আলোয় ঋদ্ধ বাতিঘর

ফারহানা আনন্দময়ী | সোমবার , ২০ জুন, ২০২২ at ১১:০১ পূর্বাহ্ণ

বন্ধু, রহো রহো সাথে
আজি এ সঘন শ্রাবণ প্রাতে…

সকাল হলো সেদিন, এই গান চোখে নিয়ে। একটু ভুল হলো; চোখে ছিল অন্যকিছু, ঘুমে জাগরণে, সকালে সন্ধ্যায়, পাশ ফিরলেই যা দৃষ্টিতে আসে… না এসে তো উপায়ও নেই; রেখেছিই এভাবে, থাকিই এভাবে। আদতে বন্ধুই তো… বন্ধু তো সে-ই, হাত বাড়ালেই যার হাতটা ধরা যায়, সে হাতটা বাড়িয়েই থাকে। সে অপেক্ষায় থাকে আমার অবসরের। কেজো কিংবা অকেজো সংসারের পাওনা মিটিয়ে কখন নিজের ঋণ শুধতে আসবো! তার কাছাকাছি পৌঁছুতে বেশি দূরে যেতে হয় না। মলাটবন্দি হয়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে আঁখির আগে। আর ওদের দিকে তাকিয়ে, বিশেষ করে আজ সকালে, অবধারিতরূপে যে নামটি জ্বলজ্বল করে উঠলো, তা বাতিঘর। এক এক বইয়ের সাথে একেকরঙের স্মৃতি- আর যার বেশিরভাগই হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাতিঘর থেকেই আমার ঘরের কোণে এসেছে।

প্রাণহীন বইয়ের পাতা তো শুধু নয়; মোটা মলাটটা উল্টালে ভেতরের পাতায় প্রিয় হস্তাক্ষর, একটা একটা মুহূর্ত, একটা একটা পুরো দিন, বাতিঘরের গোল কাচের টেবিল, অক্ষর হয়ে ওঠে স্বর, বিপুল সব ঐশ্বর্য্য… আপন বলেই তো এসব ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেয় আমাকে। তাই কিছু কিছু বিশেষ বইয়ের পাতার মতো বাতিঘরও আমার এক গভীর আবেগের নাম।

তার সঙ্গে আমার পরিচয় সে তো আজকে নয়, বেশ অনেকগুলো বছর আগে, নয় নয় করেও দেড় যুগের কাছাকাছি হবে। ২০০৫ এর পরপরই। তখন, সেই সমস্ত দিনগুলোতে চট্টগ্রাম আমার কাছে এক নির্বান্ধব, অনাত্মীয় শহর। মন ভালো, কি মনটা মেঘ-কালো… তো যাই ঘুরে আসি। চেরাগির মোড়ে এক ছোট্ট দোকান, বইয়ে ঠাসাঠাসি, পাঁচ-সাতজন পাঠক-ক্রেতা একসঙ্গে একই সময়ে গেলে দাঁড়াতেও হতো কষ্ট করে! তবু তার কাছে গেলেই একটা বিরাম হতো মনের। বিপুল ঐশ্বর্য দু’হাতে আগলে বসে থাকতো সে। যেতাম, সে ঐশ্বর্য চোখ দিয়ে, মন চেয়ে নেড়েচেড়ে দেখতাম। ফেরার সময় কোনও কোনও দিন তার থেকে দু’এক কণা হাত ভরে নিয়েও আসতাম। তাঁর নামটায় কী এক যাদু ছিল…আলাদা করে মনে স্পর্শ করার মত, একটু অন্যরকম… সেই নামটাই আমায় বেশি টানতো, বুকে চমক দেয়া একটি নাম…‘বাতিঘর’। নির্বিশেষের ভিড়ে বিশেষ হয়ে ওঠা একটি প্রতিষ্ঠান।

সেই গুটিগুটি পায়ে চলতে থাকা চট্টগ্রামে চেরাগি পাহাড়ের মোড়ের সেই ছোট্ট আয়তনের ‘বাতিঘর’ আজ আকাশের সমান ডানা পেয়েছে, চেতনার পুরো আকাশ জুড়ে যেন উড়ছে তার বিশালতা নিয়ে। বিপুল আনন্দ, কিছু কৌতূহল, কিছু উত্তেজনা নিয়ে ২০১২এ শরতের এক কমলা বিকেলে তার দ্বিতীয় যাত্রা শুরু করেছিল বাতিঘর… জামালখানে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ভবনের নীচের তলায়। বিশাল আয়তন, বিপুল আয়োজন, নতুন আঙ্গিকে, নতুন আবরণে, নতুন আভরণে সে সেদিন অপরূপা। নামের যথার্থ প্রতিফলন তার সাজে…নতুন এই বাতিঘরে বইয়ের মেলায় ঢুকতেই চোখ জুড়িয়ে যায়, মন ভরে যায়। সেদিন মনে হয়েছিল বই বোঝাই কোনও জাহাজে চড়ে দূর সমুদ্রে যেন ভেসে চলেছি। বাতিঘরে দাঁড়িয়ে একটি প্রতীকী বাতিঘর, এইসব আলোর পথযাত্রীকে আলো দেখাবার জন্য। । চট্টগ্রাম শহরে সেদিন যেন এক বিস্ময়ের জন্ম হয়েছিল। একজন বইপ্রেমীর যা কিছু চাওয়া, সবই পাওয়ায় রূপ নিয়েছিল এখানে। অবসর থাকলে অনেকটা সময় এখানে কাটিয়ে দেয়া যায় বই পড়ে, বই-এর সঙ্গে আলাপ ক’রে।

