শিক্ষাব্রতী আবদুস সোবহান স্মরণে

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ৭ মে, ২০২৪ at ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ পটিয়া হচ্ছে এদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। শিক্ষাদীক্ষা, সাহিত্যসংস্কৃতি, রাজনীতি, জ্ঞানসাধনা, গবেষণা, ক্রীড়া, ব্যবসাবাণিজ্য, আন্দোলনসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে যার অবদান অনস্বীকার্য। পটিয়া জন্ম দিয়েছে তৎকালীন সময়ের ভারতবাংলা খ্যাত অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের। ঐতিহাসিক বিবেচনাায় পটিয়াকে বীর প্রসবিনী পটিয়া বলে সম্বোধন করা হয়। ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক সাবেক মহকুমা পটিয়া বিপ্লবীদের চারণভূমি এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার।

বীর প্রসবিনী পটিয়ার আলোকিত সন্তান আবদুস সোবহান। যিনি পটিয়াকে এবং পটিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্যকে যেভাবে আলোকিত করেছেন তেমনি আলোকিত করেছেন চট্টগ্রামের শিক্ষাব্যবস্থাকে। পটিয়া শহরের নাভিমূলে স্থাপিত আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়টি ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পটিয়া আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অকুতোভয় দেশপ্রেমিক কালজয়ী সাধক ও শিক্ষানুরাগী আবদুস সোবহান ১৮৫৩ সালের ১১ জানুয়ারি দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাবেক মহকুমা সদর পটিয়া পৌরসভার গোবিন্দার খীল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলানা আবদুস ছমদ। মৌলানা আবদুস সোবহান তৎকালীন কুসংস্কার, অশিক্ষা ও ধর্মান্ধতায় আকুণ্ঠ নিমজ্জিত পশ্চাদপদ মুসলমানদের পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের শিক্ষা অর্জনের নিদারুণ অভাব দূর করার প্রত্যয়ে কঠোর সাধনা ও অসীম ধৈর্য্য, অশেষ ত্যাগ নিরলস পরিশ্রম, নিজ জাতি ধর্ম কওমের প্রতি সীমাহীন অনুরাগ তথা মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় অভিষিক্ত হয়ে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

আবদুস সোবহান গ্রামের স্থানীয় মক্তবে প্রাথমিক পাঠ শেষ করে চট্টগ্রামের মোহছেনিয়া মাদ্রাসা, বর্তমান হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত করে উপমহাদেশের বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা জীবন শুরু করেন। মাঝপথে শিক্ষা জীবনের ইতি টেনে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। মুসলমান জনসংখ্যার মাঝে শিক্ষাদীক্ষার অভাব এবং সমাজে তাঁদের অবস্থানের কথা চিন্তা করে তিনি খুবই চিহ্নিত ও ব্যথিত হয়ে পড়েন। মুসলিম ছাত্রদের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সে সময়ে মফস্বল এলাকার মধ্যে পটিয়াতেই আবদুস সোবহানের প্রচেষ্টায় সর্বপ্রথম ইংরেজি স্কুল স্থাপিত হয় ১৮৪৫ সালে। তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে মুসলমান ছাত্রদের সেখানে মর্যাদার সাথে শিক্ষার সুযোগ ছিল সীমিত, ফলে মুসলিম ছাত্রদের অনেকেই মক্তব ও মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করত।

ইংরেজি শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে ইংরেজ অধিকৃত বাংলায় মুসলমানরা চাকরীব্যবসাসহ সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে পরে নিম্ন পর্যায়ে জীবন নির্বাহ করত। এমন দুরবস্থা আবদুস সোবহানকে দারুণভাবে পীড়া দেয়। ফলে তিনি পটিয়া থানা সংলগ্ন হাদুর দিঘির দক্ষিণপূর্ব পাড়ে মুসলমান ছাত্রদের শিক্ষার জন্য ১৮৯৮ মতান্তরে ১৯০৬ সালে প্রথম একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। শত প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকুলতাকে ছাপিয়ে প্রথম দফার ৮/১০ জন ছাত্র নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সোবহানিয়া মক্তব। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এটিকে সম্প্রসারিত করে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেন। ১৯০৯ সাল পর্যন্ত এটি পঞ্চম শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে পটিয়া পৌরসভাস্থ ৫ নং ওয়ার্ড নিবাসী বিদ্যুৎসাহী ব্যক্তিত্ব ছদু তালুকদার নামের এক সমাজহিতৈষী জনসেবক জমি দান করে সহযোগিতা করায় বিদ্যাপীঠটি স্থানান্তর পূর্বক ১৯১৪ সালে স্কুলটিকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা হয়। তখন স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন নোয়াখালী নিবাসী আবদুল গোফরান। তাঁর জন্ম১৮৮৮ সালে ফেনীর শরিষাদি গ্রামে। পরবর্তীতে তিনি অবিভক্ত বাংলার এমএলএ ও মন্ত্রী, ১৯৩৩ সালে খান বাহাদুর খেতাব প্রাপ্ত হন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৪৯ সালে।

