আলো আর অন্ধকারের গল্প

পুনরাবৃত্ত

বিধুভূষণ দাশ | শনিবার , ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৭:১১ পূর্বাহ্ণ

বিষয়ের গভীরতা কখনো এমনই মগ্ন স্থিরতা নিয়ে আসে যা থেকে সৃষ্টি হয় দারুণ কিছু। যার নান্দনিক ভিত্তির উপর নির্মিত হয় সভ্যতা, উৎকর্ষতা পায় মানবতা। আবার বিষয়ের অস্থিরতায় কখনো মগজের নিউরণগুলোর ভাইব্রেশনের মাত্রা এতই বেড়ে যায় যে, ব্যাপ্তিহীন বোধের ভিতর কাজ করে উচ্চ মাত্রার ব্যাকুলতা। ইতিহাসের মহানায়কদেরও নিরন্তর অস্থির করে রাখে তেমনি এক প্রগাঢ় ব্যাকুলতা।

 

সেই ব্যাকুলতাকে বিষয়ের গভীরে নিয়ে বিচরণ করতে করতে অদ্ভুত মৌনতায় কেটে যায় সমকাল। কিন্তু বৈরি ভাবাপন্ন, জীর্ণ ব্যস্ততার মুখোমুখি, নষ্টামিতে, এবং আঁচল টানাটানিতে ক্লান্ত সময়ের সন্ধিক্ষণে ব্যাপ্তিহীন অবসাদ একজন মহানায়ককেও অনুকরণ করে।

তবুও স্বপ্নিল জীবনে যা কিছু মানুষের প্রিয় অপ্রিয়, যা কিছু মানব নিয়তির সঙ্গে জড়িতসেসব কিছুই নিরন্তর আকর্ষণ করে একজন লেখককে। সবচেয়ে বড় কথা সুদূর সৌরলোক, এই চরাচর, বাঁচার আনন্দ, মানুষের মুখ সবসময় বন্ধনীয় মনে হয় একজন প্রকৃত লেখকের কাছে।

 

তাই তিনি জীবনের স্তরে স্তরে প্রবেশ করতে চায়, কুড়িয়ে আনতে চায় মানব মনের গভীরতা আর রহস্যময়তা। তিনি হাঁটেন সেই সব মানুষের ভিড়েযারা ভবিষ্যতের দিকে মুখ রেখে তৈরি করে মুক্তির মিছিল। সেখান থেকেই মেধা আর মনীষার সমান্তরাল পরিচর্যায় যিনি সৃষ্টি করেন নতুন কোন কল্পকথা, প্রবন্ধ

কিংবা কাব্য উপান্যাসের মাধ্যমে সমাজ চিত্রের পাশাপাশি পথ দেখানো অন্যরকম কোন দর্শনের আলো কিংবা সমাজ রাষ্ট্র অথবা ইতিহাসের নায়কনায়িকাদের ও তার ভিতরবাহির নিয়ে তুলে ধরেন সমকালের আগের অথবা পরের কোন কালকে।

 

বিবেচনার সাথে একাত্ম হয়ে মহুয়া ভট্টাচার্যের পক্ষে তার ‘পুনরাবৃত্ত’ গ্রন্থের মাধ্যমে তুলে আনা সম্ভব হয়েছে রানু নাকি ভানু, মান্টো নাকি ইসমত, গান্ধী নাকি সরলা, জিন্নাহ নাকি রটি, রথীন্দ্রনাথ নাকি মীরা, নাজিম হিকমত নাকি ভেরা, ভূপেন নাকি কল্পনা কে কতখানি হৃদয়ের মরুতে ফোটাল নীল পদ্ম? সমকালীন সামাজিকায়নে সৃষ্ট আজকের প্রেক্ষাপটও তার ব্যতিক্রম নয়, হয়তো এযুগের বেশিরভাগ সেলিব্রিটিদের দৃষ্টিভঙ্গিও।

