একজন নারীর ‘লেখক’ হবার স্বপ্ন

বিভা ইন্দু | শনিবার , ২ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

আবেগ মিশ্রিত ভাষায় মাইক্রোফোনে মুখ রেখে বড় বড় লেখক সাহিত্যিকগণ সভা সমাবেশে চন্দ্রাবতী গার্গী, মত্রৈয়ী, খনার জীবনের প্রতিকূলতার কথা গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করেন। ইতিহাসখ্যাত এসব যশস্বীর মতো সামপ্রতিককালের সাহিত্য অনুরাগী অধিকাংশ নারী সাহিত্যিকদের জীবনেও রয়েছে বহুমুখী প্রতিকূলতা।
বিশ্বসাহিত্যে বিশ্বকবির জায়গায় অধিষ্ঠিত হয়েও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বৌদি কাদম্বরী দেবীর সাহিত্যপ্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন থেকে বিরত ছিলেন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটেও একজন নারী লেখককে স্বামী সংসার, ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা, হাট-বাজার, কুটাবাছা সহ আরো নানাবিধ ঝামেলা সামলিয়ে নিজের জন্য পরিসর বের করতে হয়। বিষয়টা অমাবস্যায় আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই। এমন প্রতিকূলতায়ও নিত্যনতুন সৃষ্টির তাড়নায় কোন কোন লেখকের মস্তিষ্কের নিউরনগুলো যখন অন্তর্জগতে ঝড় তোলে তখন সেই নারী লেখককে বেশ কয়েকধাপ পিছিয়ে এসে আত্মতুষ্টির জন্য উচ্চারণ করতে হয়-
‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’
তাই অত্যুৎসাহী নারী হৃদয় ও মন তখন মননের টুঁটি চেপে ধরে। মননশীলতাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে কড়া ডোজ হিসেবে নিজেকে গৃহলক্ষ্মীর পদে অধিষ্ঠিত করে ক্ষান্ত হয়। আর মনে মনে আওড়াতে থাকে আপাতত কলম না ধরে রান্নার কাজের খুন্তি কড়াই নিয়ে সফল হওয়া অত্যাবশ্যক। এছাড়াও এ-মুহূর্তে সাহিত্য নির্মাণের মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিলে পরিবারের প্রতি অবহেলায় অশান্তির বীজ বপন হবে। তখন আমছালা দুটোই হারানোর আশঙ্কা বাড়তে পারে। অতএব এক্ষেত্রে পরিবার পরিজনের যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর পর লেখালেখির মননকে আবার সমপর্যায়ে ফিরিয়ে নিয়ে জাগিয়ে তোলা কতখানি কাঠখড় পোড়ানোর তা সহজেই অনুমেয়।
সাহিত্যসাধনার পরিবেশ ও সুনির্দিষ্ট কোন সময়ের গাছপাথরও নারী লেখকদের জন্য নির্ধারিত নেই। নিরাপদ ঘুমের সুযোগটুকু হাতছাড়া করে রাতের পর রাত জেগে থেকে কেউ কেউ অসাধ্য সাধনে মেতে ওঠেন। আপন প্রতিভার আলোয় উদ্ভাসিত হবার প্রত্যয়ে কঠোর পরিশ্রম করে যান। পাশের জন বা জীবনসঙ্গীটি যদি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন তাহলে সৃজনশীলতার পাশাপাশি দুঃসহ যন্ত্রণাও অনেকাংশে হজম করে নিতে হয়।
ষোলোআনা সংসার সামলে একজন প্রতিভাদীপ্ত লেখক হবার পেছনে সহস্র দীর্ঘশ্বাস ও কান্না লুকানো থাকে। এরপর সন্তানস্বরূপ নতুন নতুন গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস ও প্রবন্ধের জন্ম নারী লেখককে নতুন আলোকোজ্জ্বল পথের সন্ধান দেয়।
সহনশীল মমতাময়ী নারী লেখক মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষকে বোঝান সুকুমার বৃত্তি চর্চা পরে কিন্তু পরিবারকে সমুন্নত রাখার পবিত্র দায়িত্ব সবার আগে কাজেই সৃজনশীল প্রতিভা বা নির্মাণের ইচ্ছাশক্তিকে খেদিয়ে বিদায় না করলে সবকূল ধ্বংস হবে এটা সমাজসংসারে অনিবার্য সত্য কথা। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী মানসিকতার কাছে কখনও কখনও পরিবার সংসার নিজের অস্তিত্ব সৃজনশীল কর্মজগতকে একই সমান্তরালে নিয়ে আসা যায়। তবে মূল্যটা যা দিতে হয় তা সবক্ষেত্রে সুখকর বা স্বস্তির নাও হতে পারে।
সারাদিনের ক্লান্তি ও অবসাদকে ঝেড়ে ফেলে প্রচণ্ড প্রত্যয়ী কিছু মানুষ ঠিকই এগিয়ে আসেন সমাজ দেশ জাতির কল্যাণে কলম ধরতে। যদিও দৈহিক অবয়বে ও সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিতে তারা অবলা নারী।
অসী নয় মসীই হচ্ছে সমাজের এমন দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনের শক্তিশালী অনুষঙ্গ।
সাহিত্যচর্চায় বেগম রোকেয়া থেকে শুরু করে কামিনী রায়, কুসুম কুমারী দাস, সুফিয়া কামাল সহ নারীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে অস্বীকার করবার কোনো পথ নেই।
তাদেরই আদর্শে তাদেরই সাহসে উদ্বুদ্ধ বাঙালি নারীসমাজ দৃপ্ত পদচারণায় বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবার জন্য যথেষ্ট অবদান রেখে চলেছেন। কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, জননী সাহসিকা উপাধি ভূষিত জাহানারা ইমাম, রমা চৌধুরী, বেগম মুশতারী শফী, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, নাসরীন জাহান, খুশি কবীর, সাদিয়া নাসরীন, নাসরীন পাঠান, দীপালী ভট্টাচার্য, আনোয়ারা আলম সহ সামপ্রতিক সময়ের লেখকবৃন্দের সাহিত্যচর্চার প্রতি মনোযোগী হবার বিষয়টি দারুণ প্রশংসার।
বহুমাত্রিক সাহিত্য প্রতিভার ইতিবাচক সংশ্লিষ্টতা পরিবার সমাজ ও দেশগঠনে অভাবনীয় সাফল্য ও সমৃদ্ধির দুয়ার খুলে দেবে।
এসব প্রতিভাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে পরিবারের সদস্যদের কন্যা জায়া জননী রূপী মাকে তার সৃজনশীল কর্মজগতে নিশ্চিন্ত ও নিশংক মনে বিচরণে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
শুধুমাত্র নারীর অবয়ব পিছিয়ে পড়ে থাকবার জন্য কোন কারণ বা দোষ হতে পারে না।
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রপরিচালনায় সবক্ষেত্রে নারীর জন্য নিরাপদ আবহ গড়ে তুলতে হবে।
সংগ্রামমুখর জীবনে ‘অবলা’ পরিচয়ের গ্লানিটুকু মুছে দিয়ে বিজয়ের গৌরবগাথা রচনার জন্য নারীকে শিল্প সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি সমাজ দেশ ও জাতি কল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে। অবলা পরিচয়ে ঘুচিয়ে নারী লেখককে মানুষ উপাধির সার্থকতা প্রমাণ করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুন্দর ও শুদ্ধতার চর্চা করতে শেখায় আবৃত্তি : আজাদী সম্পাদক
পরবর্তী নিবন্ধমান্দালে-যেখানে বজ্রপাতের মত ভোর হয়