দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৮ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ঘুম ঘুম ভাবটা কাটছে না। কেমন যেন আলসে লাগছে। মনে হচ্ছে আরো একটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো! আয়েশী ঘুম না হওয়ার এই এক যন্ত্রণা! ঘুমালেও যেন ঘুম হয়না। আবারো ঘুমাতে ইচ্ছে করে, কিংবা ঘুমের ভাবটা লেগে থাকে। কিন্তু ইচ্ছে করলেও আবার ঘুমানো যায় না, ঘুম আসে না। এমন পরিস্থিতি আর কারো হয় কিনা বা হলে কেমন লাগে জানি না, তবে আমার বেশ অস্বস্তি লাগে। এমন সময়ে পেটে একটু চা কিংবা কফি পড়লে শরীরটা চাঙ্গা হয়ে উঠে। আসলে এক কাপ কফি কিংবা চা হলে মন্দ হতো না। সিটে হেলান দিয়ে আমি যখন কফির কথা ভাবছিলাম কাকতালীয়ভাবে ঠিক তখনি চীনা তরুণী খাবার ভর্তি ট্রলি ঠেলে ঠুলে এগিয়ে আসছিলেন। আমি ইশারা করলাম। কফি প্লিজ!

ট্রেনের কফি, তার উপর চীনা মাল! এই কফি যে খুব একটা ভালো হবে না সেটা আমি নিশ্চিত। আগে যে কফিটি খেয়েছিলাম সেটিও খুব একটা ভালো হয়নি। অবশ্য ট্রেনে ভালো কফি আমি আশাও করিনা। এই ধরণের জার্নিতে কফির ভালোখারাপ নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ থাকে না। একটা কিছু হলেই হয়ে যায়! দীর্ঘক্ষণ ট্রেনে বসে থাকতে থাকতে আমার ভিতরে উষ্ণতার তৃষ্ণা তৈরি হয়েছিল। চা কিংবা কফি কিছু একটা না হলে এই তৃষ্ণা মিটবে না, যাবে না আমার অস্থিরতা। আমার ঘরনির ধারণা চা’র নামে আমাকে গরম পানি ধরিয়ে দিলেও চলে! তাই কফির নামে গরম পানি খাবো এমন ইরাদা নিয়েই মূলত আমি কফির অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু চীনা তরুণী আমার হাতে কাপটি তুলে দেয়ার সময় কফির এমন পোড়া পোড়া একটি গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিল যে রক্ত নেচে উঠলো! স্টারবাকস, গ্লোরিয়া জিনস বা ওয়েল ফুডে যে কফি আমাকে মাতোয়ারা করে, ঠিক একই গন্ধ চীনের হাইস্পিড ননস্টপ ট্রেনে! চুমুক দেয়ার পর স্বাদে কমবেশির ব্যাপারটি অনুভূত হলেও ‘চীনা মাল’ বলে বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়া সম্ভব হলো না। দারুণ উপভোগ্য একটি কফি। চমৎকার গন্ধ, স্বাদ। অন্তত স্বদেশে আমাদের ট্রেনে কফির নামে যে গরম পানি বিভিন্ন সময় খেয়েছি চীনা ট্রেনের কফি তার থেকে শুধু ভালোই নয়, ঢের ভালো। কিন্তু প্রথম কফির সাথে দ্বিতীয় কফির এমন পার্থক্যের কারণটি বুঝতে পারলাম না! ঘুমের সাথে কফির স্বাদের কী কোন সম্পর্ক আছে! কে জানে!

আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছিলাম। জানালার বাইরে চোখ। তবে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু মাঝে মধ্যে বৈদ্যুতিক বাতির ঝলকানি তীব্র বেগে পেছনে ছুটছিল। বুঝতে পারছিলাম যে, কোন লোকালয় বা ট্রেন স্টেশন পার হচ্ছি। আমাদের ট্রেন যেহেতু ‘ননস্টপ’ তাই কোথাও থামছে না। আবার এত বিপুল বেগে আমাদের ট্রেনটি ছুটছে যে, একটি আস্ত স্টেশন পার হতে এক সেকেন্ডও সময় লাগছে না। ঝড়ের গতির সাথে আমরা পরিচিত, কিন্তু ৩০৮ কিলোমিটারের গতিবেগ যে ঝড়ের চেয়ে বহু বেশি সেটা বেশ টের পাচ্ছিলাম!

