চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে হবে আধুনিক নগর হিসেবে

রেজাউল করিম স্বপন | সোমবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ১:০০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর। সেই জন্য দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ এই চট্টগ্রামের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাই অনেকে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানীও বলে থাকেন। সরকারের রাজস্ব আয়ের সিংহভাগই এখান থেকে হয়ে থাকে। শুধু বাণিজ্যের দিক দিয়ে নয়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শিল্প সংস্কৃতির দিক দিয়েও চট্টগ্রাম অনেক এগিয়ে। সেই বৃটিশ আমল থেকেই চট্টগ্রাম অধিকার আদায় ও শিল্প সংস্কৃতির দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে। তাইতো বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের মাস্টার দা সূর্য সেন ও প্রীতিলতাসহ বেশ কয়েকজন মানুষের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। শুধু তাই নয় বিশ্বখ্যাত গণিত ও ভৌত পদার্থ বিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম ও দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই চট্টগ্রামেরই সন্তান। আরো অনেক দেশ বরেণ্য ব্যক্তি এই চট্টগ্রামে জন্ম নিয়েছেন। কিন্তু দেশের এতো ঐতিহ্যবাহী, শিল্প সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়কারী এই শহরটির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয় নি। এটা চট্টগ্রামবাসীর জন্য সবচেয়ে দুঃখের বিষয়। বিশ্বের যে কোন দেশের সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়কারী শহরের উন্নয়ন চোখে পড়ার মত।এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ব্যতিক্রম। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় সব সরকারের আমলেই উন্নয়নের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বঞ্চিত হয়েছে।এই জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতারা। তাঁরা চট্টগ্রামের সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয়ে খুব একটা আন্তরিক ছিলেন বলে মনে হয় না। সেই জন্য চট্টগ্রাম দিন দিন তার পুরানো ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। একসময়ের চট্টগ্রামের ব্যবসায়ের কেন্দ্রবিন্দু চাক্তাই খাতুনগঞ্জ তার ঐতিহ্য ও জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। এর কারণ কী? আমরা চট্টগ্রামে যারা থাকি তারা কি কখনো বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি? ভাবি নি। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যার প্রধান কারণ হলো নগর পরিকল্পনা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও নীতি নির্ধারণী বিভিন্ন সংস্থার কার্যকরী অফিস চট্টগ্রামে না থাকা। তাই চট্টগ্রামের বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো তাদের হেড অফিস চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা স্থানান্তর করেছেন। এক্ষেত্রে শুধু ব্যবসায়ীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব হেড অফিস চট্টগ্রাম থেকে রাজধানীতে সরানো হয়েছে। যেমন চা বোর্ডের হেড অফিস, বিএসসির হেড অফিসসহ আরো অনেক অফিস। অথচ এই অফিসগুলোসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস এবং নতুন নতুন ব্যাংক বীমার হেড অফিস এখানে হওয়ার দরকার ছিল। অনেক ব্যবসায়ী বলেন, ঢাকায় হেড অফিস না হলে ব্যবসা করা কঠিন। তাদের কথা ফেলে দেওয়ার মত নয়। কারণ আপনাকে বড় কোন ব্যবসার অনুমোদন থেকে শুরু করে ব্যাংক লোনসহ আনুষাঙ্গিক অন্যান্য অনুমোদন পেতে হলে মাসের পর মাস ঢাকায় দৌড়াতে হবে। তাহলে কেন কোন প্রতিষ্ঠান অযথা চট্টগ্রামে হেড অফিস রাখবেন।
দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামে অবস্থিত হওয়ায় আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই চট্টগ্রাম দিয়ে হয়ে থাকে। কিন্তু এর প্রাথমিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ক্ষেত্রবিশেষে অনেকগুলো দপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। যেমন ধরুন সিপি, আইপি, বিনিয়োগ বোর্ড, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর, নারকোটিঙ বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিএসটিআই সহ আরো অনেক বিভাগ বা অধিদপ্তরের অনুমোদন। যার প্রায় সবগুলোর অনুমোদন ঢাকা থেকে সংগ্রহ করতে হয়। অথচ এই অনুমোদনগুলো চট্টগ্রাম থেকে করতে পারলে চট্টগ্রামের গুরুত্ব ও প্রাণচাঞ্চল্য আরো বাড়তো।
আপনি যদি ভ্রমণ বা ব্যবসায়িক কাজে বিদেশ যেতে চান তবে ভিসা থেকে শুরু করে ভ্রমণ পর্যন্ত সবকিছু ঢাকা থেকে করতে হবে। কিন্তু যদি চট্টগ্রামকে পরিপূর্ণ বাণিজ্যিক রাজধানী করতে হয় তবে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টকে পুরাপুরি আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। যাতে করে মানুষ চট্টগ্রাম থেকে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে এখান থেকে বিদেশ যেতে পারে। এতে করে বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের আস্থা বাড়বে।
পুরাপুরি বাণিজ্যিক রাজধানীর সুফল পেতে হলে চট্টগ্রামের রাস্তায় নির্বিঘ্ন চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। যে সব রাস্তা আছে সেগুলোকে সংস্কার করে সুন্দর ও পরিপাটি করতে হবে এবং প্রত্যেকটি রাস্তার বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে কোনো কারণে একটি রাস্তা সাময়িক বন্ধ হলে বিকল্প রাস্তা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। সমুদ্র ও কর্ণফুলী নদীর তীরে রাস্তা ও তাতে দ্রুত যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ শহরটিকে যানজটমুক্ত ও নিরাপদ করতে হবে। ভাল মানের সরকারি বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে চট্টগ্রামের মানুষ চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামের বাইরে যেতে না হয়। চট্টগ্রামের বড় একটি সমস্যা জলবদ্ধতা, তার নিরসন করতে হবে। খাল বিল নদী নালা দখলমুক্ত করে তার গতি প্রবাহ স্বাভাবিক করতে হবে। যাতে করে দ্রুত পানি নেমে যেতে পারে। পুরো শহরকে স্যুয়ারেজের আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ মানুষের জন্য একটি নিরাপদ শহর হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।
বিধাতা চট্টগ্রামকে প্রাকৃতিকভাবে অনেক সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। পর্যটনের মূল উপাদান পাহাড়, সমুদ্র, নদী, বন্দর সবকিছু এখানে রয়েছে।এগুলোকে কাজে লাগাতে পারলে চট্টগ্রাম একটি পর্যটন নগরী হিসাবেও খ্যাতি লাভ করতে পারে। কর্ণফুলী নদী ও পতেঙ্গা সাগরের মোহনায় জাহাজে করে সী ক্রুজের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পাহাড় ও নদীগুলোকে অক্ষুন্ন রেখে পর্যটনের নতুন নতুন বিনোদন কেন্দ্র তৈরী করা যেতে পারে। সীতাকুণ্ড থেকে মিরেরসরাই এলাকায় পাহড়ের ঢালে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট অনেক গুলো ঝর্নায় নিরাপদে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সর্বোপরি দেশী ও বিদেশীদের জন্য নিরাপদ জোন করতে পারলে চট্টগ্রাম ব্যবসা বাণিজ্য, পর্যটনসহ তার হারানো ঐতিহ্য অচিরেই ফিরে পাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান