঠিয়ে মরণ বাঁধ ফারাক্কা সম্পর্কে জানালেন এবং ইন্দিরা গান্ধীকে প্রভাবিত করার আহবান জানালেন। একই সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর কাছেও ফারাক্কার ভয়াবহতা জানিয়ে গঙ্গার পানি অন্যদিকে প্রবাহিত না করার জন্য আহবান জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে সমস্ত জাতিকে উজ্জ্বীবিত করে ঐক্যবদ্ধ করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ এবং ভারত সরকারকে বাংলাদেশের দাবী মানতে বাধ্য করার জন্য ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা মিছিল করেছিলেন যা দেশের জনগণকে এবং বিশ্ব বিবেককে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিল। সেই থেকে প্রতি বছর ১৬ মে কে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের, অধিকার আদায়ের এবং দেশ প্রেমে উজ্জ্বীবিত করার দিবস হিসেবে জাতি ফারাক্কা দিবস পালন করে আসছে।
১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসের ২য় সপ্তাহে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৬ মে ফারাক্কা মিছিল করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই হিসেবে মিছিল পরিচালনা করার জন্য মাওলানা ভাসানীকে আহবায়ক, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, হাজী দানেশ, আনোয়ার জাহিদ, কাজী জাফর আহমদ সহ তৎকালীন অনেক প্রভাবশালী নেতাদেরকে সদস্য করে লং মার্চ কমিটি গঠন করেন। কর্মসূচীকে সফল করার জন্য প্রস্তুতি কমিটির নেতা ও সারাদেশের প্রগতিশীল নেতাকর্মীরা ১৪ মে এবং তার আগে রাজশাহীতে পৌঁছে যান। মাওলানা ভাসানীও ১৪ মে রাতে রাজশাহীতে পৌঁছে গিয়েছিলেন। পরদিন ১৫ মে সকালে রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশে প্রায় ১০ টায় মাওলানা ভাসানী পৌঁছলে “সিকিম নয় ভারত নয় এদেশ আমার বাংলাদেশ”, “ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও ফারাক্কা বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধ”, “লও লও লও সালাম মাওলানা ভাসানী” ইত্যাদি গগনবিদারী শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত করে মাওলানা ভাসানীকে সালাম এবং ভারতের আগ্রাসী নীতির প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। পরে পিন পতন নীরবতার মধ্যে মাওলানা ভাসানী বক্তব্য শেষ করে লক্ষ জনতাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়ানো হাজার হাজার জনতার খাদ্য, ফুল ভালবাসা ও সমর্থন নিয়ে প্রায় ৩২ মাইল পথ অতিক্রম করে সন্ধ্যায় চাপাইনবাবগঞ্জ এসে পৌঁছেছিলেন।
পরদিন ১৬ মে সকাল ৮টায় মিছিল শুরু করে প্রায় ১৫ মাইল পথ অতিক্রম করে ফারাক্কার পাদদেশে শিবগঞ্জ উপজেলার কনসার্টে সোনামসজিদে আসরের নামাজ শেষ করে বিশাল সমাবেশে ভারত, বিশ্ববাসী এবং দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিয়ে সমস্ত, জাতিকে উজ্জীবিত করে নিজস্ব অধিকারের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আর্কষণ করে এবং ভারত সরকারকে বাংলাদেশের জনগণের দাবী মেনে নেয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে সফল লং মার্চের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
উভয় সমাবেশে মাওলানা ভাসানী বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার ভারতীয় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশে এসে এবং বাস্তব পরিস্থিতি দেখে যেতে বলেছিলেন। তিনি বিশ্ব নেতাদেরকে ভারতের উপর প্রভাব খাটানোর আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি দেশী বিদেশী সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর সাধারণ পরিষদে আলোচনার প্রেক্ষিতে ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর একটি চুক্তি হয়েছিল। পরে আরো আলোচনা এবং আরো অনেক চুক্তি হয়েছে। সর্বশেষ গ্যারান্টি ক্লজ বাদ দিয়ে করা চুক্তিটি দেশের চরম ক্ষতি করেছে। সার কথা হচ্ছে, ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশ কোন সময় পায়নি। তাছাড়াও আরো অনেক আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বিভিন্নভাবে অপূরণীয় ক্ষতি করে চলেছে। তিস্তা চুক্তি নিয়েও গড়িমসি করছে। মাওলানা ভাসানী ও বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। সমগ্র উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ, নদীর লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ভূ অভ্যন্তরে পানির স্তর নীচে যাওয়া, বর্ষাকালে বন্যার কারণে পরিবেশ, কৃষি, মৎস্য, শিল্প ও নৌ পরিবহন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সীমাহীন অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া আরো অনেক সমস্যা অমিমাংসীত রয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের অবদানের জন্য জনগণ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানালেও তাদের আধিপত্যবাদী দাদা সুলভ আচরণ জনগণকে হতাশ করেছে। জনগণ তাদের কাছে বন্ধুসুলভ আচরণই প্রত্যাশা করে।
মাওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিল ভারত সরকারকে ফারাক্কা চুক্তি করতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল, জনগণকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করেছিল, যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। আগ্রাসী শক্তি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলার শিক্ষা দিয়ে ছিল। আজকে মাওলানা ভাসানী বেঁচে থাকলে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘খামোশ’ বলে হুংকার ছাড়তেন। আজকে তিনি নেই কিন্তু জনগণ শুধু ফারাক্কা লং মার্চ নয়, এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে মাওলানা ভাসানীর অবদান চিরদিন মনে রাখবে এবং প্রতিটি সংকটে তার দেখানো পথ অনুসরণ করবে।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস কাল : গৌরবোজ্জ্বল পথচলার ৫৪তম বছর
পরবর্তী নিবন্ধমহামানব মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.)