যারা কবিতা লেখেন, যারা গল্প লেখেন, ছবি আঁকেন যাঁরা বা গানের মানুষ যারা…নিজেদের মধ্যে তাদের আলাপে-আড্ডায় দিনে দিনে সেতু হয়ে উঠেছিল এই বাতিঘর। হয়তো এখানে এসে একে অন্যের কাছে প্রেরণাও মিলতো কিছু। প্রায় প্রতিমাসেই একবার করে বসতো কবিতা পাঠের আসর, নতুন বইয়ের প্রকাশনা উৎসব বা লেখক পাঠকের সম্মিলন। ঢাকার বাতিঘরে এখন প্রায় নিয়মিত হলেও, চট্টগ্রামে সেই আয়োজনে ছেদ পড়েছে করোনাকালের আগে থেকেই। আমাদের সেই সুদিন ফিরে আসুক, ঐকান্তিক কামনা রইলো। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কিছুটা স্মৃতিকাতর না হয়ে পারলাম না। একটু পেছন ফিরে তাকালে স্মৃতির পর্দায় জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে ফেব্রুয়ারি ২০১২-এর সেই সন্ধ্যাটা। চেরাগির মোড়ে সেই পুরনো ছোট্ট বাতিঘরে হয়েছিল আমার ‘মেঘ অরণ্যে’র প্রকাশনা উৎসব। ছোট্ট দোকানটার সামনের ফুটপাথে হয়েছিল ছোট্ট আয়োজন। সর্বমান্য বেগম মুশতারী শফী, হরিশংকর জলদাশ আর আবুল মোমেন-এর মতো শ্রদ্ধেয় অগ্রজ লেখকদের গ্রন্থের সাথে আমার মত অকৃতি অধমের কবিতা গ্রন্থের পরিচিতি প্রকাশ…আহা! ভাবলেই নিজেকে ধন্য মনে হয়।

কত কত স্মৃতিময় এই বাতিঘর। চোখ বুজলে শিমুলতুলোর মতো উড়তে দেখি ভাবনার চারপাশ জুড়ে। প্রীতিময় স্মৃতিদের ভিড়ে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ রেখে গেল ২০২০- এর জানুয়ারির এক সন্ধ্যা। সেই সন্ধ্যায় বাতিঘর ‘দীর্ঘায়ু চাইনি, আনন্দায়ু দাও’ প্রকাশ করে আমার আয়ুতে এক পৃথিবী আনন্দ যোগ করে দিয়েছিল আবারো। আমার কাব্যগ্রন্থ যেমন আমার প্রিয়, পৃথিবী জুড়ে ক’জন মানুষও আছেন, আমার প্রিয়। বিদেশ-প্রবাস থেকে তারা যখনই এ-শহরে এসেছে বেড়াতে, ‘বাতিঘর’কে করেছি তাদের ভ্রমণের অন্যতম অনুষঙ্গ। আর আমাদের পুত্র আদির তো এ শহরে সবচেয়ে প্রিয় অবসরযাপনের স্থানই ছিল এই ‘বাতিঘর’। এমনও দিন গেছে, ওকে বাতিঘরে রেখে চলে গেছি। আমরা আমাদের উৎসব- নেমন্তন্ন সেরে, বাড়ি ফেরবার পথে ওকে আবার সাথে নিয়ে নিয়েছি! গত অনেকগুলো বছর পয়লা বৈশাখের সকালে ডিসি হিল, চারুকলা ঘুরে বাতিঘর-এ যাওয়াটা আবশ্যিক ঘটনা হয়ে উঠেছিল। আড্ডা হতো, মন বিরামও পেত তাতে। এসব কি ভুলবার! এখনও যখনই বাতিঘরে যাই, বিদেশ-স্বদেশ-পরবাসের সেইসব প্রিয় মানুষের প্রিয়সঙ্গগুলো আমাকে উষ্ণতা দেয়, আজও- যেন, ‘এখানে তুমি ছিলে, এখানে নীরা ছিল, এখনও এ পাথরে রয়েছে উষ্ণতা।’

শুধু আমার নিজেকেই নয়, পুরো চট্টগ্রামের সাহিত্য-শিল্পঅনুরাগী বহুজনকেই গুণীজন সান্নিধ্য-সমৃদ্ধ করেছে বাতিঘর। ২০১২ তে নতুন রূপের বাতিঘর-এর সৃষ্টির শুভলগ্নে এসেছিলেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ আর জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ। বাতিঘর নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করার পরপরই প্রথমে পেয়েছিলাম কবি সুবোধ সরকারকে। সে বছরই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিদায় নিলেন। ওঁকেও আমরা বাতিঘরে পেলাম। বাতিঘর-এর প্রথম শোক আর শ্রদ্ধার আয়োজন- সুনীল স্মরণে।

তারপর থেকে একে একে কবি হেলাল হাফিজ, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, নাসরীন জাহান, মুনতাসির মামুন, ডঃ আনিসুজ্জামান, জাফর ইকবাল, ভারতীয় লেখক বিক্রম শেঠ, সমরেশ মজুমদার, রণজিৎ দাশ এই বাতিঘরে এসে আমাদের সকলকে সমৃদ্ধ করেছেন। আর বাতিঘরের সৌরভে তারাও বিমোহিত হয়েছেন। চট্টগ্রামের বাইরে থেকে যারা এই শহরে আসেন, কিংবা দেশের বাইরে থেকেও… সকলেই এই দর্শনীয় জায়গাটি একবার হলেও ঘুরে যান। এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন নন্দিত লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী। এতোগুলো সমৃদ্ধ সান্নিধ্য দেয়ার জন্য ধন্যবাদ বাতিঘরকে, খ্যাতনামা এই লেখকদেরকে এতো কাছ থেকে দেখার এবং জানার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। অপেক্ষায় ছিলাম, প্রিয় কবি জয় গোস্বামী কবে বাতিঘরে এসে ধন্য করবেন আমাদেরকে! তিনি এসেও আনন্দ-আয়োজনে আমাদেরকে আনন্দ দিয়ে গেলেন বাতিঘরে, নিকট অতীতে।

বাতিঘরের নাম উচ্চারণ করলে সঙ্গে সঙ্গেই যে নামটির নাম অনুচ্চারিত রাখাটা অন্যায় বলে গণ্য হবে, তিনি দীপঙ্কর দাশ। যে মানুষটা শুধু স্বপ্নের নয়, একই সাথে সাহসেরও প্রতীক। যার স্বপ্নের ছোঁয়া লেগে আমাদেরও মধ্যে কখনো কখনো জীবনের সঞ্চার হয় নতুন করে। যিনি সক্ষম, মানুষের ভেতরে সাহসের বীজ বুনে দিতে। আমরা বেশিরভাগ সাধারণ মানুষেরা জীবনকে শুধুই যাপন করি, আর বাতিঘর-এর এই ধারক-মানুষটি পেরেছেন তাঁর অক্লান্ত চেষ্টা ও ইচ্ছায় আমাদের সেই যাপিত জীবনকে জীবনময় করে তুলতে।

সারাজীবন, সারাটা দীর্ঘজীবন অপেক্ষার পর জীবনের অন্তিমে গিয়ে হয়তো মনে রাখার মত একটি ভাল কাজ করতে পারেন একজন মানুষ। কিন্তু দীপঙ্কর দাশ নামের এই রুচিশীল, সংস্কৃতিঋদ্ধ, সর্বোপরি ব্যবহারে দারুণ আন্তরিক এই বইয়ের মানুষটি তাঁর জীবনের মাঝপথেই হয়তো বাতিঘর-এর মত একটি অনুপম প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে দেখালেন, মহোত্তম কাজের জন্য জীবনের শেষ ভাগ পর্যন্ত অপেক্ষার প্রয়োজন হয় না। দীর্ঘজীবী হোক বাতিঘর…অদ্ভুত আঁধার এক নেমে আসা আমাদের এই শহরে আলো দেখাক ‘বাতিঘর’। আমাদের ভুবন জুড়ে আলো ছড়াক, দিশাহীন ভাবনাকে পথ দেখাক, হৃদয়ে আলোখানি ধরুক সকলের প্রিয় এই আলোয় আলোকময় ‘বাতিঘর’।

অতি সমপ্রতি বাতিঘর-এর দেড় যুগ পূর্তি হলো। বাতিঘর আজ আঠারো হলো। দেখতে দেখতে বাতিঘর আজ সত্যিই প্রাপ্তবয়স্ক! ডানা মেলেছে কতদূর অবধি, উড়বার আকাশটা কত বিস্তৃত করে নিয়েছে! চেরাগির মোড়ের সেই আঁতুরঘর থেকে বেরিয়ে, জামালখান পেরিয়ে, ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী… একলা চলতে শিখে নিয়েছে! অফুরান অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা, বাতিঘর।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজল থেকে জল বানানো
পরবর্তী নিবন্ধখানদীঘি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি বিদায় সংবর্ধনা