চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর দেশের প্রথম একাডেমিক জাদুঘর

মোহাম্মদ হোসেন | বুধবার , ১৮ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। হাঁটি হাঁটি পাপা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর ৫০ বছরে পা রেখেছে। মূল উপাদান ও গবেষণাধর্মী তথ্য উপাত্ত যোগানের মধ্যে দিয়ে এটি একটি একাডেমিক জাদুঘর হিসেবে উন্নততর শিক্ষার পথকে সুগম করেছে। এছাড়াও এটির উদ্দেশ্য হলো সাধারণ জনগণের কৌতুহলকে উদ্দিপ্ত করা এবং বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ও শিল্পঐতিহ্যকে বুঝতে এবং এর রস আস্বাদনে সহায়ক ভুমিকা রাখা।

বিবিধ বিষয়ে শিক্ষাদান ও গবেষণা কর্মকান্ডে সক্রিয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এই ঐতিহাসিক অঞ্চলে নিজস্ব একাডেমিক জাদুঘর স্থাপনের মধ্যে দিয়ে তার গুরু দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে। এই জাদুঘরের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় একটি বোর্ড অব ট্রাস্টির মাধ্যমে যেটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কর্তৃক গঠিত। দর্শনীয় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন প্রদর্শনী, গবেষণা ও প্রকাশনার আয়োজন করে চবি জাদুঘর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনন্দময় দর্শনীয় শিক্ষা ও একাডেমিক পরিবেশ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে উল্লেখযোগ্য অবস্থান দখল করেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয়ের উদ্বোধনী দিনকে স্বরণীয় করে রাখতে ২৪টি প্রত্নসামগ্রী নিয়ে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় যাতে একটি জাদুঘরের সুপ্ত ধারণা অনুভূত হয়। মিউজিয়াম এসোসিয়েসন অব পাকিস্থানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্থানের ম্যানেজিং ডিরেক্ট জনাব মমতাজ হাসান ঐসব প্রত্নসামগ্রী দান করেন বিশ্ববিদ্যালয়কে। এই সুপ্ত ধারণা লালন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর ও খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ এবং প্রত্নতত্ত্ব গবেষক প্রফেসর আজিজুর রহমান মল্লিক (১৯১৮১৯৯৭) খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ এবং সুপারনিউম্যারারী প্রফেসর ড. আবদুল করিম (প্রাক্তণ উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) কে নিয়ে সক্রিয়ভাবে প্রত্নসামগ্রী সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। অন্যান্য প্রত্নসামগ্রীগুলো সংগৃহিত হয় ড. আবদুল করিমের তত্বাবধানে অনুষ্ঠিত ইতিহাস বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের ফিল্ডসার্ভের মধ্যে দিয়ে। উক্ত ক্ষেত্রসমিক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ইতিহাস বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের প্রথম কিউরেটরিয়াল কর্মকর্তা ড. শামসুল হোসাইন।

মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের অনন্য মাইলফলক। অশ্রু আত্মত্যাগ আর সংগ্রামের গৌরবগাথা এই ইতিহাস। এক সময় লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে নির্মম অত্যাচার, দুঃসহ যন্ত্রণা এবং পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ যেমন সহ্য করেছে বাংলাদেশের অগণিত মানুষ, তেমনি অন্যদিকে চেতনাদৃপ্ত অসংখ্য ছাত্রযুবককৃষকশ্রমিক অমিত বিক্রমে দানবীয় শত্রুকে পরাজিত করে সৃষ্টি করেছে দুঃসাহসী বিজয়ের নতুন অধ্যায়। তাই অমিত গৌরব ও নিরন্তর প্রেরণার মহা উৎস হয়ে আছে এই মুক্তিযুদ্ধ। শুধু একটি মানচিত্র অর্জন নয়, যুদ্ধবিজয়ের অহংকারে সারাবিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মর্যাদাও হয়েছে অর্জিত। স্বাধীনতার অভিন্ন লক্ষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতির এইসংগ্রাম উজ্জ্বল আখরে খোদিত হয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায়।

বাঙ্গালির স্বাধিকার চেতনার সূচনা ভাষার লড়াইয়ে ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় ৫৪ এর নির্বাচন, ৬০এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর ঐতিহাসিক নির্বাচন স্বাধিকার আকাঙ্ক্ষাকে সুনির্দিষ্ট করে স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। এরপর আসে ৭ মার্চের বজ্রনির্ঘোষ আহ্বান: ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী ভয়ংকর সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ দখলদার পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশ হয় শত্রুমুক্ত।

পূর্বসুরীদের এই মহৎ অর্জনের গৌরবগাথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায় জাদুঘর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের রজত জয়ন্তী উপলক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের দলিল ও নিদর্শনের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল।

১৯৭৩ সালের ১৪ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ইংরেজি বিভাগের ২য় তলায় বর্তমানে যেখানে ঐ বিভাগের সভাপতি বসেন সে কক্ষটাতে জাদুঘর ছিল। পরে স্থান পরিবর্তন করে কলা ভবনের নিজ তলার ২টি কক্ষে জাদুঘরের অবস্থান ছিল। এরপর ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত আবার চট্টগ্রাম শহরের মৌলানা মোহাম্মদ আলী সড়কের চট্টগ্রাম কলা ভবনে (বর্তমান শিল্পকলা একাডেমি) জাদুঘর স্থানান্তরিত হয়। এরপর ১৯৮৮ সালে আবার ক্যাম্পাসে ফিরে এসে পুরাতন গ্রন্থগার ভবনের (বর্তমান প্রশাসনিক ভবন) ৪র্থ তলায় স্থানান্তরিত হয়। ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় স্থান পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অবশেষে ১০ আগস্ট ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ গাছের আড়ালে ঢাকা দুতলা বিশিষ্ট ভবনে (বর্তমান অবস্থানে) স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে চবি জাদুঘরের বয়স ৫০ বছর। এ ৫০ বছরে চবি জাদুঘরে অনেক অর্জন ও গৌরবদ্ধীপ্ত ইতিহাস রয়েছে। এ বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর সুবর্ণ জয়ন্তীতে পা রেখেছে।

