পর্ব–১
১৯৩৩ সাল।
ব্রিটিশদের বিশাল বহর প্রথম এভারেস্ট আরোহণের প্রায় বিশ বছর আগের কথা। মরিস উইলসন নামক এক ৩৪ বছর বয়সী ইংরেজ ঘোষণা করেন তিনি একাকী এভারেস্ট আরোহণ করবেন! ঘোষণা আরো চমকপ্রদ হয়ে উঠে যখন তিনি যোগ করেন যে তিনি বেসক্যাম্প পর্যন্ত উড়ে যাবেন বিমানে–যা কিনা আবার উড়াবেন তিনি নিজেই! এই ধরনের খ্যাপাটে ভাবনার কারণেই ১৯৩৪ এর গ্রীষ্মে এভারেস্টের বরফাচ্ছন্ন উত্তর ঢালে চিরনিদ্রার আগে উইলসন হয়ে উঠেন পর্বতারোহণ ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তি। গণমাধ্যম, জনসাধারণ, সরকার এবং পর্বতারোহণ মহলের কারো কাছে হয়ে উঠেন পূজনীয়, কারো কাছে হয়ে উঠেন ঠাট্টার পাত্র।
উইলসনের মৃতদেহ হিমবাহের সমাধি ফুঁড়ে ১৯৫৯, ৭৫, ৮৫, ৮৯ এবং ৯৯ এর অভিযাত্রীদের সামনে বেরিয়ে এলেও তাঁর গল্প কালের গর্ভে বিলীন প্রায়। কে তিনি? একজন বড্ড উন্মাদ? স্বয়ংসম্পূর্ণ পর্বতারোহণের একজন কিংবদন্তি? পর্বতারোহী হতে চাওয়া একজন সাদাসিধে মানুষ? সত্যি করে বলতে গেলে এই বিশেষণের কোনটিই এভারেস্ট নিয়ে উদ্ভট রকমের এই ভাবোন্মত্তকে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যর্থ।
কোন মাপকাঠিতেই উইলসন পৃথিবীর শীর্ষে দাঁড়ানো প্রথম ব্যক্তি হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। সৈনিক হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধে দুইবার গুলিবিদ্ধ হয়ে চিরতরে হারিয়ে ফেলেন বাম বাহু নাড়াচাড়ার ক্ষমতা। এভারেস্ট অভিযানের বছর খানেক আগে আক্রান্ত হন যক্ষ্মা রোগে। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল তাঁর। ঘরে ছিল নিয়ন্ত্রণহীন এক অসংযমী স্ত্রী। আর বাইরে ছিল যুদ্ধ পরবর্তী অস্থিতিশীলতা। প্রতিকূলতার তালিকা এখানেই সমাপ্ত নয়। জেনে অবাক হবেন যে অভিযানের ঘোষণা দেওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি কখনো বিমান চালাননি এবং কোনো পর্বত আরোহণ করেননি!
কিন্তু প্রতিকূলতা যাকে থামিয়ে দেয়, তাকে নিয়ে আবার গল্প কীসের? উইলসন লন্ডনে দুই মাসের এক বিমান চালনা কর্মশালা সম্পন্ন করেন। সাথে লেক ডিস্ট্রিক্টে অল্প কিছু হাইকিং। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৩৩ সালের ২১ মে বেরিয়ে পড়েন স্বপ্ন পূরণে। উন্নত বিমান কেনার সামর্থ্য ছিল না তাঁর। তাই জোগাড় করেন এক জীর্ণ ‘জিপসি মথ’ নামক বিমান, যার সুবিধা ছিল সমসাময়িক বিমান থেকে অনেক পিছিয়ে। বিমানের একটি দারুণ নামও দিলেন ‘এভার–রেস্ট (ঊাবৎ–ডৎবংঃ)’। দর্শনে বিমানটি আধুনিক প্রযুক্তির পরিবর্তে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়কেই স্মরণ করিয়ে দিত। এই প্রাগৈতিহাসিক বিমান নিয়েই উইলসন যাত্রা শুরু করেন। আর পেছনে রেখে যান একদল বিক্ষুব্ধ সমালোচক।
