চট্টগ্রামের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান

কাঞ্চনা চক্রবর্তী | সোমবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ১:০১ পূর্বাহ্ণ


অগ্নিগর্ভা চট্টগ্রামের বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর পথ ধরে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের নারীসমাজ শুধু এগিয়ে আসেননি তাঁদের সর্বশক্তি দিয়ে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই বিশের দশক থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত চট্টগ্রামের নারীসমাজ নির্দ্বিধায় স্বদেশপ্রেমের মহান ব্রতে দীক্ষিত হয়ে পরাধীনতার শৃংখল থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন যা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। মালেকা বেগমের মতে, ‘পশ্চিমা হায়নাদের উৎপীড়নে অন্য সবার মতো নারীরাও প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন কিন্তু প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার,ইলা মিত্র, অপর্ণা পাল ও নাদেরা বেগমদের উত্তরাধিকারীরা সেখানে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন কেন? তাঁরা অস্ত্রহাতে যুদ্ধে না গেলেও স্নেহ-মমতা দিয়ে প্রতিমুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের মায়ের অভাব পূরণ করেছেন। অনেকে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে সামনে রেখে অন্যান্য কল্যাণমুখী তৎপরতা চালান।’’
প্রকৃতপক্ষে ত্রিশের দশকে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের হাত ধরে চট্টগ্রামের অসংখ্য নারী স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। যে দীক্ষা মন্ত্রের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, যে আন্দোলনে ছাত্রদের সাথে চট্টগ্রামের নারীও যুক্ত হয়েছিলেন। ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ- নারীরা মিছিল-মিটিং করে এবং রাজপথে নেমে এসে যুদ্ধের প্রতিবাদ করেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময়কালে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান হত্যার প্রতিবাদ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন বন্দি করা হয় তখন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্রী কর্মীদের সাথে বান্ধবীরা যুক্ত হয়ে রাজপথে আন্দোলনে নামেন। শুরু হয় স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামী লীগের ছয় দফা আন্দোলনের সাথে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগার দফার আন্দোলন। আন্দোলনের ফলে আইয়ুব শাহীর পতন আর ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতায় আসন গ্রহণ । কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের আন্দোলনের মুখে শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্ত হন। এই সময় চট্টগ্রামে গঠিত হয় ” বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ” এর চট্টগ্রাম জেলা শাখা। বেগম মুশতারী শফীকে আহ্বায়ক ও ছাত্রী সীমা চক্রবর্তীকে সভাপতি করে অস্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে উমরতুল ফজলকে সভানেত্রী ও ছাত্রী হান্নানা বেগমকে সম্পাদিকা করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। চট্টগ্রামের নারীসমাজ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এক গৌরবান্বিত ভূমিকা পালন করেন। যা চট্টগ্রামের স্বাধীনতার ইতিহাসকে অবিস্মরণীয় করে তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের নারীসমাজ মূলত একটি স্লোগানকে ধারণ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন —
মা-বোনেরা প্রীতিলতার পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো / মা বোনেরা ঘর ছাড়ো, প্রীতিলতার পথ ধরো।’’
৬৯ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শোক মিছিল থেকে আন্দোলনের তীব্রতা রূপ নেয়। সেই ঘটনার প্রেক্ষাপটে ২৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামে কালো দিবস পালন করেন ছাত্রীরা। বিশাল মিছিল করেন তাঁরা। জে এম সেন হলে তাঁরা খালেদা খানমের সভাপতিত্বে সভা করেন। ১৯৭১ সালের গোড়ার দিকেই স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবিতে দেশ উত্তাল হয়ে উঠলো। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দেন। ডাক দেন অসহযোগ আন্দোলনের। বঙ্গবন্ধু এদেশের নারী সমাজকে মাতৃজাতিকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছিলেন। বাংলার মায়ের কোল শূন্য করার প্রতিবাদে তিনি গোলটেবিল বৈঠক বাতিল করে দিয়েছেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান এ নারীসমাজ উদ্দীপ্ত আর আপ্লুত হয়েছিল। তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। নারী সমাজ এ আহ্বানকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীদের ভূমিকার কথা বলেছেন বহু গবেষক ও লেখক। নানা বইয়ে এসব কথা তুলে ধরা হয়েছে। গবেষক অধ্যাপক সালাউদ্দীন আহমেদ সম্পাদিত ” কথা সাহিত্যিকের রূপরেখা ” বইয়ে উল্লিখিত সাক্ষাৎকারভিত্তিক বিবরণ থেকে পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধে এমন কয়েকজনের ভূমিকার কথা বর্ণনাক্রমিকভাবে সাজানো তাঁদের নামগুলো হচ্ছে– আখতার ইমাম, উমরতুল ফজল, কমলা মুখার্জী (ভারতে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখেন), চারুবালা বড়ুয়া, জাহানারা ইমাম, জোবেদা খাতুন চৌধুরী, বাসন্তী গুহ ঠাকুরতা,মনোরমা বসু, রেণুকণা বড়ুয়া, সুফিয়া কামাল ও হেনা দাশ। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা ও সংগঠক মুশতারী শফী নিজের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন -“স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন ” নামের গ্রন্থ ; লিখেছেন সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ” মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী ” এই গ্রন্থ থেকে জানা যাবে বহু নারী মুক্তিযোদ্ধার কথা। তাঁর ভাষায়— ” চট্টগ্রাম ২৯ শে মার্চ পর্যন্ত ছিলে এখনকার বীর জনতার দুর্বার প্রতিরোধে মুক্ত। শহর ছেড়ে মানুষ চলে গেল নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় গ্রাম-গঞ্জ প্রত্যন্ত এলাকায়। অনেকে চলে গেল ভারতে। গঠিত হলো মুক্তিবাহিনী। শুরু হলো রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ।তবে দেশজুড়ে যুদ্ধ ও পরিস্থিতির কারণে যে যেখানেই থাক না কেন, প্রীতিলতার উত্তরসূরি চট্টগ্রামের নারী শুধু প্রাণভয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকেনি কোথাও। কেউ স্বাধীন বাংলা বেতারে শিল্পী হিসেবে যোগদান করেছেন। কেউ সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কেউ মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পেও হাসপাতালে চিকিৎসা ও নার্সের কাজ করেছেন। দেশের ভেতরে যাঁরা ছিলেন তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, খাদ্য দিয়ে, শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে দিয়ে, পাক বাহিনীর অবস্থান এর খবরা খবর সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিয়ে ইত্যাদি নানা রকম দুঃসাহসিক কাজ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যময়। এভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে কত নারী হয়েছে নিঃস্ব, সর্বহারা। — আমি এ গ্রন্থে ক’জনের কথাই বা তুলে ধরতে পারলাম?
ডক্টর মাহফুজুর রহমানের তথ্যসূত্রে,
” ৯ মার্চ চট্টগ্রামে জে এম সেন হলে মহিলা আওয়ামী লীগের সভা হয়। এতে বক্তব্য দেন মেহেরুন্নেসা, বেগম সারফত উল্লাহ,বেগম নাজনীন, বেগম কামরুন্নাহার, বেগম মুছা খান এবং কুন্দপ্রভা সেন প্রমুখ। ১১ মার্চ চট্টগ্রামে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে নগরীতে বিরাট মিছিল হয়।'”

১৮ মার্চ চট্টগ্রামের জে এম সেন হলে মহিলা পরিষদ ও মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন উমরাতুল ফজল। প্রধান অতিথি ছিলেন সুফিয়া কামাল। বিশেষ অতিথি ছিলেন মালেকা বেগম। চট্টগ্রাম মহিলা পরিষদ স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদিকা মালেকা বেগম বলেন – “এখন বাংলাদেশের জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নারী সমাজকে জঙ্গী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে”। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে হান্নান বেগম, কুন্দপ্রভা সেন, সীমা চক্রবর্তী, মুশতারী শফী, শিরিন শরাফতুল্লাহ প্রমুখ বক্তব্য দেন। চট্টগ্রামসহ প্রায় সকল জেলায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পটভূমিকায় সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের শাখা। উমরতুল ফজল নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রামে। সেখানে তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মুশতারী শফী, নুরজাহান বেগম, দিল আফরোজ দিলু, গীতা ঘোষ, চিত্রা বিশ্বাস, রমা দত্ত, সীমা চক্রবর্তী প্রমুখ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় চট্টগ্রামের মহিলা সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা রাখেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারীদের ভূমিকা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকলেও প্রকৃত মূল্যায়ন এখনো পর্যন্ত হয়নি। যদিও নারীরা সেই বীরাঙ্গনাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস কখনো মিথ্যের আলাপন করে না। চট্টগ্রামে নারীদের সেই ভূমিকায় হয়ত অনেকের নাম আসবে না। যা আসবে তাও সামান্য। কেননা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে নারীর মূল্যায়ন সঠিকভাবে আমরা কখনও করতে পারবো না। এর কারণ পুরুষরা সমরাঙ্গণে যুদ্ধ করেছে। আর নারীরা — কত মা তাঁর সন্তানকে, কত বোন তাঁর আদরের ভাইকে আবার কত বধূ তাঁর প্রিয়তম স্বামীকে দেশের জন্য বলী দিয়েছেন তার কোন সঠিক হিসাব প্রকৃতপক্ষে নেই।
২৫ মার্চের কালরাতে যখন ঢাকার রাজপথে নেমে আসে বর্বর পাকিস্তানি সামরিক জানতার ট্যাংক, তখন চট্টগ্রামে বন্দরে শুরু হলো নৌঙ্গরকৃত যুদ্ধজাহাজ এবং নেভেল বেস থেকে ক্রমাগত দূরপাল্লার ভাড়ি কামানের গোলা নিক্ষেপ। তবু চট্টগ্রাম২৯ মার্চ পর্যন্ত ছিল বীর জনতার দুর্বার প্রতিরোধের মুক্ত। আমাদের চট্টগ্রামের নারীরা প্রাণভয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে নি। কেউ স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী শব্দ সৈনিক হিসেবে যোগদান করেছেন। কেউ সশস্ত্র যুদ্ধে ট্রেনিং নিয়ে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। কেউ মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ও হাসপাতালে চিকিৎসা ও নার্সের কাজ করেছেন। দেশের ভিতরে যারা ছিলেন তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, খাদ্য দিয়ে, শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে দিয়ে এবং পাক বাহিনীর অবস্থান এর খবরা খবর সংগ্রহ করে মুক্তি বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিয়ে ইত্যাদি নানা রকম দুঃসাহসিক কাজের স্বাক্ষর রেখে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে করেছেন ঐতিহ্যময় ও গৌরবান্বিত।
১) ডাক্তার নুরুন্নাহার জহুর—
চট্টগ্রামে মহিলা মুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ি তুলেছিলেন ডাক্তার নুরুন্নাহার জহুর। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ১০ জন ছাত্রী ও মহিলা কর্মীকে সংগঠিত করে তাঁদের সশস্ত্র ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেন। তিনি নিজেও ট্রেনিং দেন আনোয়ারা থানার বড় উঠান গ্রামে। পটিয়ার কাশেমপুর গ্রামে, সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন গ্রামে অর্থাৎ পরিস্থিতির কারণে যেখানেই যেতে হয়েছে সেখানেই তিনি নারীদের সংগঠিত করেছেন। তিনি মোট ছয় মাস দেশের ভিতরে থেকে কাজ করেছেন।
২) বেগম মুশতারী শফী —
ডা. শফী ও বেগম মুশতারী শফীকে মার্চ মাসের শেষে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পর তাঁদের বাড়িতে অস্ত্রশস্ত্র রাখার সন্দেহে পাকিস্তানি আর্মির একজন মেজর যখন জেরা করেছিলেন তখন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে তিনি মুশতারী শফীকে চিহ্নিত করেন। একটি মিছিলের ছবি দেখিয়ে যা ছিল ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত মহিলা পরিষদের সেই মিছিলের ছবি। মুশতারী শফীর স্বামী ডাক্তার শফীকে পাকিস্তানি আর্মির একজন মেজর ধরে নিয়ে যাওয়ার পর মুশতারী শফী ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে আত্মগোপন করেছিলেন। পরে ২৬ মে ভারতে চলে যান এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী হিসেবে মুক্তি যুদ্ধে অবদান রাখেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর স্বামী ও ভাইকে হারান। মহান ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা মাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
৩) সীমা চক্রবর্তী ও প্রান্তিকা চক্রবর্তী–
সীমা চক্রবর্তী ও প্রান্তিকা চক্রবর্তী ছিলেন
মহিলা পরিষদের একনিষ্ঠ নিবেদিতপ্রাণ কর্মী।
সীমা চক্রবর্তী অত্যন্ত কর্মঠ মহাপ্রাণ চঞ্চলই শুধু ছিলেন না তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সাহসী সৈনিক ছিলেন। তাঁর বাবা অনিল চক্রবর্তী কে হত্যা করে এবং মেয়েদের ওপর তারা চালিয়েছে নির্মম নির্যাতন।
৪) বেবী–
মেডিকেলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী মনোয়ারা ডাক নাম সম্ভবত বেবী ছিল। তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রক্ত যোগাড় করতে না পেরে নিজের শরীরের রক্ত সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে বের করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছিলেন এবং নিজে আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং জ্ঞান হারান।
৫) শ্রীমতি তরুণ মন্ডল–
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এই মহীয়সী নারী তাঁর রহমতগঞ্জের বাসায় হিন্দু নারীদের গলায় ক্রুস চিহ্ন বসিয়ে দিয়ে এবং নতুন খ্রিস্টান নামকরণ করে অনেকেরই জীবন রক্ষা করেছিলেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা রেডিওর বাদ্য শিল্পী ছিল আর এতে করে তাঁরা ক্যান্টনমেন্টে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেত এবং সেখান থেকে গোপনীয় তথ্য মুক্তিবাহিনীকে দিয়ে সাহায্য করতেন।
৬) শামসুন্নাহার কামাল–
চট্টগ্রামে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলতে গেলে ডাক্তার শামসুন্নাহার কামাল যার ডাকনাম ছিল মনু তাঁর কথা শ্রদ্ধা চিত্তে স্মরণ করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই অসীম সাহসী মহীয়সী নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি সহযোগিতা করেন। তাঁদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে এবং বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে অনেকেরই জীবন রক্ষা করেছিলেন। তাঁর তিন ছেলে ও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন তাই তো তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জননী। যুদ্ধরত চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীদের তিনি গোপনে সকল ধরনের সহযোগিতা করেছিলেন। শুধু স্বাস্থ্যসেবা নয় তিনি বর্ডারে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের সরবরাহ করেছিলেন বিভিন্ন ওষুধসহ চিকিৎসা সামগ্রী ও গোপনীয় তথ্য। এমনকি নিজ গৃহে মুক্তিযোদ্ধাদের রেখে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন।
৭) ডাক্তার রেণুকণা বড়ুয়া-
১৯৬৯ এর এপ্রিলে ইপিসিএস ক্যাডার ভুক্ত হয়ে ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে হাসপাতাল চট্টগ্রামে এসিস্টেন্ট সার্জন হিসেবে যোগদান করেন। এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কর্মরত ছিলেন। তাঁর স্বামী সুপতি রঞ্জন বড়ুয়া ছিলেন ইস্টার্ন রেলওয়ে ফিন্যায়ন এডভাইজার। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল নিজ কর্মক্ষেত্রে গিয়ে নিখোঁজ হন। পাকবাহিনীরা তাঁকে হত্যা করেন। এরপর তিনি রাউজানের আবুল খানি গ্রামে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে তখন গেরিলা যুদ্ধ করার জন্য গ্রামে আসতেন। আগত এসব মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন বাড়িতে ভাগাভাগি করে আশ্রয় নেওয়ার যাবতীয় কাজে তিনি নেতৃত্ব দেন। তাঁর বুকে শোকের পাথর বেঁধেও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতা করেন। এমনকি নিজেও গোপনে রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রুষা দেন। তাঁর এই অবদান অক্ষয় হয়ে থাকবে। সুলতান মাহমুদ বীর উত্তমের নেতৃত্বে তিনি কাজ করেন।
৮) জাহানারা ইউসুফ:-
শহীদ জায়া জননী জাহানারা ইউসুফ। তাঁর বড় ছেলে শহীদ কাজী মোঃ সাদিক হাসান ১৯৬৯ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে যখন আন্দোলন তুঙ্গে তখন তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তাঁকে আদর করে বড়বাবু বলে ডাকত। তিনি তখন ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেয় এবং সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭মার্চ বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক আর অন্যদিকে বাঙালি বিহারী দাঙ্গা। এই দাঙ্গা থামাতে তাঁদের পরিবারের বিশেষত জাহানারা, স্বামী পুত্র দেবরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বড় বাবুজি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ২৮ মার্চ রাতে যখন পাঞ্জাবি সেনারা অতর্কিতে পুলিশ লাইনের ওপর হামলা করে তখন তাঁরা পরিবারের সবাই মিলে আহত পুলিশদের সেবা ও চিকিৎসা দেন।