১৮৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত পটিয়া হাই স্কুলের পাশে আরেকটি হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে দেখে স্থানীয় কিছু সুযোগ সন্ধানি প্রতিপক্ষ ষড়যন্ত্র শুরু করেন। এক পর্যায়ে নতুন প্রতিষ্ঠিত এ স্কুল ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এতে কিছুটা হতাশ এবং বিচলিত হয়ে পড়েন আবদুস সোবহান। সে সময় পটিয়া থানার দারোগা (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ছিলেন রাহাত আলী নামের একজন মহৎ ব্যক্তিত্ব। আবদুস সোবহান অনন্যোপায় হয়ে স্কুল গৃহটি পুনঃনির্মাণের জন্য তাঁর শরণাপন্ন হন। তিনি দারোগা সাহেবকে প্রস্তাব করেন যে, স্কুল প্রতিষ্ঠিত করা গেলে তিনি স্কুলটি তাঁর নামেই নামকরণ করবেন। ফলে দারোগা সাহেব সম্মত হয়ে স্কুল গৃহটি পুনঃনির্মাণের জন্য আন্তরিক সমর্থনসহ আর্থিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। এতে মৌলানা সাহেব দ্বিগুণ উৎসাহে পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণের কথা চিন্তা না করে দারোগা সাহেবের আর্থিক অনুদান ও নিজের সর্বস্ব বিনিয়োগ করে স্কুল গৃহটি পুনঃনির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন।

স্কুল ঘর পুনঃনির্মিত হওয়ার পর ছাত্রদের লেখাপড়া শুরু হলে আবদুস সোবহান স্কুলের নাম রাহাত আলী দারোগার নামে নামকরণের প্রস্তাব করেন। এতে আবদুস সোবহান সাহেবের অনুসারীসহ স্থানীয় অধিবাসীরা তা মেনে নিতে পারেন নি। তাঁরা মৌলানা আবদুস সোবহান সাহেবের নামেই এই বিদ্যাপীঠের নামকরণে সোচ্চার হলে তিনি এর বিরোধিতা করে বলেন, ‘রাহাত আলী সাহেব আমাকে বিপদে সাহায্য করেছেন, তা না হলে আমি স্কুল টিকিয়ে রাখতে পারতাম না। আমার মৃত্যুর পর আমার ছেলেরা আছে, কিন্তু রাহাত আলী সাহেবের কোনো সন্তানাদি নেই। অতএব এটি তাঁর নামেই পরিচিত হোকএটাই আমার ইচ্ছা।’ অতঃপর তিনি সবাইকে বুঝিয়ে বিদ্যাপীঠটির নাম ‘রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে নামকরণ করেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশাই প্রয়োজনীয় জমি, গৃহ ও সরকারি স্বীকৃতিসহ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যান।

বেশ কয়েক বছরকাল বিদ্যাপীঠটি ‘রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে সোবহান সাহেবের অত্যন্ত স্নেহভাজন পটিয়ার আরেক কৃতি সন্তান আবদুর রহমান শিক্ষা বিভাগের অঞ্চল পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনকালে নিজ উদ্যোগে ‘রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়’র অগ্রভাগে ‘আবদুস সোবহান’ নামটি সংযুক্ত করে এর নাম ‘আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়’ হিসেবে নামকররণ করেন। কারো কারো মতে তৎকালীন বিভাগীয় স্কুল পরিদর্শক খবির উদ্দিন স্কুল পরিদর্শনে এসে রেকর্ড পত্র মূলে বিস্তারিত অবগত হয়ে ‘রাহাত আলী’ নামের অগ্রভাগে ‘আবদুস সোবহান’ নামটি সংযোজন করে দেন। বর্তমানে বিদ্যালয়টি শত বছর পার করে এ অঞ্চলের শিক্ষাক্ষেত্রে বিরল গৌরবের অধিকারী হয়েছে। মৌলানা আবদুস সোবহান এর প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়টি অত্র অঞ্চলের শিক্ষাক্ষেত্রে বিরল গৌরবের অধিকারী। এ বিদ্যালয়টি আজ ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ বিদ্যালয় থেকে অসংখ্য কৃতি শিক্ষার্থী দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র সহ দেশবিদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ ও জাতির মাঝে আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ইতিহাসের ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তিত্ব মৌলানা আবদুস সোবহান ৭ মে ১৯১৮ সালে ইন্তেকাল করেন।

কীর্তিমান শিক্ষার্থী ইতিহাসের ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তিত্ব মৌলানা আবদুস সোবহানকে তাঁর মহান কৃতিত্বের জন্য প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমরা গভীর শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করছি।

তথ্যসূত্র : . চট্টল মনীষা, আহমদ মমতাজ ও রাইহান নাসরিন, চট্টল প্রকাশন। ২. গৌরবগাথা, রাশেদ রউফ সম্পাদিত পটিয়া উৎসব২০২২ স্মারক। ৩. বৃহত্তর পটিয়ার কৃতী ও কীর্তিমান : এস এম কে জাহাঙ্গীর।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরবীন্দ্র-নজরুল : শ্রদ্ধা এবং স্নেহের অনন্য দৃষ্টান্ত
পরবর্তী নিবন্ধ‘বিজয় নিশান’ : চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সমৃদ্ধ প্রয়াস