জল থেকে জল বানানো

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ২০ জুন, ২০২২ at ১১:০০ পূর্বাহ্ণ

আজকের এই লেখাটি একজন পাঠিকার অনুরোধে লেখা হলো।

জল থেকেই জল বানাতে পারবেন? ধরুন- আপনি আমাকে একটু জল দেবেন, আমি সেই জলকে জল বানিয়ে দেবো। ব্যাপারটা কীরকম হবে? বেশ ভালো, তাই না? Snake-oil Salesman নামে একধরনের ঠগ্‌ মানুষ আছে, তারা মানুষকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আজেবাজে জিনিস বা আইডিয়া বিক্রি করতে ওস্তাদ। আমাকেও সেইরকম মনে হচ্ছে, তাই না? সত্যিই, বিশ্বাস করুন, আমি একটুও বানিয়ে বলছি না – জাহাজে আমরা জল থেকে জল বানাতাম। তবে সেটা হলো সমুদ্রের লোনা পানিকে বিশুদ্ধ করে পান করার সুপেয় পানি।

জাহাজ তো একটা গোটা শহরের মতনই – সখানে অনেককিছুই আছে, যা কিনা একটা পরিপূর্ণ শহরে লাগে। আমরা নিজেরাই নিজেদের বিদ্যুৎ উৎপাদন করি, নিজেদেরই হাসপাতাল (sickbay) আছে, আমরা সকলেই কিছুটা হলেও ডাক্তারি জানি এবং জাহাজের সেকেন্ড অফিসার মেডিক্যাল-ইনচার্জ। আমরা সকলেই ফায়ার-ফাইটারও। আমাদের পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থাও আমরাই ম্যানেজ করি। এইরকম আরও কতকিছু। অথৈ সমুদ্রের মাঝে আমাদের সব প্রয়োজনই যেন আমরা নিজেরাই মিটিয়ে ফেলতে পারি, আমরা সেভাবেই ট্রেইন্ড্‌। ইমার্জেন্সি হলে অবশ্যই অনেককিছুই সম্ভব- হেলিকপ্টার বা রেসকিউ-বোট আসতে পারবে- কিন্তু তারপরে একটা মোটাসোটা অঙ্কের বিল হাতে ধরিয়ে দিবে। স্বাভাবিকভাবেই জাহাজের মালিকপক্ষ সেটা চায় না; আর আমরাও স্বনির্ভর থাকাটাকেই পছন্দ করি- একজন মেরিনার সবসময়ই jack of all trades (মাঝে মাঝে সবকিছুরই master-ও বটে)।

এবারে খাওয়ার-দাওয়ার ব্যাপারে বলি- আমরা বলি provision; জাহাজে বড় বড় ড্রাই-স্টোরে শুকনা খাওয়ার নর্মাল রুম-টেম্পারেচারে রাখা হয়- চাল-ডাল, তেল, আটা, লবণ-মশলা, ক্যান্ড্‌-ফুড, সেমাই-সুজি-স্প্যাগেটি-পাস্তা ইত্যাদি। এছাড়াও বেশ কয়েকটা বড়সড় আকারের প্রমাণসাইজের রুমের সমান ফ্রিজ আছে। কোল্ড স্টোরেজও বলতে পারেন। রেগুলার ঠান্ডা রেফ্রিজেরেটার-রুম আর ডিপ-ফ্রিজার-রুম দুইটাই থাকে; দুই ধরনের খাওয়ার রাখার জন্য। সুবিধামত পোর্টে থাকা অবস্থাতেই আমরা সবগুলো স্টোর ভর্তি করে প্রভিশান নিয়ে নেই, যাতে আগামী বেশ কয়েকদিন বা কয়েকমাস চলে যেতে পারে। জাহাজে খাওয়ার শর্ট পড়লে চলবে না; একই মেনু দিনের পর দিন দিয়ে বোরিং করা যাবে না, আর সেসঙ্গে সকলের সুস্বাস্থ্য এবং পুষ্টির দিকেই খেয়াল রাখতে হবে। জাহাজে বাটলার ছিলো, সে আর চিফ-কুক মিলে এগুলোর দায়িত্ব পালন করতো।