জাদুঘরের দ্বিতীয় তলায় ৫টি গ্যালারি দ্বারা সজ্জিত সেগুলো হলো . প্রাকঐতিহাসিক এবং প্রত্নতত্ত্ব গ্যালারি ২. প্রাচীন ভাষ্কর্য গ্যালারি ৩. ইসলামিক শিল্পকলা গ্যালারি ৪. লোকশিল্প গ্যালারি ৫. সমকালীন চারুশিল্প গ্যালারি।

এ গ্যালারীগুলোতে সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির মূল উপাদান। স্থায়ী প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত শিল্পসামগ্রীগুলো অসংখ্য প্রত্নসামগ্রী থেকে বাছাই করে সযত্নে নির্বাচনপূর্বক প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া এসব সামগ্রী দুই হাজার বছরের ইতিহাসকে বিবৃত করে। একুজিশন রেজিস্টারের তালিকা অনুযায়ী জাদুঘরে দুই হাজার দুইশত এগারটি প্রত্নসামগ্রী রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় মুদ্রা, শিলালিপি, হস্তশিল্প, প্রাচীন ভাষ্কর্য, এপিগ্রাফ, কাঠের শিল্প, টেরাকোটা, যুদ্ধ অস্ত্রশস্ত্র, পোষাকপরিচ্ছদ, ধাতব শিল্প, ধাতব পাত্র, পরসোলিন, অলংকার শিল্প, লোকশিল্প, কুটির শিল্প এবং বাংলাদেশের সমকালীন চারুশিল্প উল্লেখযোগ্য। জাদুঘরের সংগৃহীত বই,পাণ্ডুলিপি, সাময়িকী, জার্নাল, পুঁথি ও আর্কাইভস এর সংখ্যা এখন সাত হাজার ছয়শত একান্ন।

অন্যদিকে নীচের তলায় রয়েছে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ কোষগ্রন্থাগার, একটি কনজারভেশন ল্যাবরেটরি, একটি অস্থায়ী প্রদর্শনী ও সেমিনার কক্ষ, একটি ডুকমেন্টেশন ও গবেষণা কেন্দ্র, জাদুঘরের স্টোর রুম এবং অফিস কক্ষসমূহ। একটি মুক্ত মঞ্চ ও ‘একুশে চত্ত্বর’ নামক বাগানসহ সুন্দর আঙ্গিনা জাদুঘরকে পুর্ণাঙ্গ করেছে। এছাড়াও সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রামবাসীর জীবনজীবিকার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ‘সাম্পান’। ‘সাম্পান, শুটকি, দরগাএ নিয়ে চাটগাঁ’। চট্টগ্রামের ঐক্য ও ঐতিহ্যের প্রতীক এ সাম্পান গণপরিবহনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে চট্টগ্রামের লোকাচরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামের মূল আকৃতিও গৃহীত হয়েছে পেছন থেকে দেখা ‘সাম্পান’ থেকে। গুরুত্ব বিবেচনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে চট্টগ্রামের এই ঐতিহ্যকে ধারণ, লালন ও উজ্জীবিত করতে স্থাপন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরে।

দেশিবিদেশী অনেক পর্যটক, শিক্ষকগবেষক, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীবৃন্দ ও সাধারণ দর্শণার্থী প্রতিদিনই (অফিস সময়ে) এ জাদুঘর পরিদর্শনে আসেন এবং জাদুঘরে রক্ষিত বহিতে তাঁদের অনুুভূতি ব্যক্ত করেন।

জাদুঘরের প্রয়োজনীয়তা: জাদুঘর আমাদের জ্ঞান দান করে, আমাদের শক্তি জোগায়,আমাদের চেতনা জাগ্রত করে,আমাদের মনোজগৎকে সমৃদ্ধ করে। জাদুঘর একটা শক্তিশালী সামাজিক সংগঠন। সমাজের এক স্তরে সঞ্চিত জ্ঞান তা ছড়িয়ে দেয় জনসমাজের সাধারণ স্তরে। গণতন্ত্রায়ণের পথও প্রশস্ত হয় এভাবে। জাদুঘর শুধু জ্ঞানই ছড়িয়ে দেয় না, অলক্ষ্যে ছড়িয়ে দেয় ভাবাদর্শ। বর্তমান একাদশ শ্রেণির বাংলা পাঠ্য বই (সাহিত্য পাঠ) গদ্যতে ১৮১ পৃষ্ঠায় ‘জাদুঘরে কেন যাব’ সে বিষয়ে প্রফেসর ড.আনিসুজ্জামান এর লিখা একটি প্রবন্ধ রয়েছে। কাজেই এ কথা বলা যেতে পারে যে, জাদুঘর যেমন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবনার সৃষ্টি, তেমনি তা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনেরও কারণ ঘটাতে পারে।

লেখক: সহকারী রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধহুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