জাহানারা ইউসুফ আহত যুদ্ধরত পুলিশ ও এলাকাবাসীর জন্য ভাত রুটি তরকারি রান্না করে তাঁদের সহযোগিতা করেন। চট্টগ্রামের লালখান বাজার দখল করে পাকিস্তানি অবাঙালিরা প্রত্যেক বাড়িতেই হত্যা ও নির্যাতন চালায়। ২৯ মার্চ সকালে জাহানারা ইউসুফ এর স্বামী শহীদ কাজী মোহাম্মদ ইউসুফ ও তাঁদের বড় ছেলে শহীদ কাজী মোহাম্মদ সাদিক হাসান কে ঘর থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেন। যাঁদের কোন খবর তাঁদের পরিবার খুঁজে পাননি। যদিও তাঁরা দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে তবুও তাদের কোন কবর স্থান নেই। নেই কোনো স্মৃতিস্তম্ভ।
৯) মনি ইমাম ও রওশন আরা মোস্তফা-
নাট্যশিল্পী মনি ইমাম ও তাঁর স্বামী শহীদ কাজী আলী ইমাম ছিলেন একজন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী। প্রান্তিক, জাগৃতি এবং বান্ধবী সংঘের অনেক মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন। অভিনয় করতেন চট্টগ্রাম বেতারেও। মুক্তিযুদ্ধের সময় মনি ইমাম ও তাঁর পরিবার এবং তাঁর বোন রওশনারা মোস্তফা যাঁর স্বামী ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক শহীদ ডাক্তার গোলাম মোস্তফা। তাঁরা একসাথে সেই সময় বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। ২৬ শে মার্চ রাতে বাঙালি পুলিশদের উপর অবাঙালি পুলিশরা হামলা করে অনেককে মেরে ফেলে। ২৬ মার্চ ওয়াটার ওয়ার্কস যা বর্তমানে ওয়াসা এলাকায়। বাঙালি পুলিশ যখন শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আত্মগোপন করেছিল তখন তাঁদেরকে গোপনে খাবার দিতেন। ২৯ মার্চ পর্যন্ত খাবার সরবরাহ করেছেন। এরমধ্যে উনারা অনেক যুদ্ধাহত পুলিশ এবং মুক্তিযোদ্ধা কে সেবা-শুশ্রুষা করে সুস্থ করেছেন। ৩০ মার্চ মনি ইমামের স্বামী কাজী আলী ইমাম ও তাঁর বোন রওশনারা মোস্তফার স্বামী ডাক্তার গোলাম মোস্তফাকে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমভাবে হত্যা করেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই দুই শহীদকে বাড়ির উঠোনে পরিবারের সকল সদস্য রান্নাঘরের দা, বটি, খুন্তি ও বড় চামচ দিয়ে কবর খুঁড়ে যেভাবে পারল মাত্র দেড় হাত গর্ত করে সেখানে সেই গর্তে শুইয়ে কবর দিলেন। আসলে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বাঙালি নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ঘটনাগুলো এত নির্মম ও নিষ্ঠুর ছিল যা শুনলে সাত্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষাই খুঁজে পাওয়া যায় না। এরপর মনি ইমামের দুই ছেলেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মনি ইমাম ও রওশন আরা মোস্তফাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম।
১০) সালেহা চৌধুরী:
সালেহা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহস ও বীরত্বের সাথে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত না হওয়ার প্রতিবাদে সমগ্র দেশের সাথে মহিলা পরিষদের আর বান্ধবী সংঘের সঙ্গে সম্মিলিত প্রতিবাদ সভা মিছিল-মিটিংসহ সব কিছুতে নেতৃত্ব দেন সালেহা চৌধুরী। তিনি শহরের প্রতিটি প্রান্তে সভা ও মিছিলে ছুটে গেছেন। শিক্ষিকা সালেহা চৌধুরী পাহাড়তলী সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদিকা দায়িত্বে ছিলেন। তিনি গোপনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলেছেন আর ইশতেহার বিলি করেছেন তাঁর স্বামীও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন। তাঁরা কখনও পাকিস্তানিদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করতো। কখনো অর্থের যোগান দিয়ে তা গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠাতেন। চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাহাড়তলী ঝাউতলা আর পাঞ্জাবি লেনের বিহারীরা বাঙালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।তারা দাঙ্গা শুরু করে দেয় আর পাকিস্তানিরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয় সব বাঙালি খতম করো। সালেহা চৌধুরী স্বামীসহ তাঁর ভাইকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে নিরাপদ আশ্রয়ে রওয়ানা হলেও ফেনীর কাছাকাছি সোনাগাজীতে এসে পাক সেনাদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয় সেখানেই তাঁরা তিনজন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজে লেগে গেলেন। গোলাম হোসেন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের কাজে অংশগ্রহণ করলে সালেহা বেগমও পাড়া পাড়া থেকে মুক্তি বাহিনীর জন্য খাবার সংগ্রহ করে ও পুরনো কাপড় সংগ্রহ করে নানা কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। কিন্তু ১০ নভেম্বর রমজান মাসে পাহাড়তলী বধ্যভূমি তো অনেকের সাথে সালেহা চৌধুরীর স্বামী গোলাম চৌধুরীকে জল্লাদ বিহারীরা জবাই করে হত্যা করে। দেশকে ভালোবেসে হাজার হাজার মানুষের সাথে তিনি শহীদ হলেন।
১১)আতিফা মাওলা:
আতিফা মাওলা ও তাঁর স্বামী ছিলেন শুটার। তাঁরা দুজনেই মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরুষ ও নারীদের এবং ছাত্রীদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেন। এলাকার কিছু রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ছাত্র-যুবকদের সাথে মিটিং করে সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাঁর স্বামী এনায়েত মাওলা দায়িত্ব নেন বন্দুক রাইফেল সংগ্রহ করা ও ট্রেনিং নেওয়ার। এ কাজটি করেন ছোট কুমিরার অদূরে জনৈক ব্যবসায়ী করিম সাহেবের পাহারায় খামারবাড়িতে। সেখানে বন্দুক রাইফেল চালানোর ট্রেনিং দেওয়া হয় মার্চের ২ তারিখ থেকে ট্রেনিং শুরু হয় আর আত্মগোপনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী ও নারীদের উৎসাহিত করতেন ট্রেনিং এর জন্য। ৫ থেকে ১০ মার্চের এর মধ্যে মোট ২০ জন মেয়েকে ট্রেনিং দেন। এদের মধ্যে ছিলেন জাহানারা আঙ্গুর, ডাক্তার নুরুন্নাহার জহুর এবং রওশন আরা হক প্রমুখ। ষোলশহরের একটু ভিতরে পাহাড় ঘেরা এক নির্জন জায়গায় আতিমা মেয়েদের ট্রেনিং দেন মার্চের ৯ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত।
মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ই তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন ।কখনো যোগাযোগ রেখে, তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখা, তাঁদের সেবা-শুশ্রূষা করা এবং আশ্রয়ের গোপন আস্তানা ঠিক করে দেওয়া ।উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঘাটির উপর হামলার প্রস্তুতিকালে তাতে জড়িত মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নেওয়ায় তাঁদের বাঁচানোর জন্য অবাঙালি নেভাল অফিসার লে. কমান্ডার মজিদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা ও তার সাহায্য গ্রহণ করার মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন তাঁরা।
১২) রিজিয়া বেগম ও তাঁর দুই মেয়ে, জাহানারা আক্তার ও মনোয়ারা আক্তার:
রিজিয়া বেগম চট্টগ্রামের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অবিস্মরণীয় একটি নাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় উত্তাল মার্চ মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙরকৃত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করে শহরে পাক সেনাদের নিয়ে যাওয়ার পথের সবার সাথে মিশে প্রথম ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর তখন তিন মেয়ে ও চার ছেলে। দুই মেয়ে বড় জাহানারা আক্তার জানু ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীও। মেজো মনোয়ারা ছাত্রলীগ কর্মী । চট্টগ্রাম বন্দর এর জাহাজ থেকে পাকিস্তানিরা অস্ত্র চালান করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার সময় পাড়ার ছেলেসহ ও তাঁর ছেলেমেয়ে সহ তিনি রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছিলেন। সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। শুধু ব্যারিকেড নয় আন্দোলনকে তীব্র করতে নানাভাবে সাহায্য করেছেন রিজিয়া বেগমসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা। যেই ব্যারীকেড দেখে ২৫মার্চ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরাও ফিরে গিয়েছিলেন। যারা মূলত অস্ত্র খালাস করে যাচ্ছিলেন তারা এলাকার লোকদের দেওয়া ব্যরিকেড দেখে ফিরে গেলেন। এদের মধ্যে মেজর জিয়া ছিলেন তাঁর সাহসী মেয়ে জাহানারা ও মনোয়ারা এবং তাদের সাথে অনেক ছাত্রী ছিল। ছাত্রলীগ নেত্রী জাহানারা আক্তার এর নেতৃত্বে প্রাক্তন পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় লালখানবাজার পুলিশ লাইনের পেছনে পাহাড়ঘেরা জায়গায় খুব গোপনে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। রিজিয়া বেগমের স্বামী জামাল উদ্দিন মোল্লাকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে গেল। ভাগ্যের জোরে তিনি বেঁচে যান। জাহানারা ও মনোয়ারা আক্তার গ্রামে গিয়ে তাঁরা দুই বোন নতুনভাবে কাজ শুরু করলো। কমলা গ্রামের মেয়েরা আগে থেকে সংগঠিত ছিল। সেখানে তাঁদের সাথে তাঁরা দুই বোন ঢেঁকিতে ধান ভেঙে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার পাঠাতেন আবার শীতের কাঁথা তৈরি করতেন। যখন দুই একটা গ্রাম মুক্ত হতে লাগল তাঁরা সেই মুক্তাঞ্চলে গ্রামে বিধ্বস্ত স্কুল পাঠশালায় ছেলে মেয়েদের পড়ানোর দায়িত্ব নিল। আর গোপনে দেশের কাজ করতে লাগলো। কমলা গ্রামের মেয়েদের সাথে তারা খেয়া পারাপার করে মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ডারে পৌঁছে দিত। আর তারা স্থানীয় লোকজনদের প্রতিরোধে ট্রেনিং দিয়েছিলেন ।এক ভিখারি ভিক্ষা করার ছল করে সেনাবাহিনীর খাবার সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দিতেন।
১৩) জাহানারা আঙ্গুর:
স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অগ্নিশিখার নাম জাহানারা আঙ্গুর। তিনি ছাত্রজীবনে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। ৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণ এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আর এরই সাথে একাত্ম ঘোষণা করে তিনি সিটি কলেজের ছাত্রীদের সংগঠিত করে গোপন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করলেন। এই ট্রেনিং এ তাকে সহযোগিতা করেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন। ট্রেনিং চলত লালখানবাজারের ভিতরে বাঘঘোনার পিছনে একটা পাহাড় ঘেরা জায়গায়। এই ট্রেনিং এর প্রথম দফায় ছিল বন্দুক রাইফেল চালানো শুরু। কিভাবে হামলা করতে হবে কিভাবে ক্রস করে এগিয়ে যেতে হবে অথবা শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে কিভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে ইত্যাদি। দ্বিতীয় দফায় ট্রেনিং হলো আতিমা মাওলার নেতৃত্বে। এদের সাথে যুক্ত হলো ডাক্তার নুরুন্নাহার জহুরসহ অনেক বয়স্ক নারী।