আতাউর রহমান খান কায়সার

স্মরণ

নিজামুল ইসলাম সরফী | শুক্রবার , ৯ অক্টোবর, ২০২০ at ৮:৫৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের বরেণ্য রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক গণপরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক রাষ্ট্রদূত মরহুম আতাউর রহমান খান কায়সারের ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১০ সালের এদিনে ৭০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরাস্থ সুবিখ্যাত পৈত্রিক আবাস বংশালবাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আলহাজ্ব ইয়ার আলী খান ছিলেন জাতীয় আইন পরিষদ ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য। চট্টগ্রামে অধ্যাপক পুলিন দে মারা যাবার পর এম. এ. মান্নান, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও আতাউর রহমান খান কায়সার ছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যোগসূত্র স্থাপনের অন্যতম মাধ্যম। তিনি ১৯৭০ সালে আনোয়ারা, বাঁশখালী ও কুতুবদিয়া নির্বাচনী এলাকা হতে এম. এল. এ. নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ১নং সেক্টরে রাজনৈতিক সমন্বয়কারী ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে গণ-পরিষদ সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণ করেন। প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা, চট্টগ্রাম ক্লাব, চট্টগ্রাম সিনিয়রস্‌ ক্লাব, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু লেখক শিল্পী সম্মিলন পরিষদ, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ প্রভৃতি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি আনোয়ারা উপজেলার শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সাথে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মনোনীত সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন।
তাঁর বিদূষী স্ত্রী মরহুমা নীলুফার কায়সার ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ও জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান। তিনি তিনজন যোগ্য ও প্রতিষ্ঠিত কন্যা সন্তান রেখে গেছেন, যারা শিক্ষা ও যোগ্যতায় সমাজের উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত। মরহুমের বড় মেয়ে ওয়াসিকা আয়েশা খান সানিয়া জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের এমপি। দ্বিতীয় মেয়ে হুমায়রা আয়েশা খান নাইজেরিয়ায় একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। ছোট মেয়ে মুনিজা আয়েশা খান ঢাকায় নিজস্ব ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন। মরহুম আতাউর রহমান খান কায়সার ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়া ও ১৯৯৯ সালে রাশিয়ায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর ২০০২ সালে প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের রাজনীতির বড় একজন ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন আতাউর রহমান খান কায়সার। বাঙালি জীবনের অন্যতম শুদ্ধতম আলোকিত এই মানুষকে নিয়ে অত্যন্ত চমৎকার, হৃদয়গ্রাহী ও দুর্লভ একটি স্মারকগ্রন্থ ‘আমি তোমাদেরই লোক’ চট্টগ্রামে প্রকাশিত হয় ২০১১ সালের ১১ ফেব্রয়ারি ডা. দিলীপ দে’র সম্পাদনায়। হাসি চক্রবর্ত্তীর মনকাড়া প্রচ্ছদ, দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী আর বিশিষ্টজনদের শোকগাথায় সেখানে ফুটে উঠেছে বিশাল জীবনের আতাউর রহমান খান কায়সার। স্মৃতিচারণ, স্কেচ, কবিতা, নিজের সম্পাদিত কবিতা গ্রন্থ ‘মুখর অরন্যের’ কবিতা, বিভিন্ন সময়ের দুর্লভ মুহূর্তের ছবির এ্যালবাম সবকিছু মিলে গ্রন্থটিতে আতাউর রহমান খান কায়সার এর বিপুল বর্ণাঢ্য জীবনের ছবি অংকিত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখেছেন- কায়সার বাংলাদেশের বিরল রাজনীতিবিদদের একজন। তার মধ্যে ছিল এক কবি মন, সংস্কৃতি-ঋদ্ধ চেতনা। আতাউর রহমান খান কায়সারের জীবন ছিল শুদ্ধতম বাঙালি কবিতার সমাহার। বাঙালির গান, বিশ্ববিদ্যালয়, সুস্থ শিক্ষা আন্দোলন, গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, জেল, জাতীয় সংসদ, নির্বাচন, সংসদ ভবন, বিদেশে সফল রাষ্ট্রদূত, বঙ্গবন্ধুর চেতনার অবিনশ্বর পুরুষ, বন্ধুবাৎসল্য, সফল স্বামী, পিতা সবকিছু উঠে এসেছে এই অনবদ্য স্মারক গ্রন্থে।
মূলত কায়সার ভাই ছিলেন আওয়ামী লীগের বটবৃক্ষ। তিনি একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আস্থাভাজন ছিলেন। তিনি দেখতে যেমন বিশালদেহী ছিলেন, তেমনি ছিলেন একজন বিশাল হৃদয়ের মানুষ। যে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি লড়েছিলেন সেই একই আদর্শ নীতিবোধ থেকে এক চুলও বিচ্যুত না হয়ে আমৃত্যু আদর্শিক রাজনীতি করে গেছেন। তাঁর মতো নির্লোভ দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ আজও সমাজে বিরল। একজন নির্মোহ, সদালাপী, নিরহংকারী, ভদ্রলোক হিসেবে তাঁর স্মৃতি সকলের মনে চির অম্লান থাকবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে আতাউর রহমান খান কায়সার মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। কায়সারের মত জ্ঞানী, সজ্জন, অভিজাত রুচির রাজনীতিবিদ হাতে গোনা। তিনি ছিলেন কবি ও শিল্প সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের জাতীয় জীবনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পূরণ হবার নয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক, আয়কর পেশাজীবী,
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএই নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়?
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা