অউরত কা নারা আজাদী

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ২ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

‘আজাদী’ শব্দটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ও স্লোগানে প্রিয় শব্দ হিসেবে ব্যবহার করতেন কমলা ভাসিন। সারাজীবন তিনি তাঁর সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে গেছেন নারীরা যেন তার আপন শক্তিকে অনুভব করতে পারে। আমৃত্যু তিনি প্রান্তিক নারীদের মানবেতর জীবন থেকে আজাদী দেওয়ার জন্য কাজ করেছেন। বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নিগৃহীত ও অধিকার বঞ্চিত নারীরা তাদের অবস্থাকে নিয়ম ও অদৃষ্ট বলেই মেনে নিয়েছিল। তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বুঝিয়েছেন। তোমাদের জন্ম ও মানব জন্ম পুরুষের মতো। তোমাদেরও অধিকার রয়েছে এই জগৎ-সংসারে জীবনকে নিজের মতো করে যাপন করার।

কমলা ভাসিন তিনি শুধু ভারত নয়, শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয় তিনি সারাবিশ্বের নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ। তিনি পাশ্চাত্যের ধ্যানধারণাপুষ্ট নারীবাদী ছিলেন না। তিনি ভারতীয় সমাজব্যবস্থার বাস্তবতার প্রেক্ষিতে দলিত, উপজাতীয় প্রান্তিক নারীদের অধিকার সচেতন করার জন্য কাজ করেছেন। শুধু নারীর অধিকার নয় মানবাধিকারই ছিল তাঁর মূল আগ্রহের বিষয়। তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে কাজ করেছিলেন। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার ‘ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং’ আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা কমলা ভাসিন তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নারীর আজাদীর জন্য লড়াই চালিয়েছেন লিঙ্গ বৈষম্য, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার লক্ষ্যে ১৯৭০ সাল থেকে তিনি নারী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
২০০২ সালে তিনি জাতিসংঘের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে নারী আন্দোলনের কাজ শুরু করেন। প্রত্যন্ত এলাকার মহিলা, দলিত ও আদিবাসী নারীদের নিয়ে ‘সঙ্গত’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এসব নারীদের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি অনুভব করলেন এদের কাছে পৌঁছাতে ভাষা একটা বড় সমস্যা। তাই তিনি তাদের বুঝানোর জন্য মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন গান, নাটক, গল্প আর ছবি। এসবের মাধ্যমে খুব সহজে পৌঁছে যান তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাণের কাছাকাছি। তিনি শুধু মানবাধিকার কর্মী ছিলেন না। তিনি একজন প্রশিক্ষক ও বড় মাপের লেখকও ছিলেন। তিনি জেন্ডার থিওরি, নারীবাদ ও পিতৃতন্ত্র নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন। তাঁর বইগুলো ত্রিশটিরও বেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ‘শতরঙি লাড়কে’ ও ‘শতরঙি লাড়কিয়া’ খুব জনপ্রিয় বই। তিনি বিশ্বাস করতেন দলগত ধ্বনির সাথে সাথে সম্প্রদায়ের আন্দোলনও যুগপৎ চালিয়ে যেতে হবে।
১৯৪৬ সালে ২৪ এপ্রিল এই মহীয়সী নারীর জন্ম। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর বাবা ছিলেন রাজস্থানের একজন সরকারি ডাক্তার। তিনি ভারতের গ্রামগুলোতে বেড়ে উঠেছেন। যার জন্য তাঁর মনে নারীদের নিয়ে কাজ করার আগ্রহের জায়গা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া সমাজের জাতপাতের রেষারেষি ও বৈষম্যও তাঁকে বিচলিত করেছিল। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে তাঁর কর্মময় জীবনের সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। তিনি রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকত্তোর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি ফেলোশিপ নিয়ে জার্মানীর মুয়েনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নে সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে গিয়েও দেখেন জাতিপ্রথা কীভাবে ভারতীয় সমাজকে বিভক্তির বেড়াজালে আটকে রেখেছে। মানুষ থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ব্যক্তিগতভাবে ভাসিনের জীবন খুব সুখকর নয়। তাঁর স্বামী তাঁর সংগ্রামমুখর জীবন মেনে নিয়েই বিয়েতে সম্মত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে সম্পর্কটা স্থায়ী হয়নি। নারী আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েও হয়তো বা পারিবারিক পরিমন্ডলে তিনি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বাইরে আসতে পারেননি। তিনি শত দুঃখকষ্টকে পিছনে ফেলে প্রান্তিক মানুষের ভালোবাসায় জীবনকে উদষাপন করেছেন।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর এই উদযাপনের জীবন থেকে তিনি চিরবিদায় নিলেন। রেখে গেলেন তাঁর বিশ্বাস এবং সংগ্রাম, ‘আউরত কা নারা আজাদী’। কোটি কোটি নিগৃহীত নারীর বুকে আলোর পিদিম হয়ে জ্বলুক ‘আজাদী’। অতল শ্রদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক ও অনন্য কমলা ভাসিন
পরবর্তী নিবন্ধএমএ মান্নান ও দানুর মতো নেতা বর্তমানে বিরল