যারা একই সাথে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন। জাহানারা আঙ্গুর ৩০ মার্চ তার দাদার বাড়ি মিরসরাই থানার গাছবাড়িয়া গ্রামে এক প্রকার আত্মগোপন করেন। এখানে এসে তিনি গোপনে নব উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন কাজ পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে ভারতে পাঠাতেন ট্রেনিং দিতে। ট্রেনিং শেষে অপারেশনে এলে তাদেরকে বিভিন্ন গোপন সংবাদ দিয়ে সহযোগিতা করতেন। তিনি সরাসরি দেশের মাটিতে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। পাকহানাদারদের রাজাকাররা তাঁর গোপন অবস্থানের কথা জানতে পারলে গ্রামের নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার চালাতে শুরু করলে তিনি সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে গোপনে নানাবাড়ি বড়তাকিয়াতে আশ্রয় নেন। সেখানেও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাক হানাদার বাহিনীর খবর পৌঁছানোর রসদ সরবরাহ করা যোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন এভাবে তার অসীম সাহসে হানাদার বাহিনী পরাজিত হলে একের পর এক গ্রাম মুক্ত হয় ।বিধ্বস্ত গ্রামগুলোতেও তিনি নতুন উদ্যোগে কাজ করেন সবাইকে নিয়ে তিনি গাছের ডালে স্বাধীনতা দেশের পতাকা উড়ানো ঘরবাড়ি গড়ে তুললেন। শরণার্থীদের পুনর্বাসন করলেন স্কুল কলেজ নির্মাণ করে গ্রামগুলোকে নতুন করে সাজিয়ে তুলেন প্রদীপ্ত অগ্নিশিখা তোমাকে সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা।
১৪) রায়হানা শফি:
রায়হানা শফী আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর যোদ্ধা। তিনি তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ছিলেন। ডাক্তার নুরুন্নাহার জহুরের সহায়তায় তিনি রেল ও শ্রমিক পাড়ায় পাহারার কাজ করে। তিনি শেখ মুজিবের স্নেহধন্য ছিলেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় তিনি ও তার স্বামী মোঃ শফি আহমেদ যিনি ইস্টার্ন রেলওয়ে অফিসার ছিলেন তাঁরা দুজনই দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাদের পরিবারের অনেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান, মান্নান সাহেব, শফি আহমেদ এর খালাতো ভাই কর্নেল এম আর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আমিন এবং তৎকালীন রেলওয়ে ডেপুটি সুপার মকবুল আহমেদ এরা সবাই স্বাধীনতা আন্দোলনে একসাথে শরিক হয়ে গোপন মিটিং করতেন। আর গভীর রাত অব্দি চলত মিটিং। সেই মিটিং-এ নিরলস চা বানিয়ে খাওয়ানো চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা বাঙালি অফিসারদের বাড়িতে গিয়ে গোপনে সংবাদ আনা এই সবই তিনি করেছেন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় দুর্বল শরীর নিয়ে। বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা ছিল মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের একটি সাধারণ ঘটনা । এই দাঙ্গা থামাতে তারা স্বামী-স্ত্রী একসাথে কাজ করেন আর মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে ছিল তাদের ব্যক্তিগত টয়োটা করোলা গাড়িটি। ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের নির্দেশও বানচাল করে দেন। যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়া। সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাসের অর্ডারকে প্রত্যাখ্যান করলেন তারা এবং পাল্টা প্রস্তুতি নেয়ার পরিকল্পনা করেন। এই অভিযানের মেসেজটা ছিল লাল ফিতা যেন না ছাড়ে। রেলওয়ের ডেপুটি পুলিশ সুপার মকবুল আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী মিসেস মকবুল। লালফিতা যেন ছাড়েন এই মেসেজটি সকলের কাছে পৌঁছে দেন। যা ক্যাপ্টেন আমিন তাকে ফোন মারফত জানান। রায়হানা মনে হলো এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ লালফিতা যেন না ছাড়েন অর্থাৎ অস্ত্র যেন না ছাড়েন। শহীদ হলেন কর্নেল এম আর চৌধুরী। ২৬ মার্চ পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল তখন মেজর রফিক এর নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনী তৈরি করে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সকলের সারাদিন রাতের খাবারের ব্যবস্থা করলে রায়হানার সাথে সহযোগিতা করলেন অন্যান্য অফিসারের বউরা ২৩ শে এপ্রিল হানাদাররা তাঁর স্বামী শফি সাহেবকে ধরে নিয়ে গেলে তাকে নির্যাতন করে বাসায় গিয়ে নেতারা লুটতরাজ করে আবার শফি সাহেবকে অজানার উদ্দেশ্যে নিয়ে গিয়ে ফয়েজ লেক বধ্যভূমিকে হত্যা করেন । এই শহীদের লাশও রায়হানা খুঁজে পেলেন না গণকবর থেকে পেলেন শুধু অনেকের মধ্যে কিছু হাঁড়গোড় আর তাঁর রক্তাক্ত শার্ট এর টুকরা দিয়ে তিনি শহীদের কবর স্থান লিখে রাখলেন। যার অবশিষ্ট অংশ আজ চক্ষু হাসপাতালের দখলে। এই হল একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি আমাদের সম্মান। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন নভেম্বরে তার কন্যা সন্তান জন্ম নেয় যে দেখিনি তার বীরযোদ্ধা বাবাকে বাবা দেখিনি তার আদরের সন্তানকে। এই দম্পতিকে হাজার প্রণতি।
