এই নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়?

শর্মিষ্ঠা চৌধুরী | শুক্রবার , ৯ অক্টোবর, ২০২০ at ৮:৫৪ পূর্বাহ্ণ

সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ, তার উপর দিয়ে হেঁটে চলেছি, দ্রুত গতিতে হাঁটছি, হাঁটছি তো হাঁটছিই,ভয়ে সমস্ত শরীর কাঁপছে, পেছনে রক্তের দাগ, পা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা-রক্তাক্ত আমি, সবুজ ঘাসের উপর লাল রক্তের স্রোত- আর পারছি না! ভীষণ ক্লান্ত লাগছে-কিছুতেই শেষ হচ্ছে না এই পথ-একটা মাঠেরও তো শেষ আছে! হাঁটার শক্তি ফুরিয়ে গেছে, ক্লান্ত আমি বসে পড়লাম রক্তাক্ত সবুজ মাঠে! পেছন থেকে প্রচণ্ড আঘাত, ঠিক মাথার পেছনটায়, আর পারলাম না নিজেকে সামলাতে, মাথাটা ঘুরছে, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে- অনেক কষ্টে চোখ মেলে একবার তাকিয়ে দেখলাম -আমার জন্মভূমি, আমার প্রিয় দেশ, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা এ দেশ, সাত লক্ষ বীরাঙ্গনার আত্মত্যাগ, রক্তাক্ত আমি, রক্তাক্ত আমার প্রিয় বাংলাদেশ। আমার তো এই অসময়ে চলে যাওয়ার কথা ছিলো না, আমারও তো স্বপ্ন ছিলো, বেঁচে থাকার স্বপ্ন! প্রিয় বাংলার আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন- প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিলাম! চোখ বন্ধ হয়ে আসছে,আর পারছি না- বিদায় জানালাম -মা,বাবা,ভাই বোন আর প্রিয়জনদের! তীব্র বেদনায় আমার ঘুমটা ভাঙলো, গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছিলো,এক গ্লাস পানি খেলাম, আর নিতে পারছি না, কত দেখবো এই দুঃস্বপ্ন,আর কতো!সাভারের নীলা,খাগড়াছড়ির আদিবাসী মেয়েটি সিলেটের তরুণী স্ত্রী, কুষ্টিয়ার তিন্নি, নোয়াখালীর গৃহবধূ এরা সবাইতো আমি…..হ্যাঁ আমি, আমরা, তুমি, তোমরা সবাই আমার মেয়ে, আমার বোন বা আমারই কোন প্রিয়জন। নীলা নামের ১৪/১৫ বছরের মেয়েটিকে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার খেসারত দিতে হলো, কুপিয়ে মেরে ফেলা হলো তাকে! আদিবাসী মেয়েটি, কি অপরাধ ছিলো তার, রাতের অন্ধকারে সাত আটজন নরপিশাচ তার সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নটাই দুঃস্বপ্ন করে দিলো! তরুণী স্ত্রী যে স্বামীর সাথে কিছুটা সময় একান্তে কাটাতে চেয়েছিলো, তার কি অপরাধ! বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলো তিন্নি, কেন তাকে অকালে ঝরে পড়তে হলো! গৃহবধূ কে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হলো, এই লজ্জা কার! এর আগেও জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছিলো নুসরাত, তনু, খাদিজা, রূপাসহ আরো অনেককেই। মেয়েদের জীবন কি এতটাই মূল্যহীন, এতটাই সহজলভ্য যে চাইলেই তার শরীর নিয়ে উল্লাস করা যায়, তাকে কুপিয়ে মেরে ফেলা যায়, ধর্ষণ করা যায়, ধর্ষণ করে আবার মেরেও ফেলা যায়! নতুবা লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েটি নিজেই নিজেকে শেষ করে দেয়! প্রতিটা দিন দেশের আনাচে-কানাচে, কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে, হয় শিশু ধর্ষণ না হয় নারী! কর্মক্ষেত্র বা স্কুল কলেজে যাওয়ার সময় বা ফেরার পথে, কোন নির্জন স্থান, বাস, ট্রেন, রাস্তাঘাট কোন কিছুই আর নিরাপদ নয়। চার্চের ফাদার হতে শুরু করে পুরোহিত, মাদ্রাসার শিক্ষক কেউই বাদ পড়ছে না।
মনে হচ্ছে ধর্ষণের মহামারি শুরু হয়ে গেছে, যেটা করোনার মহামারি থেকেও ভয়ঙ্কর! আর কতদিন চলবে এই উৎসব! আর কতদিন শুনতে হবে এই দেশের প্রতিটা প্রান্তে ধর্ষিতার কাতর চিৎকার, তীব্র হাহাকার! এই নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়? বিচারের বাণী এখনো কেঁদে চলেছে নীরবে নিভৃতে!
একজন নারীর বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার তাদের কে দিলো! তবে হোক আরেকটা যুদ্ধ, স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হোক রক্তাক্ত বাংলা- নুসরাত,তনু,নীলা,তিন্নি তোমরা অভিশাপ দাও সেইসব নরপিশাচদের যারা তোমাদের রক্ত দিয়ে হলি খেলতে চেয়েছিলো, অভিশাপ দাও সেইসব হায়নাদের- যারা তোমাদের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিলো,তোমাদের লালিত স্বপ্ন নিমিষেই ধুলিস্যাৎ- করে দিলো! ধ্বংস হোক তারা-নিক্ষিপ্ত হোক ইতিহাসের কোন আস্তাকুঁড়ে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাতিঘর
পরবর্তী নিবন্ধআতাউর রহমান খান কায়সার