এবারে আসি পানির ব্যাপারে- জাহাজে প্রধানত তিন ধরনের পানি লাগে- সি-ওয়াটার (বা সল্ট-ওয়াটার); ফ্রেশ ওয়াটার এবং ড্রিঙ্কিং ওয়াটার। সি বা সল্ট ওয়াটার বলছি, কিন্তু আসলে সেটা যে সমুদ্রের এবং লবণাক্ত হতেই হবে এমন না। জাহাজের বাইরে যেই পানি আছে, (নদীরই হোক বা সমুদ্রেরই হোক) সেটাকেই পাম্প করে আমরা নিয়ে নিই; এবং সি বা সল্ট ওয়াটার বলি। এই পানি খালি-জাহাজের ব্যালাস্ট ট্যাঙ্কে ভরে জাহাজকে একটু স্ট্যাবল করা হয়। বড় বড় পাম্প দিয়ে পানি নিয়ে ভরে নিই; তারপরে মাল লোডিং-এর আগে আবার বাইরে ফেলে দেই, (যদিও আজকাল এব্যাপারে বেশ কড়া বিধিনিষেধ আছে, পরিবেশ-দূষণের জন্যে)। এছাড়াও ইঞ্জিন-জেনারেটর-কমেপ্রসার ইত্যাদিকে ঠান্ডা করার জন্যও পানি লাগে। গাড়িতে রেডিয়েটার থাকে, সেখানের কুল্যান্ট গিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন ঠান্ডা করে, আর সেই কুল্যান্টকে ঠান্ডা করে বাতাস। জাহাজের ইঞ্জিন তো বিশাল বড়- তিনচারতলা বিল্ডিং-এর সমান। সেই ইঞ্জিনের জন্য বাতাস দিয়ে ঠান্ডা করা রেডিয়েটারে কাজ হবে না। সেগুলোকে পানি দিয়ে ঠান্ডা করা হয়। সমুদ্রের পানি দিয়ে ঠান্ডা করতে গেলে দামী ইঞ্জিনের বডি সমুদ্রের লোনা পানিতে নষ্ট হয়ে ক্ষয়ে যাবে। তাই ফ্রেশ-ওয়াটার ইঞ্জিনকে ঠান্ডা করে গরম হয়; আর সেই গরম ফ্রেশ-ওয়াটারকে ঠান্ডা করে সমুদ্রের পানি- দুইটা পানির দুইটা ভিন্ন সাইকেল চলছে। সেইজন্যেই, কখনো কোনো জাহাজের কাছাকাছি গেলে দেখবেন জাহাজের গায়ের এক জায়গা থেকে ক্রমাগত পানি বের হচ্ছে- এগুলো সেই পানি।

সমুদ্রের পানি তো ফ্রি, কিন্তু ফ্রেশ-ওয়াটার পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। খাবার ও রান্নার জন্য ড্রিঙ্কিং ওয়াটার রাখা হয়। বাথরুম-গোসল, কাপড় ধোয়া ইত্যাদি কাজের জন্যও কিছুটা রাখা হয়। এরপরে ফ্রেশ-ওয়াটার ইঞ্জিন-বয়লার-কমেপ্রসার ইত্যাদি মেশিনারিজের জন্য। বিশাল বিশাল ট্যাঙ্কভর্তি করে এই সমস্ত পানি ভাগ ভাগ করা থাকে। হিসাব করে খরচ করতে হয়- কারণ পোর্ট থেকে পানি বেশ দাম দিয়েই কিনতে হয়। আর মাঝ-সমুদ্রে একবার পানি শেষ হয়ে গেলে, খবর আছে। মনে আছে- ‘Water, water everywhere, not any drop to drink ; পানি- রেশনিং-এর যন্ত্রণা ভোগ করা খুবই কষ্টের। তাই আমরা সমুদ্রের লোনা পানিকে মিষ্টি করার চেষ্টায় থাকি সবসময়ই। দুই প্রসেসে করা যায়- পাতন (distillation) এবং রিভার্স-অস্মোসিস্‌ (reverse-osmosis)।

স্কুল-কলেজে কেমিস্ট্রিতে লবণ-পানি আলাদা করার এক্সপেরিমেন্ট করতাম। লবণ- গোলা পানিকে গরম করে ফুটিয়ে, বাষ্প হয়ে উবে গেলে, লবণ আলাদা হয়ে নীচে পড়ে থাকে। সেই বাষ্পকে বাতাসে না ছেড়ে যদি একটা ঠান্ডা পাত্র উপুড় করে ধরেন, তাহলে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ পানিই পেয়ে যাবেন। সেরকমই, রান্না করার সময়ে পাতিলের ঢাকনা দেওয়া থাকলে, বাষ্প উঠে ঢাকনার তলে জমে যায়। সেটা হলো বিশুদ্ধ পানি এতে রান্নার মশলা-লবণ বা অন্যকিছুই নাই। সহজভাবে বললে- আমরাও সেভাবেই সমুদ্রের পানি ফুটিয়ে লবণ এবং বিশুদ্ধ পানি আলাদা করে নিই। কিন্তু এটা নর্মাল আবহাওয়ায় করতে গেলে প্রচুর তাপের দরকার। মানে-ঝামেলা ও অনেক খরচ। তাই, জাহাজে পাতন-পদ্ধতি করা হয় ভ্যাকুয়ামের মধ্যে- এর ফলে অল্পতাপেই পানি ফুটে যায়, ১০০ ডিগ্রি পর্যন্ত যেতে হয় না। ৭৫-৮০ ডিগ্রিতেই ফুটবে। সেই ফুটন্ত পানির উপরে ছাতার মত কভার থাকে (পাতিলের ঢাকনার মত)। সেই কভারে বাষ্প জমে জমে বিশুদ্ধ পানি হয়। সেগুলোকে নিয়ে এরপরে স্বাস্থ্যবিধিসম্মত প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল ও মিনারেল মিশিয়ে পান করার উপযোগী করে তোলা হয়। লবণকে (brine) অন্যদিক দিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেই। বলতে গেলে সম্পূর্ণ বিনা-পয়সায় বিশুদ্ধ পানি বানানো সম্ভব। এই মেশিনকে ফ্রেশ-ওয়াটার জেনারেটর (Fresh Water Generator) বা ডিস্যালিনেশান প্ল্যান্ট বলে। সবচেয়ে মজা হলো, জাহাজের মেইন ইঞ্জিনকে যেই পানি দিয়ে ঠান্ডা করা হয়, সেটা দিয়েই সমুদ্রের পানিকে ভ্যাকুয়ামের মাঝে ৮০ ডিগ্রিতে গরম করে ফুটানো হয়। ইঞ্জিন চলতে গিয়ে গরম হয়ে যায়, সেটাকে ঠান্ডা করতে পানি সাপ্লাই করা হয়, সেই ঠান্ডাপানি গরম হয়ে বের হয়ে আসলে, সেটাকে ফ্রেশ ওয়াটার জেনারেটরে দিয়ে বিশুদ্ধ পানি বানানো হয়। বিজ্ঞানের প্রচেষ্টা সবকিছুতেই যতটুকু সম্ভব এফিসিয়েন্সি আদায় করা যায়।

আর রিভার্স-অস্মোসিস (বিপরীত-অভিস্রবণ) পদ্ধতিতে, সমুদ্রের পানি ফিল্টারের সাহায্যে পাম্প করে জাহাজে এনে, খুবই মিহি মেমব্রেনের (পর্দা) মাঝ দিয়ে ভীষণ হাই-প্রেসারে পাম্প করা হয়। অতি উচ্চচাপে সেই মেমব্রেণ দিয়ে পানি যাওয়ার সময়ে, লবণ আলাদা হয়ে যায়। আবারো সেই একদিকে বিশুদ্ধ পানি নিয়ে প্রসেসিং করে খাওয়ার জন্য সাপ্লাই দেই; অন্যদিকে ব্রাইনকে সমুদ্রে চালান করে দেই। এই দুই পদ্ধতির যে কোনো একটা থাকে জাহাজে। এবং সেটা ঠিকমত কাজ করলে জাহাজে পানির অভাব হয় না। মেশিনের ক্যাপাসিটি থাকলে, দৈনিক ১৫টন থেকে ৩০টন অবধি পানি বানানো সম্ভব। কিন্তু এগুলো বিগড়ে গেলে, বহুত হিসাব করে চলতে হয়।

জাহাজের পানির কথাই যখন বলছি, তখন আরো কয়েকটা পানির নাম বলি। গ্রে(grey) ওয়াটার-গোসল, হাতমুখ ধোয়া পানি, গ্যালি (বা কিচেনের) পানি ইত্যাদি। ব্ল্যাক (black) ওয়াটার-বাথরুমের কমোডের ফ্ল্যাশ করা পানি। সবশেষে বিল্‌জ্‌ (bilge) ওয়াটার জাহাজের সবচেয়ে নীচের তলাকে বিল্‌জ্‌ বলে। সেখানে নানান দিক থেকে পানি আসতে পারে। ময়লা ও অন্য আবর্জনাও আসতে পারে। কোনোকিছু না আসলেই ভালো। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ হলো-সেখানে তেল বা অন্য আজেবাজে ময়লা এবং কেমিক্যাল চলে আসলে। কোনোকিছুই বাইরে সমুদ্রে/নদীতে ফেলা যাবে না, ফেললে ডাইরেক্ট ধরা খেয়ে জেল-জরিমানা। এই তিন ধরনের পানিকে ভিন্ন ভিন্ন ট্যাঙ্কে ধরে রাখতে হবে, পরে পোর্টে আসলে নিয়ে যাবে। আজ এখানেই আমার জলের বৃত্তান্ত শেষ করি। বুঝতেই পারছেন জাহাজে জলযোগও করা হয়, আবার জলবিয়োগও হয়।

refayet@yahoo.com টলিডো, ওহাইও, ২০২২

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিছু না বলা বাবা
পরবর্তী নিবন্ধআলোয় ঋদ্ধ বাতিঘর