তারপরেও কথা থাকে, আর কথা থাকে বলেই সভ্যতা আলোর দিকে এগিয়ে গেছে নবতর কোন আলোর মূর্ছনায়। আর তাইতো বার বার মানুষ পেয়ালায় বিষ আছে জেনেও ভালোবাসতে চেয়েছে পেয়ালা। থাক তাতে যত দংশন। হাজার বছরের ক্ষত মুছে যাবে ক্ষণিকের ভালোবাসা পেলে, এই রকমই করে এসেছে মানুষ। তবে সব মানুষের মধ্যে থাকে না যেমন সম্পূর্ণ মানুষ, পাই না সমসত্ত্ব বৈভব, ইতিহাসের অংশ সেই মহামানবরাও তার ব্যতিক্রম নয়।

 

তাঁরাও জীবনে অনেক সুন্দরকেই চোখের মাপের আকাশ করতে চেয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁদের, দুচোখের বিস্ময়ের কাছে নিজেরাই যখন পরাভূত সাথে সাথে সুন্দর সমূহ তাদের চাঁদমুখে টেনে দিয়েছে কালো নেকাব। তাঁদের আর দেখা হয়নি সেইসব সুন্দরের বিকশিত সৌন্দর্যকে। ব্যথিত কুসুম হয়ে তাঁরা আবারো

ফিরে এসেছে জনতার সান্নিধ্যে। তারপরও রাজার বেশভুষা ছেড়ে ফকিরের বেশে প্রেমিক সাজার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পুনশ্চঃ পথে নেমেছে এবং ক্রমশঃ নিজের কাছে ফিরে, নিজের স্বপ্নের তীরে বসে ব্যর্থতার ঢেউ শুনেছে।

অথচ এইসব সেলিব্রিটিদের যারা ভালোবেসেছিল তাদের কোন দিনও প্রত্যাশা ছিলনা তুষারের মৌনতা কিংবা নীলিমার নীল, চেয়েছিল শুধু ভালোবাসার পৃথিবীতে মানুষ হবে মানুষের জন্য, জীবন হবে জীবনের জন্য। স্নিগ্ধতার শুভ্র ছোঁয়ায় শাশ্বত মানবতা বোধের দুর্লভ বাস্তবতা প্রতিফলিত হবে তাদের স্পন্দিত

প্রাণের উচ্ছ্বাসে। তরুণ কোন লেখকের পক্ষেই যেমন বলা সম্ভব নয় অমুক উপন্যাস কিংবা তমুক কাব্যগ্রন্থ লিখে তিনি শতকরা একশত ভাগ তৃপ্ত, তেমনি কোন ইতিহাস সৃষ্টিকারী মহামানবের পক্ষেও নিরূপণ করা সম্ভব নয় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার প্রতীকী মানদণ্ড। নদীরও রয়ে গেছে একটা নির্দিষ্ট গন্তব্য, সাগরে

মিশে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে তার তৃপ্তি, কিন্তু মানুষ। কতদূর যাবে মানুষ? কতদূরই বা এগুলো মানুষ? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর জানা নেই মানুষের। কাজেই সার্বক্ষণিক বৈপরীত্যর মুখোমুখি সে বলতে পারে না কে তার সবচেয়ে প্রিয়? অনাগত ইতিহাসের দায়বদ্ধতা থেকেই কতিপয় মহানায়কের জীবনব্যাপী ধুপের

মতো গন্ধ বিলিয়ে যাওয়া অন্তর্গত সেইসব নারীর নিরব ত্যাগ এবং প্রেমের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা মহুয়া ভট্টাচার্য তার ‘পুনরাবৃত্ত’ গ্রন্থের মাধ্যমে তুলে এনেছেন পরিশ্রমী মননশীলতায় আর নিজস্ব নির্মাণশৈলীতে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসহিংসতা নয়, সহনশীলতাই গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ
পরবর্তী নিবন্ধশিশির থেকে শবনম