ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা রুখতে কতিপয় সুপারিশ ও প্রস্তাবনা

ড. এম. এন. আলম | রবিবার , ১৯ মে, ২০২৪ at ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ

প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম। গত ২ সপ্তাহে ৭ থেকে ১৪০ শতাংশ ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে মর্মে গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের প্রতিবেদন সংযুক্ত করে কনজুমারস এ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব) গত ২৯ এপ্রিল ২০২৪ হাইকোর্টে একটি রীট পিটিশন দায়ের করে। উক্ত মামলায় সব ধরনের ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি রোধ কল্পে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ প্রদানসহ রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। বর্তমানে দেশে ৩১০ টি এ্যালোপ্যাথিক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ সাম্প্রতিক কালে ঔষধের মূল্য বৃদ্ধির জন্য বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, সহ বিভিন্ন ইউটিলিটিজ এর মূল্য বৃদ্ধি, বিশ্ববাজারে ওষুধের কাঁচামাল, মার্কেটিং খরচ সহ ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন। ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের সংগঠন Bangladesh Association of Pharmaceutical Industries (BAPI)) বিভিন্ন ফোরামে ঔষধের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করে আসছেন। দেশে ঔষধের বাজার প্রায় ত্রিশপয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার। ঔষধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি সমূহ ৪১৮০টি জেনেরিকের ৩৫,২৯০টি ব্র্যান্ডের ঔষধ উৎপাদন করে থাকে। তৎমধ্যে প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের ১১৭ টি জেনেরিকের ওষুধের মূল্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। বাকি সকল ওষুধের মূল্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি সমূহ নির্ধারণ করে ভ্যাট প্রদানের নিমিত্তে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে অনুমোদন এর জন্য প্রেরণ করে থাকে।

১৯৮২ সালে প্রণীত ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ এর ১১ ধারার বিধান মতে সকল ঔষধের মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করার কথা থাকলেও সদ্য প্রণীত ঔষধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩ এর ৩০() () ধারার বিধান মোতাবেক শুধু মাত্র গেজেটে প্রকাশিত তালিকাভুক্ত ঔষধ সমূহের খুচরা মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে । ফলশ্রুতিতে ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানী সমূহ ইচ্ছেমত ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছে বলে ভোক্তাগন অভিযোগ করে আসছেন। তাই ১৯৯৪ সালে জারিকৃত গেজেট সংশোধন করে ১১৭ টি জেনেরিকের পরিবর্তে মোট ঔষধের এক তৃতীয়াংশ অত্যাবশ্যকীয় ঔষধের তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে বিজ্ঞমহল মত প্রকাশ করেন।

অধিকাংশ ঔষধ উৎপাদনের কাঁচামাল (Raw Materials) বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। তাছাড়া লেবেল কার্টুন, মোড়ক সামগ্রী এবং মার্কেটিং খাতে উল্লেখ যোগ্য অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। কোম্পানি সমূহ গেটআপ আকর্ষণীয় করতে চকচকে মোড়কে ওষুধ বাজারজাত করে থাকে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব ড. মো: আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক সভায় মোড়ক সামগ্রীর চাকচিক্য পরিহার করে ওষুধের মূল্য কমাতে মন্তব্য করেছিলেন-“মানুষ প্যাকেট খাবে নাকি ঔষধ খাবে”? তাই সরকারি বেসরকারী হাসপাতাল সহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান সমূহের ১০০ ওষুধের বক্সের এর পরিবর্তে ১০০০ ট্যাবলেট/ক্যাপসুল এর টিন বা প্লাসটিক কন্টেইনারে সরবরাহ করা হলে প্যাকেজিং খাতে খরচ অনেক কমে যাবে।

১১৭টির পরিবর্তে ১/৩ ভাগ ঔষধের তালিকা প্রণয়ন।

১০০০ ট্যাবলেট/ক্যাপসুল কনটেইনারে সরবরাহ।

গজ এর পরিবর্তে ডিজিটাল মার্কেটিং চালু করা।

ট্রেড নামের বদলে জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন।

মূল্য নির্ধারণে স্বাধীন কমিশন গঠন।

প্রায় সকল বড় কোম্পানি Medical Representative (MR) এর মাধ্যমে ঔষধ মার্কেটিং করে থাকে। শুধু জেলা বা উপজেলা নয় এমনকি গ্রামের বড় বড় বাজারে পর্যন্ত কোম্পানি সমূহের মার্কেটিং নেটওর্য়াক MR এর মাধ্যমে বিস্তৃত রয়েছে। যার সংখ্যা কয়েক লক্ষ হতে পারে। এ সকল জনবলের বেতনভাতা, মোটর সাইকেলের জ্বালানি উৎপাদিত ঔষধের মূল্যের সাথে মার্কেটিং খরচ হিসেবে সমন্বয় করা হয়ে থাকে।

বর্তমান সরকারের Smart Bangladesh গড়ার প্রত্যয়ে অফিস সমূহ ইতিমধ্যে পেপারলেস করা শুরু হয়েছে। এখন বিয়ের দাওয়াত কার্ড ও ইমেইল, হোয়াটসঅপ এর মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়। তাই ডিজিটাল মার্কেটিং এর মাধ্যমে সম্মানিত চিকিৎসক বৃন্ধের নিকট কোম্পানি সমূহ তাদের উৎপাদিত ঔষধের প্রচার প্রচারণা সহজেই করতে পারে। ফলে মার্কেটিং খরচের বিরাট অংকের অর্থ সাশ্রয় হতে পারে। যা ঔষধের মূল্য বহুলাংশে কমাতে সহায়ক হবে।

ঔষধের কোম্পানি সমূহ ডাক্তারদের ফ্ল্যাট, গাড়ী, বিদেশ ভ্রমণসহ নানান ধরনের উপহার সামগ্রী প্রদান করে তাদের ঔষধ প্রেসক্রাইব করেন বলে দীর্ঘ দিনের পুরনো অভিযোগ রয়েছে। যার ব্যয়ভার ভোক্তাকে পরিশোধ করতে হয় উচ্চ মূল্যে ঔষধ ক্রয়ের মাধ্যমে। উন্নত বিশ্বের মত ট্রেডনামের পরিবর্তে Generic নাম (সকল কোম্পানির ঔষধের একই নাম হবে যেমন Paracetamol) প্রেসক্রিপশন করার বিধান করা যেতে পারে। ফলে কোম্পানি সমূহের মধ্যে ঔষধ মার্কেটিং এর অসুস্থ প্রতিযোগিতা (Unethical Practice) বন্ধ হবে এবং ওষুধের দাম অনেকাংশে কমে যাবে।

সর্বোপরি ঔষধের মূল্য নির্ধারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, BMA, BAPI, CAB, BCDS, সহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন শক্তিশালী কমিশন গঠন করে সময়ে সময়ে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। ফলশ্রুতিতে ঔষধ কোম্পানি সমূহের ইচ্ছেমত ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা কমে যাবে। দেশের জনগণের ন্যায্য মূল্যে মানসম্মত ওষুধ প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সহ ওষুধ সেক্টরের সুনাম বৃদ্ধি পাবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।

লেখক : সাবেক উপপরিচালক ও আইন কর্মকর্তা,

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