দুই বছর মহা যন্ত্রণা ও আতঙ্কে ঈদ কাটানোর পর এবার পবিত্র ঈদুল ফিতর এসেছে আল্লাহর রহমত হিসেবে। আমরা জানি, ঈদুল ফিতর পবিত্র রমজানে দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার কষ্ট ও ক্লান্তির পর মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাপী এক শ্রেষ্ঠ উপহার। মহান আল্লাহর অনুকম্পা, ক্ষমা, অনুগ্রহ ও নৈকট্য লাভের লক্ষ্যে ঈদ–উল–ফিতর বিশ্ব মুসলিমের জন্য এক অনন্য উৎসব। ঈদ শুধু আনন্দ উৎসবই নয় এটি আমাদের শান্তি, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও ত্যাগের শিক্ষা দেয়। পরস্পরের মধ্যে আনন্দ ও দু:খ ভাগাভাগি করার মাধ্যমে আমরা মৈত্রী ও সমপ্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হই।
উম্মতে মুহাম্মদীর প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত এটি এক বিশেষ রহমত ও বরকতময় উৎসব, যা অন্য কোনো সমপ্রদায়ের লোকদের দেওয়া হয়নি। ঈদের দিন বিশ্ব মুসলিম পরস্পর হিংসা–বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঈদগাহে গিয়ে ছোট–বড়, ধনী–নির্ধন ও আমির–ফকির একই কাতারে দাঁড়িয়ে ঈদের বিশেষ ইবাদত করে থাকে। এই ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে মুসলিমরা পরস্পর ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা, প্রীতি ও সৌহার্দ্যের এক অনুপম দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করে থাকে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
ঈদ মুসলিমদের জীবনে শুধু আনন্দ–উৎসবই নয়, বরং এটি একটি মহান ইবাদত, যার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণা খুঁজে পায়। পাশাপাশি কল্যাণ, বরকত ও আনন্দের এ শুভদিনে আমাদের মৃত পিতা–মাতা, ভাই–বোন ও আত্মীয়–স্বজনদের কথা ভুলে না গিয়ে তাদের মাগফিরাতের জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার বড় সুযোগ আছে।
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন– ‘প্রত্যেক জাতি–গোষ্ঠীর উৎসবের উপলক্ষ রয়েছে আর আমাদের খুশির উৎসব হচ্ছে ঈদ’।
ঈদ আরবি শব্দ। এটি ‘আওদ’ শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হল ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, বার বার আসা। মুসলমানদের জীবনে চান্দ্র বৎসরের নির্দিষ্ট তারিখে প্রতি বছরই দুটি উৎসবের দিন ফিরে আসে। তাই দিন দুটিকে ঈদ বলা হয়। ফিতর শব্দের অর্থ হলো ভেঙে ফেলা, বিদীর্ণ করা। মুসলমানরা রমজানের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজা রাখা আরম্ভ করে এবং শাওয়ালের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজা ভেঙে দেয় তথা রোজা রাখা ছেড়ে দেয়। সে কারণে এটিকে ঈদুল ফিতর তথা রোজা ভাঙার আনন্দ বলা হয়।
ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেন, ঈদ মানে ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তিত হওয়া। তাই ঈদের মাধ্যমে খুশির উৎসব ও প্রত্যাবর্তনের বার্তা লিপিবদ্ধ রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে খুশির হাওয়া বইতে থাকে, সর্বত্র উৎসবের আমেজ বিরাজ করে, মানুষের পুনর্মিলনী বা সম্মিলন ঘটে, তাই প্রাণের এ উৎসবকে আমরা ঈদ বলে থাকি। আবার মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে প্রতি বছরই ঈদ আমাদের মাঝে ফিরে ফিরে আসে, মানবচিত্তে আনন্দ–উল্লাসের দোলা দিয়ে যায়, সমাজ–মানসে নিখুঁত শিল্পীর অদৃশ্য তুলি দিয়ে প্রত্যাবর্তনের চিত্রাঙ্কন করে বেড়ায় এবং এ প্রত্যাবর্তনের গল্পে থাকে তাৎপর্যময় ও জীবন–জগতের জন্য পরম শিক্ষা। তাই আমাদের উচিত, ঈদ পালনের ভেতর দিয়ে শুধু উৎসবের সাগরে অবগাহন না করে প্রকৃত অর্থে এই প্রত্যাবর্তনের বার্তা, তাৎপর্য ও শিক্ষাকে গ্রহণ করা; তবেই আমাদের ঈদ উদযাপন সার্থক হয়ে উঠবে।
ঈদ একতার শিক্ষা দেয়, সমাজের বিভেদ ও বৈষম্য দূর করার শিক্ষা দেয়। ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে ধনী–গরিব সর্বস্তরের মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেয়। সর্বোপরি পরস্পরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেয়। মহান আল্লাহর কাছে আমাদের প্রত্যেকের প্রার্থনা, পৃথিবীর সকল মানুষের সুখ–শান্তি, কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি। বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতকে তৈরী করা; আগামী দিনগুলোতে যেন মানুষ শির তুলে চলতে পারে। আমরা চাই সবার জীবন সত্য, সুন্দর ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হোক! হাসি–খুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক! ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও সমপ্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক–এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা।