মান্দালে-যেখানে বজ্রপাতের মত ভোর হয়

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ২ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রুডিয়ার্ড কিপলিং সেই আঠারো শতকের শেষের দিকে মান্দালে শহরে এসেছিল ব্রিটিশ সৈনিক হিসেবে। ব্রিটেনে ফিরে যাবার পর তার ফেলে যাওয়া বার্মিজ প্রেমিকাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিল ‘রোড টু মান্দালে’, পরবর্তীতে ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা সেই কবিতাকে সুর দিয়ে গান বানিয়েছে। আমি লিখছি ২০১৭ এর এপ্রিলের সেই মান্দালে শহর নিয়ে।
হোস্টেলে ব্যাগ রেখে আমি আর মিকা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো এবং সবচেয়ে দীর্ঘ সেগুন কাঠের ব্রিজ- উ বেইন ব্রিজ দেখতে বের হয়ে গেলাম, সাথে আছে নেদারল্যান্ডের দুই বয়সে তরুণ ভ্রমণকারী। বাগান থেকে ট্রেনে আসার সময় রাস্তার পাশে স্তূপাকারে পড়ে থাকা সেগুন কাঠ দেখে যেমন খুব কষ্ট হয়েছিল, আবার সেইরকম খুব আনন্দ নিয়ে দেখতে যাচ্ছি সেগুন কাঠ দিয়ে বানানো বাগান। ‘তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা মন জানো না’ অবস্থা আমার এবং আমাদের, প্রায় সব মানুষের। মান্দালের গলির ভেতর থেকে শুরু করে রাজপথ, সব জায়গায় পানি খেলার মহোৎসব চলছে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে পানি নিয়ে, একে অপরকে ছুঁড়ে মারছে। কিছু কিছু জায়গায় রাস্তার ধারে প্যান্ডেল করে ডিজে পার্টি হচ্ছে আর সেখান থেকে পানি ছুঁড়ে মারছে। আমাদের গাড়ির চালককে সতর্ক করে বলে দেয়া হয়েছে ভুলেও যেন সে গাড়ির জানালার কাচ না নামায়। ট্রেনে চারবার ভেজার পর আমার আর মিকার, কারোই আর পানিতে ভেজার ইচ্ছে নেই, দুই তরুণও আমাদের দলে। গাড়ির ভেতর থেকে মানুষের আনন্দ দেখেই আমরা খুশি। এক জায়গায় এসে গাড়ি জ্যামে পড়ল, ঠিক গাড়ির জ্যাম না, মানুষের জ্যাম। রাস্তার উপর বিশাল প্যান্ডেল করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে, পানি ছুঁড়ছে বালতি বা পানি ছোঁড়ার খেলনা দিয়ে না, বিশাল বিশাল হোস পাইপ দিয়ে। থাইল্যান্ডে পানির অপচয় কমাতে এই উৎসবের সময় অনেক সচেতনতা কার্যক্রম নেয় সরকার। তবে ওরা আবার এক কাঠি বেশি সরস। পানির সাথে ওরা বরফ মিশিয়ে নেয়। জ্যাম পার হয়ে এসে গাড়ি জোরে টান দিল এবং আমরা সবাই আরেকবারের মত ভিজলাম। হতভম্ব হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছি বেক্কলের মত। আমাদের গাড়ির চালক অতি দক্ষ চালক এবং অতি চালাক ব্যাক্তি। সে যখন গাড়ি জোরে টান দিয়েছে, ঠিক তখন দুই ইঞ্চির মতো তার পাশের জানালা খুলে দিয়েছিল, এবং ঠিক তার পাশেই একজন হোসপাইপ দিয়ে পানি ছুঁড়ছিল। গাড়ির গতি এবং পানির গতি মিলে দ্বিগুণ হয়ে গেল, আর হুস করে আমাদের সবাইকে ভিজিয়ে দিল। তবে অনেক ভেজা না, কাকভেজা। চালককে আমরা যাই বলি না কেন সে শুধু হাসে। ওনার একটাই কথা, উৎসবে মজা না করলে কি হবে! এত দূর থেকে ওদের দেশে উৎসব দেখতে এসেছি, আর যদি অংশই না নিই, তাহলে পুরো ভ্রমণই বৃথা।
যেতে যেতে আমি আর মিকা নেদারল্যান্ডের দুই তরুণের সাথে আমাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বিনিময় করছিলাম। এক পর্যায়ে একজন জানালো বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণের বিষয়ে ও কিছু লেখাপড়া করেছে। ওর কাছে বিষয়টা খুব ভাল লেগেছে। এরপর আমাদের আলোচনা চলল কীভাবে বাংলাদেশ নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করছে। আমরা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে কথা বললাম। বাংলাদেশে ঘুরতে গেলে কোথায় কোথায় গেলে ভাল হয় সেই বিষয়ে কথা বললাম।
উ বেইন ব্রিজের কাছে গাড়ি রাখার জায়গায় আমরা নেমে গেলাম। লোকে লোকারণ্য অবস্থা। ১.২ কিলোমিটার লম্বা এই ব্রিজটা আঠারো শতকের মাঝামাঝি তৈরি করা হয়েছিল তাউংথামান লেকের দুইপাড়ের মানুষের যোগাযোগের সুবিধার জন্য। ব্রিজটা সেই ১৭০ বছর আগে যেভাবে তৈরি করা হয়েছিল এখনও একই আছে, কেবল টুকটাক কিছু সংস্কারের কাজ করতে হয়েছে। ব্রিজটা দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১০৮৯টা পিলারের উপর। এর মাঝে কয়েকটা পিলার ক্ষয়ে গিয়েছিল বন্যা এবং অন্যান্য কারণে। ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের পিলারের জায়গায় সিমেন্টের পিলার লাগিয়েছে। বিভিন্ন লেখা পড়ে এবং ছবি দেখে বোঝা যায়, বর্ষার সময় লেকের পানি যখন কানায় কানায় থাকে তখন এই ব্রিজের আসল সৌন্দর্য দেখা যায়। এপ্রিলের মাঝামাঝি, যখন আমি গেছি তখন লেকের পানি প্রায় শুকিয়ে গেছে। লেকের চারপাশের মাটিতে প্লাস্টিক আর নানা আবর্জনায় ভরে গেছে। ময়লা-আবর্জনা দেখে আমাদের কারোই ভাল লাগলো না। দুই তরুণ কড়া সমালোচনা করল কীভাবে এশিয়ার এই অঞ্চলে মানুষ চারপাশ ময়লা করে রাখে। শুনতে খারাপ লাগলেও, আমি ওদের সাথে দ্বিমত করতে পারলাম না। মান্দালে আসার আগে যখন গুগলে এই শহর সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছিলাম একটা লেখায় এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর একটা উক্তি পড়েছিলাম। রয়টার্সকে উনি বলেছিল, ‘চীন আমাদের থেকে নিয়ে যায় মূল্যবান রত্ন আর সেগুন কাঠ, বিনিময়ে আমাদের দেয় প্লাস্টিক।’ সেই ইয়াঙ্গুন থেকে মান্দালে সব জায়গাতেই এই কথার যথার্থতা চোখে পড়েছে।
মান্দালে শহরের সীমানা চীনের ইউন্নান প্রদেশের সাথে লাগানো। বিগত কয়েক বছরগুলোতে চীন থেকে এসে মান্দালে শহরে বসতি গড়া মানুষের সংখ্যা এত বেশি হয়েছে যে, স্থানীয়রা এখানে সংখ্যালঘু হয়ে যাবার আশঙ্কায় আছে। একটা রিপোর্টে পড়েছিলাম, মান্দালে শহরে ছোট-বড় যত ব্যবসা আছে তার প্রায় ৬০ ভাগের মালিকানা চীনাদের হাতে। মিয়ানমারের সেনা শাসকেরা ক্ষমতায় থাকার জন্য চীনা ব্যবসায়ীদের সুযোগসুবিধা বাড়িয়ে দিয়েছে, পরিবর্তন করেছে তাদের ইমিগ্রেশান নীতি। মান্দালের রাস্তায় এখন বার্মা ভাষাভাষী আর চীনা ভাষাভাষীর সংখ্যা সমানে সমান। মাঝে দোকানপাট ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের সাইন বোর্ডও চীনা ভাষায় লেখা হচ্ছিল। কিন্তু, সেনাশাসকদের একজনের কঠোর পদক্ষেপের ফলে সেটি বন্ধ হয়েছে। অথচ, বার্মার সংখ্যাগুরু বামার জাতির মানুষেরা চীনের ইউন্নান প্রদেশ থেকেই এসেছে। মান্দালেতে সবচেয়ে প্রমিত বার্মা ভাষায় মানুষ কথা বলে। আর এখন সেই শহরেই চাইনিজ আর বার্মিজ এর দ্বন্দ্ব তুঙ্গে। চীনাদের এই অধিপত্য নিয়ে স্থানীয় এক গায়ক ‘মান্দালের মৃত্যু’ শিরোনামে গান করেছে এবং সে গান বেশ জনপ্রিয় স্থানীয়দের কাছে। বেশিরভাগ বার্মিজ মান্দালবাসী চীনাদের এই সংখ্যা বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন। শিল্পী-সাহিত্যিকেরা এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করছে, কার্টুনিস্টরা কার্টুন এঁকেছে। মান্দালেকে ঠাট্টা করে ‘চীনের ইউন্নান প্রদেশের রাজধানী’ বলে অনেকে সম্বোধন করে। অনেকে মিয়ানমারকেই নাম দিয়েছে ‘চাইনিজ রিপাবলিক অফ দি ইউনিয়ন অফ মিয়ানমার’।
