সুন্দর ও শুদ্ধতার চর্চা করতে শেখায় আবৃত্তি : আজাদী সম্পাদক

শিল্পযাত্রায় ক্বণনের ৩৬ বছর

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ

শিল্পযাত্রার ৩৬ বছর পূর্ণ করেছে ক্বণন শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গন। আবৃত্তি শিল্পীর প্রসারে, জনগ্রাহ্যতা সৃষ্টিতে বোধে, মননে চর্চায় সক্রিয় সংগঠনটির তিন যুগ পূর্তি উৎসব ছিল গতকাল শুক্রবার। চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ বর্ণাঢ্য আয়োজনে ছিল বৃন্দ আবৃত্তি, একক আবৃত্তি ও কবি কণ্ঠে কবিতা পাঠ। মূল পর্ব আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। ক্বণন শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গন এর সভাপতি মোসতাক খন্দকারের সভাপতিত্বে প্রধান আলোচক ছিলেন দেশবরেণ্য কবি আসাদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে একুশে পদক ২০২২ প্রাপ্তির অনন্য সম্মানে ভূষিত হওয়ায় এম এ মালেককে ক্বণন শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গনের পক্ষ থেকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। তাঁর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন আসাদ চৌধুরী। দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক ‘ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে ধ্বনির কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে’ কবিতা উদ্ধৃত করে বলেন, কবিতাটা হচ্ছে আসল ধ্বনি। আবৃত্তি হবে তার প্রতিধ্বনি। আমি, আমরা অনেক সময় কবিতা পড়ে বুঝতে পারি না। কিন্তু আবৃত্তি শিল্পীরা যখন আবৃত্তি করেন তখন কবিতা বোধগম্য হয়ে উঠে, বুঝতে পারাটা সহজ হয়। এম এ মালেক বলেন, আবৃত্তি শুদ্ধতার শিল্প। এই শিল্প সুন্দর ও শুদ্ধতার চর্চা করতে শেখায়। আমরা সবাই এখনও সুন্দর ও শুদ্ধ করে মাতৃভাষার উচ্চারণ করতে পারি না। এক্ষেত্রে যা কিছু অগ্রগতি হয়েছে তাতে আবৃত্তি সংগঠনগুলোর আবৃত্তির শিক্ষকদের অবদান রয়েছে। এসময় তিনি স্কুল পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তি প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ জন্য ক্বণন শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি ক্বণন এর দীর্ঘ পথচলার প্রশংসা করে বলেন, সবকিছু ঢাকায় হয়, এ কথা সত্য নয়, চট্টগ্রামেও হয়। আজকের আয়োজন অন্তত তা প্রমাণ করে। শুধু আবৃত্তি চর্চার জন্য ৩৬ বছর একটি সংগঠনকে টিকিয়ে রাখা সহজ ব্যাপার নয়। তিনি বলেন, সবসময় আমি বলি, ঢাকা পুরো বাংলাদেশকে ঢেকে ফেলেছে। সে ঢাকনা উঠিয়ে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলে পুরো বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, শিল্পীদের স্বপ্ন দেখতে এবং দেখাতে জানতে হবে। স্বপ্ন মানুষকে সাফল্যের অনেক চূড়ায় নিয়ে যায়। তিনি বলেন, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ঘৃণা, স্বার্থপরতা আমাদের পিছিয়ে পড়তে ভূমিকা রাখছে। এ থেকে উত্তোরণের জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেম। দেশপ্রেমকে জাগ্রত করতে হলে সংস্কৃতি চর্চা বাড়াতে