আমাদের ট্রেনের গতি বেশ কমে এসেছে। ঘড়ির কাঁটা বলছে আমাদের ট্রেন বেইজিং ওয়েস্ট রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছার সময় হয়ে এসেছে। ক্লান্ত শরীরেও বেশ উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম। বেইজিং পৌঁছে যাচ্ছি! চীনের রাজধানী বেইজিং। পৃথিবীর সেরা মেগাসিটি গুলোর একটি বেইজিং। চীনের শিক্ষা সংস্কৃতি এবং শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে এই শহরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শহরটির রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম হলেও পৃথিবীর রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল বেইজিং। বেইজিং শহর নিয়ে পরবর্তীতে আরো বিস্তারিত লিখবো। তবে আপাতত এটুকু লিখে রাখা যায় যে, এটি অনেক বড় একটি শহর। শহরটির ভিতরে একাধিক রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে। এরমধ্যে বেইজিং ওয়েস্ট হচ্ছে সর্বাধুনিক। আমি অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই স্টেশনটিতে নামতে যাচ্ছি। আমি কাউন্ট ডাউন করছিলাম। আর মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ট্রেনটি পুরোপুরি থেমে যাবে। বগিতে থাকা স্পিডমিটারে দেখা যাচ্ছে, ট্রেনটি এখন দেড়শ’ কিলোমিটার বেগে ছুটছে! অবশ্য, ক্রমাগত সংখ্যা কমছে, কমছে গতি। ৩০৮ কিলোমিটার থেকে কমতে কমতে ৮০ কিলোমিটার স্পিড দেখা যাচ্ছে।

ট্রেন পুরোপুরি থেমে গেছে। যাত্রীরাও নড়চড়া শুরু করেছেন। কেবিন স্পেসে রাখা ব্যাগ নিয়ে নামতে শুরু করেছেন তারা। আমার কোন তাড়া নেই, তবুও উঠে দাঁড়ালাম। নামতে তো হবেই। প্ল্যাটফরমে পা রাখতেই আমার ভিতরটা কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠলো। কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকাও খেয়ে গেলাম। চীনে এসেছি পর্যন্ত সবকিছু বড় বড় দেখছি, তাদের সব আয়োজনই বিশাল। কিন্তু তাই বলে এত বড়! যে দিকে চোখ যাচ্ছিল সেদিকেই স্টেশনের অংশ। যেন এক চোখের পথ! বেইজিং ওয়েস্ট স্টেশনের আয়তন ৫৩ লাখ ৮৯ হাজার ১৭০ বর্গফুট! প্রায় সাড়ে সাত হাজার কাঠা!! এত বড় রেলওয়ে স্টেশন! এটি নাকি এশিয়ার বৃহত্তম রেলওয়ে স্টেশন। প্রতিদিন এই স্টেশনে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ আশি হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। একদিনে সর্বোচ্চ ৪ লাখ যাত্রী হ্যান্ডলিং এর রেকর্ড রয়েছে ১৯৯৬ সাল থেকে পুরোদমে অপারেশনে থাকা স্টেশনটিতে। কোন রেলওয়ে স্টেশনের শুধু অবকাঠামোগত এলাকা এত বিশাল আমি আর কখনো দেখিনি।

মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দেখি যে সেটি বন্ধ হয়ে রয়েছে। ট্রেনের ভিতরে চার্জ দেয়ার সুযোগ থাকলেও আমি দিইনি। খেয়াল ছিলনা। মোবাইল থাকলে জিপিএস চালু করে হোটেলটির লোকেশন ধরে ঠিকঠাক মতো এগুনো যেতো। এখন সেই সুযোগ নেই। আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম! এমন স্টেশন থেকে ঠিকঠাকমতো বের হয়ে ঠিকঠাক জায়গাটিতে পৌঁছে হোটেলে পৌঁছা সহজ হবে নাকি জটলা পাকিয়ে ফেলবো বুঝতে পারছিলাম না। বেশ কয়েকটি পথ ধরে বের হচ্ছে মানুষ। চারদিকেই মনে হয় পথ রয়েছে। প্রচুর মানুষ গিজগিজ করছে। মানুষ মানুষের পথ ধরে বের হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি কোন পথে বের হলে বুকিং দেয়া হোটেলটির কাছাকাছিতে পৌঁছাবো সেটা একটু চিন্তা করলাম! চিন্তা মানে আন্দাজে চিন্তা। আমার বন্ধু ইউছুপ ভাইর ভায়রা জাহেদ ভাই আমাকে বলে দিয়েছেন যে, আমার জন্য বুকিং দেয়া হোটেলটি স্টেশনের কাছে। রেলওয়ে স্টেশন থেকে বের হয়ে সামান্য পথ হাঁটলেই তারকাখচিত হোটেলটির অবস্থান। তাই স্টেশন থেকে কোন টেক্সি ভাড়া করার দরকার নেই। পায়ে হেঁটেই হোটেলে যাওয়া যাবে। এখন এত বড় স্টেশনের এতগুলো গেটের ঠিক কোন পথটি ধরে বের হলে আমার হোটেলটি সামনে পড়বে তা ঠাহর করা কঠিন। উল্টো পথে চলে গেলে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে পৌঁছাতে হবে!

বিসমিল্লাহ বলে একটি পথ ধরলাম। স্রেফ বের হতে হবে বলে পথটি ধরা। আমি কোনপথে যাচ্ছি তার কিছু্‌ই বুঝতে পারছিলাম না। মানুষের পেছনে পেছনে হাঁটছি, আর সামনে এগুচ্ছি। একটু পর দেখলাম সবাই দোতলায় যাচ্ছে, আমিও পথ ধরলাম। এবার রাস্তার উপর দিয়ে একটি ফুটওভারব্রিজও পার হলাম। নিচ দিয়ে ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটছে। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালো থেকো মা
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর দেশের প্রথম একাডেমিক জাদুঘর