চীন সরকার তার দেশের ব্যবসায়ীদের উৎসাহ এবং প্রণোদনা দেয়, দেশের বাইরে গিয়ে ব্যবসা বিস্তারের জন্য। তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের নীতি নির্ধারণে রাখে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব। আর সেই সুযোগে চীনারা বসতি গড়ে তুলছে দেশের বাইরে। মান্দালের রিয়েল এস্টেট চীনাদের হাতে। ওদের আছে টাকা আর ক্ষমতা, যা ব্যবহার করে নিজেদের সুবিধামত সব তৈরি করে নিচ্ছে। চীনাদের কারণে বেড়ে গেছে এখানকার জায়গা-জমির দাম, ঘর ভাড়া। ঘর ভাড়া বাড়ার ফলে মান্দালের অনেক পুরানো বাসিন্দা শহর ছেড়ে সরে গেছে গ্রামের দিকে। মান্দালে শহর, এর মানুষের সংস্কৃতি চীনা আগ্রাসনের কবলে। আধুনিক বার্মা গড়ে উঠেছে চীন থেকে বামাররা আসার কারণে, আবার এখন সেই চীনারা আবির্ভূত হয়েছে বিষফোঁড়া হিসেবে। মানুষের সভ্যতার বিবর্তন হয়েছে এভাবেই। নাসা’র একটা লেখায় পড়েছিলাম, পৃথিবীর পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে চীনের ওয়ান-টাইম ব্যাবহার উপযোগী জিনিসের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। যখন পড়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল এটা চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের ষড়যন্ত্র। যত দেখছি যত ঘুরছি, পরিবেশ, প্রকৃতি এবং মানুষের উপর চীনের নেতবাচক প্রভাব টের পাচ্ছি। আগে বাসার কোন ইলেকট্রনিক জিনিস কিনতে হলে প্রথমেই ভাবা হত জাপানে প্রস্তুতকৃত জিনিসের দীর্ঘ স্থায়ীত্বের কথা। চীন সেই বাজার দখল করে নেয়াতে জিনিসের দাম কমেছে সাথে স্থায়ীত্বও কমেছে, ফলে পৃথিবীতে এই লেকের ধারের প্লাস্টিকের মত পৃথিবী ভরে উঠছে আবর্জনা আর জঞ্জালে। অনেক আগে একটা এ্যনিমেটেড সিনেমা দেখেছিলাম ‘ওয়াল ই’। সিনেমাতে নির্মাতা তুলে এনেছিল ভবিষ্যতের জঞ্জালপূর্ণ পৃথিবীর রূপকে। যেখানে কোন মানুষ নেই, আছে কেবল যন্ত্র আর জঞ্জাল, আর সেখানেই সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে একটা বীজ নতুন গাছের জন্ম দেয়ার চেষ্টা করছে।
ব্রিজে ঘুরতে আসা মানুষ এপার থেকে হেঁটে ওপারে যাচ্ছে, অনেকে নৌকা নিয়ে ঘুরছে। দুই তরুণ হেঁটে ব্রিজের ওপারে যেতে চায়। কিন্তু, আমার যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। ওদেরকে ঘুরে আসতে বলে আমি আর মিকা ব্রিজের নিচে লেকের ধারে গেলাম। খুবই মজার ব্যবস্থা করা হয়েছে এখানে ঘুরতে আসা মানুষের জন্য। লেকের অগভীর ধারে প্লাস্টিকের চেয়ার বিছিয়েছে, উপরে আর পাশে নারকেল গাছের পাতা দিয়ে ছাউনি আর সীমানা ঠিক করেছে। মানুষ পানিতে পা ডুবিয়ে লেকের মধ্যে বসে উপভোগ করছে তাদের সময়, সাথে মিয়ানমারের বিখ্যাত বিয়ার এবং মুখরোচক খাবার। লেকের পানিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে অগুণতি হাঁসের দল। এই আনন্দে যোগ না দিয়ে আমরা একটি নিরিবিলিতে গিয়ে লেক দেখার চেষ্টা করলাম। একটা মরা গাছ উপড়ানো শিকড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। গুগলে এই লেকের অনেক ছবিতে এই গাছকে দেখেছি। আমি আর মিকা মরা গাছের উপর উঠে পড়ন্ত বেলায় ছবি রাখলাম।
রুডিয়ার্ড কিপলিং তার কবিতায় বলেছে, চীনের উপসাগর থেকে আসা বজ্রপাতের মত এখানে ভোর হয়। উনি কি বুঝিয়েছে ঠিক জানি না, তবে আজকের সূর্যাস্তের মত আগামীকালের সূর্যোদয় দেখবার ইচ্ছা নিয়ে নানা পরিকল্পনা করতে করতে আমরা ফিরে চললাম সেগুন কাঠের ব্রিজ থেকে। আমাদের স্মৃতিতে জমা হল আরেকটি দিন, আরেকটি নতুন জায়গা, নতুন ভাবনা এবং উপবব্ধি।
rupsbd@gmail.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকজন নারীর ‘লেখক’ হবার স্বপ্ন
পরবর্তী নিবন্ধকাপ্তাইয়ের নুরুল হুদা কাদেরী উচ্চ বিদ্যালয়ে পুরস্কার বিতরণ