এক ও অনন্য কমলা ভাসিন

শাফিনূর শাফিন | শনিবার , ২ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

নারীর সম্মান তার যোনীতে থাকে না- এই স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে কমলা ভাসিন প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতার পরে নারীর সম্মানহানির ধারণাকে। নারীর প্রতি ঘটা সামাজিক নানা অনিয়ম, অবিচার এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই চালিয়ে যাওয়া কমলা ভাসিন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে হেরে গেলেন ২৫ সেপ্টেম্বর। ভাসিনের জন্ম ২৪এপ্রিল, ১৯৪৬ সালে। জন্মের ঠিক এক বছর পরই দেশভাগ হয় যার জন্য নিজেকে তিনি বলতেন ‘মধ্যরাতের প্রজন্ম’ কারণ ৪৭’এর আশপাশে যাদের জন্ম তারা দেখেছে কীভাবে রাতারাতি দেশের নাম বদলে যায়, কীভাবে চেনা লোকজন ‘অন্য’ কেউ হয়ে যায়। তিনি ছিলেন ছয় ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ। ডাক্তার বাবার কল্যাণে তাঁর বড় হয়ে উঠা রাজস্থানের গ্রামাঞ্চলে যা তাকে ভারতের গ্রামের নারীদের বিভিন্ন সমস্যা বুঝতে সাহায্য করেছিল।
ভাসিন কাজ করেছেন সেবা মন্দির, ইউএন এবং বেশকিছু সংস্থায়। ভাসিন ২০০২ সালে ইউএনের কাজ ছেড়ে দেন এবং সঙ্গত নামের একটি নারীবাদী সংগঠনের কাজ শুরু করেন। ভাসিন বিশ্বাস করতেন দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের উন্নয়ন সম্ভব যদি তাদের মধ্যে পারস্পরিক নেটওয়ার্ক তৈরি করা যায়। এই যোগাযোগের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা তাদের সামাজিক এবং দেশীয় প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সমস্যা পরস্পরের সাথে কথা বলে সমাধানের লক্ষ্যে সবাই একযোগে কাজ করলেই নারীমুক্তি এবং নারী উন্নয়ন সম্ভব। ভাসিন এই
ক্ষেত্রে আর সব নারীবাদীর চাইতে একদমই আলাদা ছিলেন কারণ তিনি স্বপ্ন দেখতেন নির্দিষ্ট দেশ নয় বরং দক্ষিণ এশিয়ার সকল নারীর আর্থসামাজিক পরিবর্তন। কারণ একটি দেশের নারীর অবস্থা পরিবর্তন কখনোই সুখকর নয় যদি পাশের দেশের নারীরা পিছিয়ে থাকে। সঙ্গতের ভাবনাটা তাই এখানে অনেকটাই ভগ্নীত্ববোধ প্রকাশ করে থাকে। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারীবাদে বিশ্বাসীদের প্রথমে বুঝতে হবে পিতৃতন্ত্র কী এবং কেন, জেন্ডার সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। এইজন্য সঙ্গতে একমাসব্যাপি কোর্স চালু হয় ১৯৮৪ সাল থেকে। এই কোর্সে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশ থেকে নির্বাচিত নারীরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং জ্ঞান অর্জন করেন।
তিনি যে শুধুমাত্র নারীমুক্তির বা নারীর উন্নয়নের কথা বলতেন তা নয়, বরং তিনি পুরুষদেরও মুক্তি চাইতেন। সামাজিক ও পিতৃতান্ত্রিক প্রথা কীভাবে পুরুষের জন্যও ক্ষতিকারক তা তিনি দেখিয়ে গেছেন। ভাসিন বলতেন, ‘নারীবাদ নারী-পুরুষের মধ্যে কোন লড়াই নয় বরং এটা আইডিওলজির বা বিশ্বাসের লড়াই বলা যেতে পারে। যেখানে একটা আইডিওলজি পুরুষকে মাথায় তুলে রাখে এবং তাদেরকে ক্ষমতা দেয়, আর অন্যটা নারীপুরুষের মধ্যে সমতার কথা বলে।’
ভাসিন ছিলেন সেইসব নারীবাদীদের একজন যারা শুধুমাত্র বই বা তত্ত্ব সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনায় নিজেদের আটকে রাখেননি বরং পথে নেমে সরাসরি কাজ করেছেন। এইজন্য কমলা ভাসিনকে বলা হয় আধুনিক দক্ষিণ এশীয় নারীবাদের অন্যতম পুরোধা যিনি বদলে দিয়েছেন নারী এবং পুরুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী। নারী আন্দোলন নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নারী আন্দোলন বিভিন্নভাবে হতে পারে। এনজিওর নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে যে কার্যক্রম তাও নারীবাদী আন্দোলনের অংশ। তার কাছে সবাই সমান ছিল নারী আন্দোলনের প্রসঙ্গে, পার্থক্য করতেন না কে কীভাবে কোন অবস্থান থেকে কাজ করছে- তা সরকারি প্রতিষ্ঠান হোক বা এনজিও হোক বা নিজস্ব ক্ষেত্র। হিন্দুস্থান টাইমসে একবার তিনি লিখেন, ‘মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য সাংস্কৃতিক সুনামির দরকার। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের আগে, আমাদের স্বাভাবিকভাবে নেয়া হয় এমন অসংখ্য ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত চর্চাকে নির্মূল করতে হবে। যেমন ‘পতি’ বা ‘স্বামী’ শব্দগুলো ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এগুলোর অর্থ মালিক বা প্রভু বোঝায়। স্বাধীন ভারতে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর কোন মালিক বা প্রভু থাকতে পারে না। এমন আরও বহু শব্দ ও অভিব্যক্তি আছে যেগুলো নারীর প্রতি অবমাননাকর এবং অপমানজনক। এগুলোকে আমাদের চিন্তাভাবনা থেকেই সমূলে উৎপাটন করতে হবে।” ভাসিনের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা সামাজিক বিশ্বাস ও প্রথার শিকলে বন্দী যেগুলো পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। নারীকে সবসময় দমানো হয় এই অঞ্চলে ‘এটা তো আমাদের সংস্কার, আমাদের রেওয়াজ’ বলে। ধর্মকে টেনে এনে এসব প্রথা ও বিশ্বাসকে আরও পাকাপোক্ত করা হয়ে থাকে। ভাসিন নারীবাদকে পশ্চিমের নিজস্ব ধারণা মানতে নারাজ ছিলেন। ভারতীয় নারীবাদ এখানকার নারীর নিজস্ব যন্ত্রণা ও অবক্ষয়ের বহু বছরের ইতিহাসের মধ্যেই প্রোথিত আছে। তিনি এইজন্যই বলেছেন, পিতৃতন্ত্র শুধুমাত্র নারীর জন্য ক্ষতিকর তা নয়, এটি পুরুষের জন্যও সমান ক্ষতিকর যার ফলে তারা ঠিকঠাক মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। তিনি বলেন, ‘আমি প্রচুর নারীকে জানি যারা পিতৃতান্ত্রিক, নারীবিরোধী, অন্য নারীর সাথে নোংরামি করে থাকে; আবার আমি এমন প্রচুর পুরুষ দেখেছি যারা আজীবন নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। নারীবাদ কোন জৈবিক বিষয় নয়, এটি একটি বিশ্বাস।’ ভাসিন বেশ সরব ছিলেন ক্যাপিটালিস্ট পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তিনি বলতেন এটা নারী শরীরকে বস্তুতে পরিণত করে।
ভাসিন যেসব বই এবং বুকলেট লিখেছেন তার প্রায় সবগুলোতেই তিনি সহজ করে নারীবাদ, পিতৃতন্ত্র এবং জেন্ডার নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই বইগুলো প্রায় ৩০টা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ভাসিনের লেখা বইগুলোর মধ্যে হোয়াট ইজ প্যাট্রিয়ার্কি, বর্ডার্স এন্ড বাউন্ডারিজ, আন্ডারস্ট্যান্ডিং জেন্ডার এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিং মাস্কুলিনিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কমলা ভাসিন ভারতে কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর লেখা ‘আজাদী’ কবিতাটি যেখানে তিনি নারীমুক্তির কথা বলেন তা পরবর্তীতে ভারতের বিভিন্ন আন্দোলনে স্লোগান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। তার একটি বিখ্যাত কবিতা ‘আমি মেয়ে তাই আমাকে পড়াশোনা করতেই হবে’ যা নারী শিক্ষার গুরুত্ব এবং প্রয়োজন নিয়ে বার্তা দেয়।
কমলা ভাসিনের প্রয়াণ দক্ষিণ এশিয়ার নারী আন্দোলনের জন্য অপরিসীম ক্ষতি কিন্তু তাঁর স্বপ্ন এবং কথাগুলো থেকে যাবে এখানকার নারীদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য, নারীদের আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে উঠতে এবং সমঅধিকারের জন্য লড়ে যেতে অনুপ্রাণিত করবে সবসময়। ভাসিন জীবনকে শত বাধাবিপত্তি সংগ্রামের মধ্যেও উদযাপন করতেন, মৃত্যুতেও তাঁর সঙ্গীসাথী এবং অনুগামীরা শ্রদ্ধা ও উদযাপনের মধ্য দিয়েই তাঁকে শেষ বিদায় জানান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলায়নিজমের বিকাশ সমাজকে আরো বাসযোগ্য করবে দৈনিক আজাদীকে সম্মাননা
পরবর্তী নিবন্ধঅউরত কা নারা আজাদী