৬২০ মাইল উড্ডয়নের মতো জ্বালানির ধারণক্ষমতা ছিল বিমানটির। এই ধারণক্ষমতা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং আবহাওয়া মাথায় রেখে ঠিক করলেন নিজের যাত্রাপথ। লন্ডন থেকে গেলেন ফ্রেইবার্গ। সেখান থেকে আল্পস পাড়ির এক ব্যর্থ চেষ্টার পর আবার ফিরে আসেন ফ্রেইবার্গে। শেষ পর্যন্ত পশ্চিম আল্পস দিয়ে পৌঁছেন রোম। সেখানে অবতরণের আগেই পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর অভিযানের খবর। কয়েকদিন পর তিউনিশিয়ার পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিলেন। লন্ডন থেকে যাত্রা শুরুর এক সপ্তাহে পৌঁছে গেলেন কায়রো। কয়েকদিন পর উইলসন পৌঁছান বাগদাদ। এদিকে গণমাধ্যম তাঁকে নিয়ে পাগলপ্রায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ২০–৩০ এর দশকে পর্বত অভিযানের খবরের স্থান হতো পত্রিকার প্রথম পাতায়। উইলসনের গল্প ছিল অবশ্যই সংবাদ হওয়ার মতোই। এমনকি লন্ডনের সাংবাদিকতার মূল স্তম্ভ খ্যাত ‘টাইমস’ পর্যন্ত গা ভাসিয়ে দেয় উইলসনের সৃষ্ট স্রোতে। ১৯৩৩–৩৪ সালে টাইমস একাই এভারেস্ট নিয়ে ১৫১টি লেখা প্রকাশ করে, যার মধ্যে প্রায় শ’খানেকেই ছিল উইলসনের অভিযানের কথা।
উইলসনের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে এই অভিযান সাধারণের কাছে আলোড়ন তুললেও বিন্দুমাত্র সাড়া ফেলতে পারেনি তখনকার সরকার এবং পর্বতারোহণের হর্তাকর্তাদের মাঝে। এভারেস্ট তখনো অজেয়। কিন্তু এজন্য চেষ্টার অভাব কোনোভাবে দায়ী নয়। ১৯২০–৩০ এর দশকে একাধিকবার ব্রিটিশরা এই পর্বত আরোহণের চেষ্টা করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯২৪ সালে ম্যালরি–আরভিনের সেই মহাকাব্যিক অভিযান। ব্যর্থতা ছাড়াও ওই অভিযানগুলোর সবকটিতেই ছিল বিশাল বহর, সামরিক বাতাবরণ, আল্পাইন ক্লাব ও রয়েল জিওগ্রাফিক সোসাইটির সক্রিয় দিকনির্দেশনা। এই সম্ভ্রান্ত, উঁচুস্তরের প্রতিষ্ঠানগুলোর ছিল সরকার এবং সামরিক বাহিনীর সাথে অতি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তারা এই যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে অন্য দেশের পর্বতারোহীদের অথবা নিজেদের ক্লাবের সদস্য নয় এমন কাউকে পৃথিবীর এই তৃতীয় মেরুর দিকে হাত বাড়ানো থেকে দূরে রাখত। ম্যালরি ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম। তিনি সেই সময় এতই ভালো পর্বতারোহী ছিলেন যে তাঁকে বাদ দিয়ে কিছু চিন্তা করা সম্ভব ছিল না। আল্পাইন ক্লাবের অনেক সদস্যই শুধুমাত্র চিত্তের খোরাক জোগাতেই আরোহণ করলেও অভিযানের উদ্দেশ্য থাকত আরো ব্যাপকজাতীয় গৌরব।
বাগদাদ থেকে নেপাল বা তিব্বতের উদ্দেশ্যে উইলসনের পরিকল্পিত উড্ডয়ন পথ ছিল পারস্য দিয়ে। ঐসময় এই দেশগুলো আকাশ সীমা দিয়ে উড়ার অনুমতি প্রদানে খুবই গড়িমসি করত। পূর্ববর্তী অভিযানগুলো অনুমতি জোগাড়ে নির্ভর করেছিল ব্র্রিটিশদের কূটনৈতিক চালের উপর। এদিকে উইলসনের ব্যাপারে সরকার এবং বিমান মন্ত্রণালয় কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েই রেখেছিল। তিনি বাগদাদেই বাধা পেলেন। পারস্য পাড়ি দেওয়ার অনুমতি পেলেন না। বলা হলো আরব সাগর বরাবর দক্ষিণ দিকে উড়ে যেতে। অসম্ভব প্রস্তাব। কারণ এই পথের কোনো দিকনির্দেশনা হাতে নেই। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ উইলসন করলেন আরেক অদ্ভুত কান্ড। বাজার থেকে কিনলেন বাচ্চাদের উপযোগী এক মানচিত্র। এর উপর ভরসা করেই উইলসন বাগদাদ হতে আকাশে ভাসিয়ে দিলেন তাঁর এভার–রেস্ট। অনেক পথ উড়ে পেট্রোল ট্যাংক প্রায় খালি অবস্থায় কোনোভাবে অবতরণ করলেন ৬২০ মাইল দূরের বাহরাইনে।
এতোদিন অসহযোগিতা ছিল পরোক্ষ। বাহরাইনে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ কর্মকর্তারা উইলসনের অগ্রযাত্রায় প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করেন। একজন পুলিশ অফিসার নিজের কার্যালয়ে তাঁকে ডেকে নিয়ে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলেন ‘রয়েল এয়ার ফোর্স’ সামনের আকাশপথ জনসাধারণের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। আরো জানিয়ে দিলেন যে তাঁকে এখনই বাগদাদে ফিরতে হবে; নতুবা গ্রেফতার করা হবে। এদিকে উইলসন চিরকালই আশাবাদী দলের মানুষ। আলাপের ফাঁকে অফিসের দেয়ালে সেঁটে থাকা বিশালাকার মানচিত্রে চোখ বুলিয়ে নিলেন। এক সুযোগে দ্রুত হাতের তালুতে কিছু নোট নিয়ে নিলেন। তিনি বাগদাদে ফিরছেন বলে বিমানে চড়ে বসলেন। আসলে তাঁর মনে চলছে অন্যকিছু। বিমানের নাক ঘুরিয়ে দিলেন বাগদাদের পরিবর্তে ভারতবর্ষ বরাবর পূর্ব দিকে। এই পথের দূরত্ব ৭৪৫ মাইল, যা ৬২০ মাইল উড্ডয়ন ক্ষমতাসম্পন্ন এভার–রেস্ট এর ক্ষমতার বাইরে। মাঝপথে পরিশ্রান্ত ইঞ্জিন কয়েকবার কাশি দিয়ে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। প্রশিক্ষণ চলাকালে কখনো চেষ্টা করেছিলেন কি না জানা নেই, তবে কীভাবে যেন অত্যন্ত জটিল জরুরি অবতরণের কাজ তিনি সুচারুভাবে সম্পন্ন করলেন। সূর্য্যি মামার বিদায় ক্ষণে নিরাপদে নেমে এলেন পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরে।
একজন নবিশ বিমানচালক জীর্ণ এক বিমান নিয়ে এইদিন যেভাবে আকাশে উড়লেন তা কোনোভাবেই এভারেস্ট আরোহনের চেয়ে কম গৌরবের নয়।
কয়েকদিন পর গোয়াদর থেকে উড়ে গেলেন নেপাল সীমানার আগে ভারতের শেষ এয়ারফিল্ডে। এখানে পৌঁছাতে তিনি ১৭ দিনে ৪,৩৫০ মাইল পথ পাড়ি দেন। অবশ্য আনন্দ বিলীন হতে খুব একটা সময় লাগল না। স্থানীয় ব্রিটিশ প্রতিনিধি বিমান বাজেয়াপ্ত করে তাঁকে নজরবন্দি করেন। কিন্তু এসবে উইলসন দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। ভরা বর্ষায় ১৮৬ মাইল রাস্তা হেঁটে পৌঁছে গেলেন নেপাল সীমান্তে। পরিকল্পনা ছিল নেপালের রাজার সাথে সরাসরি ফোনে কথা বলার চেষ্টা করবেন। কিন্তু কাঠমান্ডুর আমলারা তাঁর আকুতিতে বিগলিত হলেন না। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন নেপালের দিক থেকে উড্ডয়ন, হাইকিং অথবা এভারেস্ট আরোহন কোনো প্রকার অনুমতিই উইলসনকে দেওয়া হবে না।