বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীকে স্মরণ

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | সোমবার , ২২ এপ্রিল, ২০২৪ at ১২:৪১ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম শহরে এস.এস.খালেদ নামে একটি সড়ক আছে। জামাল খান সড়ক থেকে পশ্চিমমুখী সড়কটি ( সেন্ট মেরী’স স্কুলের পশ্চিম দিকে) এঁকেবেঁকে চলে গেছে লালখান বাজার ইস্পাহানী মোড় পর্যন্ত। এই সড়কটিরই নাম এস.এস.খালেদ সড়ক। সেন্ট মেরী’স স্কুলে পড়াকালীন সময়ে দেখেছি, একটি সিমেন্টের স্থাপনায় এস.এস. খালেদ সড়ক (১৯৭৩৭৪ সালের কথা)। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আর দেখিনি। কিছু সাইনবোর্ডে লেখা আছে। এর বেশী কিছু নয়। তবে প্রশ্ন জাগে, কে এই এস. এস. খালেদ? কী তাঁর পরিচয়? পুরো নাম কী? এসব বিশদ জানার সুযোগ নেই। অনেক বছর পর জানতে পারি, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর নামেই এই সড়ক। পুরো নাম সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী। এভাবেই তাঁকে জেনে এসেছি ছোটবেলা থেকেই।

আরও পরে জানলাম শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী হলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সাবেক সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীর বড় ছেলে। পরবর্তী সময়ে শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীর ছোট ভাই, আমার বন্ধু মহিউদ্দিন আহমদ চৌধুরীর কাছেই এই বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে অল্পকিছু জানার সুযোগ হয়।

কিছুদিন আগে শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীর ছোট ভাই বর্তমান নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি শ্রদ্ধেয় মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী একটি বই উপহার দিলেন। বইটির নাম মৃত্যুঞ্জয়ী বীর শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী সম্পাদিত এই বইটি শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদের বন্ধু, সহযোদ্ধা, ভাই, রাজনৈতিক আদর্শের সহকর্মীসহ বর্তমান প্রজন্মের তাঁর আদর্শের সৈনিকেরা লিখেছেন। নিঃসন্দেহে বইটি মূল্যবান। কারণ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের শুরুর দিকে চট্টগ্রাম নগরীর পরিস্থিতি, শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীর বীরোচিত ভূমিকা এবং সর্বোপরি অজানা এক বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে জানতে পারি।

ইদরিস আলম ‘নিঃসঙ্গ বন্ধু’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “বরাবরই আমরা নিঃসঙ্গ বন্ধু ছিলাম এবং প্রতিকূল পরিবেশে সোচ্চার হতে অভ্যস্ত ছিলাম।” ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে শহীদ সাইফুদ্দিনকে এভাবেই মূল্যায়ন করলেন তিনি। প্রতিকূল পরিবেশে সোচ্চার হওয়ার মতো গুণাবলী সমৃদ্ধ মানুষ ছিলেন শহীদ সাইফুদ্দিন।

আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোছলেম উদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, “সাইফুদ্দিন আমার বাল্যবন্ধু। একই পাড়ায় বসবাস করার সুবাদে ছোটকাল থেকে তার সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠে। সে ছিল একজন ভালো বন্ধু এবং মোহনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষ। তাঁর হাত ধরেই অনেকের রাজনৈতিক জীবনের উত্থান। আমার রাজনীতি করার পেছনে তাঁর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিল।সাইফুদ্দিন খালেদ ছিল সত্যিকার অর্থেই মানবদরদী। ১৯৭০এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে দেশের ব্যাপক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানবদরদী সাইফুদ্দিনকে ঐ ত্রাণ তৎপরতায় আমরা নতুনভাবে চিনতে পেরেছি। সাইফুদ্দিন তিনদিনের ত্রাণ কাজে অমানুষিক পরিশ্রম করেছিল।”

একজন দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন সাইফুদ্দিন খালেদ ? এই বিষয়ে ধারণা পাই গোফরান গাজীর লেখা “বাগমনিরামের জানালা” শীর্ষক প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন: “সে বলেছিল, আমি খাঁটি দেশপ্রেমিক। আমি ঘরসংসার করার খেয়াল খুব একটা রাখি না। আমি দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেব। আরও বলেছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমার জীবন ও যৌবন উৎসর্গ করে দেব।” এবং কী আশ্চর্য সাইফুদ্দিন খালেদ যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনটিই করে দেখিয়েছেন।