১৫) দিলারা ইসলাম:
দিলারা ইসলাম ও তার স্বামী ডাক্তার তারেক মঈনুল ইসলাম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় যোদ্ধা। তাঁদের বাড়িতে ইপিআর বাহিনীর লোকেরা আসলে সেখান থেকে টেলিফোন মারফত উর্ধ্বতন অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করতে সহযোগিতা করেছিলেন । তাঁরা দুজনই আনসার বাহিনীর লোকদের খাওয়া থেকে শুরু করে সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন মার্চের ২৯ তারিখ যখন পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রাম শহর পুনর্দখল করেছে হানাদার বাহিনীর কঠিন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা দুজনে একদিকে ওদের ঘরে আত্মগোপন করে রাখবেন আর অন্যদিকে অবাক করার মত ব্যাপার হানাদার বাহিনীকে ছলে বলে কৌশলে তাদের বাড়িতে আপ্যায়ন করে বিভিন্ন গোপনীয় খবর সংগ্রহ করে তা মুক্তিবাহিনীকে সরবরাহ করতেন। প্রতিপক্ষের হাতে নিয়ে তারা দেশের সেবা করে গেছে তাঁরা দুজনে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতেই মুক্তিবাহিনীকে বাড়ি বাড়ি থেকে চাল ধার করে এনে তাদের রান্না করে খাওয়ানো এবং গোপন পথে তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিত। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ডাক্তারের চিকিৎসা সেবা দিতেন সাহায্যকারী হিসেবে ডাঃ ইসলাম। তাঁকে নার্স হিসেবে সাহায্য করেন তিনি। আর তার সাথে হানাদার বাহিনীকে সামাল দিতেন। অথচ ডাঃ ইসলামকে মুক্তিযোদ্ধারা উর্দু জানার কারণে আর অবাঙালি ভেবে ধরে নিয়ে একদিন আটকে রেখেছিলেন যদিও তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এই দুই যোদ্ধাকে শ্রদ্ধা প্রণাম ভালোবাসা জানাই।
১৬) রমা চৌধুরী ও অন্যান্যরা:
শিক্ষাব্রতী এবং লেখক রমা চৌধুরী তাঁর নিজের বাড়ি চট্টগ্রামের পোপাদিয়ায় ১৯৭১ সালের ১৩ই মে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হন।
প্রণব কুমার বড়ুয়ার মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি সমপ্রদায় গ্রন্থ থেকে জানা যায় কয়েকজন মহিলা নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তাঁরা হলেন ননীবালা বড়ুয়া, প্রতিমা বড়ুয়া, রেণুকণা বড়ুয়া, সুনিতা বড়ুয়া ও অমিতা বড়ুয়া।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী কুন্দ প্রভা সেন একাত্তরে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। যার উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁর মেয়ে প্রিয়ন্তী সেনগুপ্তার রচিত ফিরে দেখা ৭১এ। চট্টগ্রামের পটিয়া ও বোয়ালখালী থানার বিভিন্ন অঞ্চলে পাক হানাদার বাহিনীরা বাড়িঘর আক্রমণ করে লুটতরাজ করে সেখানে আগুন লাগিয়ে দিয়ে মেয়েদের ধরে নিয়ে যেতো এবং তাদের শারীরিক নির্যাতন করত। জেলার জোরারগঞ্জ এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল সেখানে স্থানীয় একটি স্কুলে ১০০ জন মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল এবং ঐ শিবিরের ৭০০ জন জোয়ান হানাদারদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শহীদ হন ৩০ বীরঙ্গণা মাতা। অনেক এলাকার মেয়েরা পাকহানাদাররা নারীদের যখন বাসা থেকে বের করে ধর্ষণ করতো এবং আগুন ধরিয়ে দিত তখন মেয়েরা নিজেদের রক্ষার জন্য সেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল।
১৭) জোহরা বেগম:
জোহরা বেগম চট্টগ্রাম এর একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা । উনি সরাসরি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেননি কিন্তু তিনি ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের একজন বীরঙ্গনা। তখন তার বয়স চৌদ্দ পনের বছর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ক্যাম্পে নির্যাতন করেন। রাতভর তাঁর উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে পরদিন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাকে নিয়ে আসা হয়।মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতি তিনি আজীবন বইয়ে বেরিয়েছেন। তাঁর সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা এল।এমন বীরমাতার প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হই।
১৮) চাইন্দাউ মারমা:-
চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকার কথা আসলেই আমাদের আদিবাসী যোদ্ধা খাগড়াছড়ির চাইন্দাউ মারমার নামও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। একাত্তরেই বীরমাতা নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। ৭১ সালের জৈষ্ঠ্য মাসের মাঝামাঝি সময় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসররা থৈসাপ্রুকে ধরে নিয়ে যায়। কৌশলে তিনি পালিয়ে গেলে পাকিস্তানিরা বাড়িতে এসে তার বড় বোন চাইন্দাউকে ধরে নিয়ে যায়। এখনকার মহালছড়ি সোনালী ব্যাংকে ও আশেপাশের এলাকা তখন পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেখানে আটকে রেখে তাঁকে প্রায় দুইমাস নির্যাতন করা হয় তাঁর উপরে। বীরমাতা দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের সম্ভ্রম দিয়েছেন । প্রণাম মাকে।
অন্যান্য:
শ্রীমতি নিরবালা দেবী ও চট্টগ্রামে দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামের নাথপাড়া ও আবদুর পাড়ার নারীরা মুক্তিসংগ্রামের সাহসী ভূমিকা রাখেন। তাদের নেতৃত্ব দেন নিরবালা দেবী। তিনি একাত্তরে এক জ্বলন্ত শিখা। হানাদার বাহিনীরা তাকে উঠানের খুঁটির সাথে বেঁধে তার শ্বশুর,,স্বামী ও দুই পুত্রকে হত্যা করে তাদের রক্ত দিয়ে নিরবালা দেবীকে স্নান করিয়েছে।
২৫ মার্চ যখন গণহত্যা শুরু হয় আর ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণার সাথে সাথে আব্দুর আর নাথ পাড়ার হিন্দু-মুসলমান সকলে মিলে ঘরে ঘরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ঘরে ঘরে ইট-পাথরের টুকরা আর চুলায় ২৪ ঘন্টা বড় বড় ডেকচিতে গরম জল এবং শুকনো মরিচ গুঁড়া রাখা হত।এসবই ছিল প্রাথমিকভাবে শত্রুকে মোকাবেলার প্রস্তুতি। এসবের নেতৃত্ব দেন নিরবালা দেবী শুধু এসব নয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআর সদস্যদের জন্য ভাত তরকারি রান্না করে তা পৌঁছে দিত । হানাদার বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে ইপিআর বাহিনীর যখন যুদ্ধের রসদ ফুরিয়ে যায় তখন তাঁরা নাথপাড়া ও আবদুর পাড়ায় আশ্রয় নেয়। ৩১ মার্চ রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনী এখানে হামলা চালায় আর রাজাকার বাহিনী তথা বিহারীরা যাকে সামনে পেল তাকে হত্যা করল। নীরবালা দেবীর কলেজ পড়ুয়া ছেলে বাদল কান্তি নাথ ও দুলাল কান্তি নাথকে যারা আগে থেকে মুজিব আদর্শের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল তাদেরকে সহ নিরবালা দেবীর শ্বশুরকে এবং তার স্বামী ফিরোজ রঞ্জনকে মাথা কেটে হত্যা করল। খুকু রানী ও স্বপ্নরানীকে নির্যাতন করা হলো। রক্ত দেখে তাঁরা মূর্ছা গেল। ভাগ্যক্রমে মামা বাড়িতে থাকা তার দুই ছেলে বেঁচে গেল। নীরবালা দেবীকে বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন করলেন। খুকু রানী যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন। শেফালী প্রভাদেবী ও তাঁর স্বামী বনমালী দেবনাথ। শেফালী প্রভাদেবী ৩১ মার্চ যুদ্ধরত ইপিআর বাহিনীর জন্য রান্না করেছিলেন তখনই রাজাকাররা হানাদার বাহিনীকে নিয়ে পাড়ায় আক্রমণ করলে স্বামীসহ দুই কন্যাকে নিয়ে তাঁরা প্রাণ বাাঁচতে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেখানে তাঁদেরকে গুলি করে হত্যা করে এবং শেফালী প্রভাদেবীকে পুকুর থেকে তুলে এনে জ্ঞানহীন অবস্থায় তাকে বুলেটের আঘাতে মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে কিনা পরীক্ষা করে। তিনি যুদ্ধে তাঁর চোখের দৃষ্টি হারান। তাঁদের সকলের অপরাধ ছিল তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন আর একজন নিরু দেবনাথ। তিনিও সেদিন গোলাগুলির মধ্যে পড়েন হাতে গুলি লেগে জ্ঞান হারান। তিনি নাথপাড়া ও আবদুর পাড়ায় দুর্বৃত্তদের নির্যাতনের জ্বলন্ত সাক্ষী যা কখনো ভুলবার নয়। শয়তানরা এই দুই পাড়াকে শ্মশানভূমি বানিয়ে ফেলতে চেয়েছিল। মায়ের কোল থেকে মায়ের সামনে শিশুকে কেটে নিয়ে তরবারিতে গেঁথে মেরেছে। আর মাকে রাইফেলের বাট দিয়ে মেরে বুট জুতা দিয়ে মেরেছে। এভাবে নিলু দেবনাথের বাবা-মা-ভাই-বোন সকলকে হত্যা করেছেন। বাংলার বাণীর প্রতিবেদন থেকে আমরা অনেক তথ্য পাই। -ডাক্তার ডেভিস বলেন- চট্টগ্রামে আমি একজন মহিলাকে দেখেছি। তিনি বিধবা যুদ্ধে তাঁর বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। তার সন্তান দুটি এবং তিনি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গর্ভপাত ঘটানোর পর এই মহিলার থাকার মত স্থান নেই। ছেলেমেয়েদের আহার জোগানোর কোন সংস্থান নেই।’
প্রীতিলতার পথ ধরে চট্টগ্রামের নারীরা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষ ওপরোক্ষভাবে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এই সময় বস্তুত তাঁরা আত্মনির্ভর, সাহসী, কর্মঠ এবং ত্যাগী যোদ্ধারূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। আসলে লেখকের কলমের কালি দিয়ে, শব্দের নির্দিষ্ট গণ্ডিতে কখনো এই মহান ও সাহসী যোদ্ধাদের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। এই ইতিহাস সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করতে অনন্তকাল লেগে যাবে। বীর চট্টগ্রামে নারী যোদ্ধাদের প্রতি রইল হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তোমাদের স্থান কোন মাটির বেদীর শহীদ মিনারে নয়। তোমাদের স্থান হোক এদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। স্বাধীনতার রক্তিম ইতিহাসের পাতায় তোমাদের নাম লেখা থাকবে অশ্রুসিক্ত নয়নের জলে।
তথ্যসূত্র: ১. মুক্তিযুূদ্ধে চট্টগ্রামের নারী : বেগম মুশতারী শফী, ২. আমি বীরাঙ্গনা বলছি : নীলিমা ইব্রাহীম, ৩. মুক্তিযুদ্ধে নারী : মালেকা বেগম, ৪. বীরাঙ্গনাদের জীবন-সংগ্রাম : ইসহাক কাজল, ৫. ফিরে দেখা একাত্তর : প্রিয়ন্তী সেনগুপ্তা।

লেখক : প্রাবন্ধিক; বিভাগীয় প্রধান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, নিজামপুর সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে হবে আধুনিক নগর হিসেবে
পরবর্তী নিবন্ধসহযোদ্ধা