হবে। দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসতে হবে। চট্টগ্রামকে ভালোবাসতে হবে। দৈনিক আজাদী সম্পাদক বলেন, যে কাজ করি না কেন সেখানে লেগে থাকতে হবে। এতে সাফল্য আসবে। তবে কাজ করতে হবে মানুষের সেবার উদ্দেশে। কিছু পাওয়ার আশায় না। যদি কোনো কিছু পাওয়ার আশা না করে তাহলে পাবেই। কিন্তু পাওয়ার আশায় করলে পাওয়া হবে না। সুতরাং কোনো কিছু পাওয়ার আশায় কিছু করবেন না। দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) পেয়েছেন। এবার একুশে পদক পেয়েছেন সম্পাদক এম এ মালেক। দৈনিক আজাদীর কল্যাণে দুটো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার অর্জনকে চট্টগ্রামবাসীর পাওয়া বলে মনে করেন এম এ মালেক। তিনি বলেন, আমাকে অনেকে বলেন দৈনিক আজাদী ঢাকা থেকে বের করলে জাতীয় পত্রিকা হতো। তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলি, ১৯৬০ সালে আমার বাবা চট্টগ্রামের মানুষের সুুখ-দু:খের কথা সরকারের কাছে বা সরকারের যেসব সংস্থা আছে যেমন সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, রেলওয়েসহ অন্যান্য অর্গানাইজেশন এর কাছে তুলে ধরার জন্য দৈনিক আজাদী বের করেছিলেন। জনগণ কী চায়, আপনারা কী করছেন। সুতরাং জনগণের চাওয়া-পাওয়াগুলো যদি তুলে ধরতে না পারি তাহলে চট্টগ্রামবাসী কোনো কাগজকেই গ্রহণ করবে না। এম এ মালেক বলেন, অনেকে জিজ্ঞেস করে ৬২ ধরে কীভাবে পাঠকদের ধরে রেখেছেন। আমি বলি, প্রত্যেক পাঠকের প্রত্যাশা থাকে। চট্টগ্রামে ৭০ লক্ষ লোক বাস করে। তাদের সকলের আশা ও প্রত্যাশা পূরণ করা একটি কাগজের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু প্রত্যাশা যদি ৭০ থেকে ৮০ ভাগও পূরণ করতে পারি তাহলে পাঠক সে পত্রিকা গ্রহণ করবে। আমার মনে হয় আমরা সেটা পেরেছি বলেই ৬২ বছর ধরে আজাদী পাঠক সংখ্যা ধরে রেখেছে। তিনি বলেন, করোনা মহামারীকালীন জাতীয় এবং অন্যান্য অনেক পত্রিকার সার্কুলেশনে বিরাট ধস নেমেছিল। অনেকের ৭০-৮০ শতাংশও সার্কুলেশন কমে গিয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ে চট্টগ্রামবাসীর কাগজ আজাদী পাঠকসংখ্যা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এজন্য পাঠকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কারণ তারা চট্টগ্রামের কাগজ আজাদীকে বিশ্বাস করে। কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, আবৃত্তিকাররা কবিতা জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। যে সব আবৃত্তি সংগঠন এ ভূমিকা রাখছে তাদের মধ্যে ক্বণন একটি। ৩৬ বছর ধরে এ সংগঠন আবৃত্তিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে, শিল্পী উপহার দিয়েছে এবং আগামীতেও দিবে। তিনি বলেন, কণ্ঠস্বর বা চেহারা আবৃত্তির জন্য একমাত্র শর্ত নয়। শর্ত হচ্ছে কবিতাকে হৃদয়ঙ্গম করা এবং সেটা শ্রোতার মনে সঞ্চালন করা। এটাকে আমি অনেক বড় কাজ বলে মনে করি। এ সময় তিনি বলেন, কমার্শিয়াল জায়গা থেকে বেরিয়ে আবৃত্তিকাররা নিশ্চয়ই এক সময় শিল্পের জায়গায় আসবে। শিল্পের কোনো বিকল্প হয় না। আসাদ চৌধুরী বলেন, অনেকে প্রশ্ন করে কবিতা থেকে কী পেয়েছি। আসলে কবিতা আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে। নি:শ্বাস নিতে শিখিয়েছে। ভালোবাসতে শিখিয়েছে। জীবনটা আনন্দময় করতে শিখিয়েছে। সত্যিকারের যে ঘৃণিত ব্যক্তি তাকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে। বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তকে আনন্দময় করে তোলার জন্য কবিতা যে ভূমিকা রাখবে তার কোনো তুলনা হয় না। স্কুল পর্যায়ে বাংলা ব্যাকরণে ছন্দ উপেক্ষিত থাকায় সমালোচনা করে এ কবি বলেন, ব্রিটিশ আমলে স্কুলে যদি ছন্দ পড়ানো হয়ে থাকে তাহলে বাংলা ছন্দ এখন কেন স্কুলে পড়ানো হয় না। বাংলা ব্যাকরণ কী কেবল বাংলা গদ্যের জন্য? কবিতার জন্য না? ব্যাকরণ তো ভাষার জন্য। ভাষার একটি অংশ হচ্ছে কবিতা। তিনি বলেন, আবৃত্তি শিল্পী নান্দনিক পরিবেশনায় তা বুঝিয়ে দেন যা ছাপার অক্ষরে বোঝা যায়না।
বোধের জায়গা থেকে একজন আবৃত্তি শিল্পী তা করেন। কবির বোধের জগতে সহজে নিয়ে যেতে কবিতার একজন শিক্ষিত পাঠকের চেয়ে আবৃত্তিকার ভাল কম্যুনিকেট করতে পারেন। তিনি বলেন, কবির বোধকে বাচিক শৈলীতে অনুবাদ করেন আবৃত্তিকার। আমাদের দেশের অধিকাংশ পাঠক কবিতা পড়তে পারেন না বা বোঝেন না। এ কাজটা আবৃত্তিকাররা সহজতর করে তুলেছেন। তিনি বলেন, আবৃত্তিচর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হচ্ছে, এটি আশার কথা। আর ক্বণন চট্টগ্রামে দীর্ঘ তিন যুগ ধরে কাজটা সাফল্যের সাথে করে যাচ্ছে, এটা আনন্দের কথা। মোসতাক খন্দকার বলেন, ক্বণন শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গন চট্টগ্রামের আবৃত্তি শিল্পের একটি পথিকৃৎ সংগঠন। তিন যুগ ধরে আবৃত্তি শিল্পের প্রসারে শ্রমনিষ্ঠ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার শুদ্ধতম উচ্চারণকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরলস প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। তিনি বলেন, কবিদের আত্মমগ্নতা অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়ার শিল্পই আবৃত্তি। কবির বোধকে বাচিক শৈলীতে অনুবাদ করেন আবৃত্তিকার। আলোচনা সভায় অন্যানের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সৌভিক চৌধুরী ও শাওকি ইবনে সাফওয়ান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন আবৃত্তি শিল্পী রাশেদ মুহাম্মদ। আলোচনাপর্ব শেষে আবৃত্তি প্রশিক্ষক মোসতাক খন্দকারের গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলো’ শীর্ষক বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশিত হয়। এতে অংশগ্রহণ করে ক্বণন সদস্য শরীফ, সাইমুম, শুভ্রা, মুহতারিমা, সুস্মিতা, মেহরাজ, ইব্রাহিম, মিশর, আসিফ। একক আবৃত্তি পরিবেশন করে সৌভিক চৌধুরী, রাশেদ মুহাম্মদ, শুক্লা ভট্টাচার্য, শাওকি ইবনে সাফওয়ান, শরীফ মাহমুদ, আবসার তানিম, সাইমুম মুরতাজা, প্রেমা চৌধুরী, মুহতারিমা, শুভ্রা চক্রবর্তী ও সুস্মিতা চৌধুরী। কবি কণ্ঠে কবিতাপাঠ পর্বে একক কবিতা পাঠ করেন দেশবরেণ্য কবি ও বাচিক শিল্পী আসাদ চৌধুরী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব সমস্যা সমাধান করা হবে
পরবর্তী নিবন্ধএকজন নারীর ‘লেখক’ হবার স্বপ্ন