আলোচ্য এই বইয়ে মোঃ শফর আলী লিখেছেন “সাইফুদ্দিন আর কখনো ফিরে আসবে না। সে কিছু পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগত চাওয়াপাওয়া কিছু নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের চাওয়াপাওয়া হলো একটি স্বাধীন পতাকা, যে আদর্শ চেতনা নিয়ে জীবন উৎসর্গ করার জন্য বুলেটের জ্বলন্ত সেলে বুক পেতে দিয়েছিল সেটার বাস্তবায়ন।” তিনি খুব সত্যি কথা লিখেছেন। যা এই প্রজন্মকে ভাবায়।

১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম শহরে যে তরুণদল পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী। সেই সময়ে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহসাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তুখোড় বক্তা, দক্ষ সংগঠক, সদালাপী ও বন্ধুবৎসল হিসেবে সাইফুদ্দিন খালেদের সুনাম ছিল। বাবা জহুর আহমদ চৌধুরীর মতই সাংগঠনিক দক্ষতা ও বাগ্মী ছিলেন তিনি। ফলে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে তিনি অকুতোভয় ও দুঃসাহসী হয়ে বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি দল। সেই দলে ছিলেন চাকসু’র সাধারণ সম্পদক আবদুর রব, শেখ মোজাফফর আহমদ, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী, সুলতানুল কবীর চৌধুরী, কানাডা প্রবাসী জোবায়ের, শফর আলী, আলী আবদুল্লাহ, সমীর সেন, হারুন অর রশীদ, ফিরোজ আহমদ, মো: নুরুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ এবং ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা তরুণ ছাত্র নেতা সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অন্যায় ও নিপিড়নের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার এই তরুণ ছাত্রনেতার সেই দিনের ভূমিকা যাঁরা সেই সময়ে তাঁকে কাছ থেকে দেখেছিলেন, তাঁদের স্মৃতিচারণে আমাদের প্রজন্মের জানার সুযোগ ঘটে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে।

১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম থেকে গাড়িতে করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাওয়ার পথে রাউজান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ হারান সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, আবদুর রব, শেখ মোজাফফর আহমদ, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী, ড্রাইভার ইসলাম। অকালেই পৃথিবী থেকে ঝরে পড়লো বীর তরুণের প্রাণ। যারা জীবন দিয়ে গেলেন এই বাংলাদেশের জন্য।

বাবা জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ড প্রধান। তাঁর উপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অগাধ আস্থা। সেই আস্থার পরিচয় জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী আমৃত্যু দিয়ে গিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হলো। বাঙালি জাতি পেল নতুন মানচিত্র খচিত রাষ্ট্র বাংলাদেশ। কিন্তু একজন পিতা জহুর আহমদ চৌধুরী হারালেন তাঁর প্রিয়তম বড় সন্তান সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীকে। পুত্র শোকে কাতর। মা জাহানারা বেগমকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা নেই। শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদের নিকটজন বন্ধু, ভাইরা এসে শোকাহত মাবাবার পাশে এসে দাঁড়ালেন। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের একজন হয়ে গেলেন সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী।

জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, “তাকিয়ে দেখ জহুর আহমদ চৌধুরীর দিকে। এই মন্ত্রীর সন্তান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। আমার আর কোনো মন্ত্রীর ছেলে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়নি।”

রাউজান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে গণকবরে শায়িত ছিলেন শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী। পরে ৪১ বছর পর ২০১২ সালে সেই গণকবর থেকে শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদের মৃতদেহ নিয়ে এসে দামপাড়াস্থ পারিবারিক কবরস্থানে বাবা জহুর আহমদ চৌধুরীর কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়ক বাবাছেলে আজ পাশাপাশি আছেন।

গত ১৩ এপ্রিল ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী। নতুন প্রজন্মের জন্য শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী স্মারক স্তম্ভ নগরীতে স্থাপন করা বিশেষ প্রয়োজন। শুরুতেই যে সড়কটির কথা বলেছিলাম, সেই সড়কে তা নতুন করেআবক্ষ মূর্তি, পরিচিতি, পূর্ণাঙ্গ নামসহ স্থাপন করা প্রয়োজন। জাতির সামনে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হলে এর বিকল্প নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রামের বীর শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যদি আমরা যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করি, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও তথ্য হারিয়ে যাবে। আশা করি, চট্টগ্রামের সচেতন মহল, নগর কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ ও বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমায়ের হাতের সেলাই করা কাঁথা নিয়ে প্রদর্শনী
পরবর্তী নিবন্ধআলকরণ গীতা বিদ্যাপীঠে ছাত্র-ছাত্রীদের পুরস্কার বিতরণ