আজ চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস

মোহাম্মদ খোরশেদ আলম | বুধবার , ২৪ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস আজ। ৩৬ বছর আগে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘির মাঠে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ৫ জন আসামী সাবেক পুলিশ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় স্পেশাল জজ মো: ঈসমাইল হোসেনের আদালতে এ রায় ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বিকালে লালদিঘির মাঠে সমাবেশের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ সহ ১৫ দলীয় জোট। সমাবেশে যাওয়ার পথে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার গাড়ির বহরে পুলিশ তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি বর্ষণ করে। নেত্রীকে রক্ষা করতে গিয়ে সেদিন প্রাণ দিয়েছেন ২৪ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। দীর্ঘ ৫ বছর পর ১৯৯২ সালের ৫ই মার্চ চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির নেতা প্রয়াত এডভোকেট শহীদুল হুদা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলা পুনরুজ্জীবিত হয়। আদালতের আদেশে সিআইডি মামলাটি তদন্ত করে ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম এবং অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালে তদন্তের দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়। অভিযোগপত্রে আসামী হলো তৎকালীন সিএমপি কমিশনার খুনি মীর্জা রকিবুল হুদা কোতোয়ালী জোনের পেট্রোল ইন্সপেক্টর (পিআই), জেসি মণ্ডল, কনেস্টবল আবদুস সালাম, মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, বশির উদ্দীন, শাহ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দীন। এদের মধ্যে ৩ আসামী মারা গেছেন। ২০০০ সালের ৯ মে আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে মামলার বিচার শুরু করে আদালত। ২৪ জানুয়ারি লালদিঘির ঘটনায় নিহতরা হলেন মো: হাসান মুরাদ, মহিউদ্দীন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এলবার্ট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, নুরুল আলম, ডিকে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হেসেন, রিংকু দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দীন, চাঁদ মিয়া, সমর দত্ত, হাসান মিয়া, মো: কাসেম, পলাশ দত্ত, আবদুল কুদ্দুস, গৌবিন্দ দাশ ও শাহাদাত হোসেন।

সে দিন বিমান বন্দর থেকে চট্টগ্রামের লাল দিঘির মাঠ মাত্র এক ঘণ্টার পথ আসতে সময় লাগে দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা। লোকেলোকারণ্য বিমান বন্দর থেকে জনসভার স্থান পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে লাখো জনতা হাত নেড়ে নেত্রীকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছেন। নিউ মার্কেট, কোতোয়ালী মোড়, টিএন্ডটি ভবন, শহীদ মিনার, আন্দরকিল্লা, ব্রীজঘাট কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। চট্টগ্রামে দুপুর ১ টার সময় নেত্রী এসে পৌঁছলে শুরু হয় পুলিশী এ্যাকশন। নেত্রী পুলিশের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা তোমরা নিরীহ মানুষের উপর গুলি চালানো বন্ধ কর। তৎকালীন সি.এম.পি কমিশনার খুনী মির্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে পাখি শিকারের মত ২৪টি তাজা প্রাণ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিল।

মুহূর্তের মাঝেই সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল ঐ সময় নেত্রীর সাথে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমদ, আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক পুলিন দে, তৎকালীন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আওয়ামী যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসিন মন্টু (বহিষ্কৃত) সাবেক এমপি মরহুম সুলতানুল কবির চৌধুরী, কেন্দ্রীয় ও উত্তরদক্ষিণ মহানগর আওয়ামীলীগের অনেক নেতা ট্রাকে অবস্থান করছিলেন। চট্টলবীর এ.বি.এম মহিউদ্দীন চৌধুরী ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, মোছলেম উদ্দীন আহমদ এম.পি তখন কারান্তরীণ ছিলেন। এই গণহত্যা’৭১ এর গণহত্যাকে হার মানিয়েছিল কারণ রাতের অন্ধকারে পুলিশ সেইদিন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান যারাই শহীদ হয়েছিলেন তাদের সকলের লাশ বলুয়ার দিঘিপাড়স্থ অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলেছিল এবং লাশ গুম করার চেষ্টা করেছিল। তৎকালীন জেলা আইনজীবী সমিতির নেতা বর্তমান মহানগর আওয়ামী লীগ সহসভাপতি এড. ইব্রাহিম হোসেন বাবুলের নেতৃত্বে আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দসহ দলীয় নেতাকর্মীরা নেত্রীকে মানব প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখে আদালত ভবন এর উপরে নিয়ে যান আমিও সেখানে ছিলাম। ১৯৯৮ সালের ১৪ মে সহকারী পুলিশ কমিশনার হাফিজ উদ্দীন দেওয়ান ৪৭ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগ পত্র প্রদান করেন। ঐ বছর ৩ সেপ্টেম্বর আদালত সি.আই.ডি কে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। ১৯৯৯ সালের ১৪ অক্টোবর সি.আই.ডি সহকারী পুলিশ সুপার ৮ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। ১৯৯৬ সালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কাদের খাঁন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করার পর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে মামলার বিচার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। আসামী বশির উদ্দীন বাদী এড শহীদুল হুদা এবং শেষ তদন্ত কর্মকর্তা সি.আই.ডির সহকারী পুলিশ কমিশনার কাদের খান মামলা চলাকালীন সময় মৃত্যুবরণ করেন। অন্য আসামী জে.সি মণ্ডল দীর্ঘদিন ভারতে পালিয়ে থেকে সেখানে মারা যান। ২০০৩ সালে রকিবুল হুদা জামিনের শর্ত ভঙ্গ করে সপরিবারে আমেরিকা পালিয়ে যান। সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসকালে কিছুদিন পরে তিনিও মারা যান।

চট্টগ্রাম মহানগর অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে মামলার বিচার কার্যক্রম চলে আসে। এরপর সাক্ষি হাজির না হওয়ায় ২০১৪ সালে এ মামলার বিচারক এক আদেশে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধি ১৭১ () এর ধারা অনুযায়ী আসামিদের হাজির করার দায়িত্ব পুলিশকেই নিতে হবে বলে জানান। আসামিদের হাজির করে মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তি করতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্যোগে দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল স্থানান্তর করে বিচার শেষ হোক এটাই ছিল চট্টগ্রামের বিজ্ঞ আইনজীবী ও রাজনৈতিক মহলের অভিমত।

গণহত্যা মামলায় বাদীর পরিবারের পক্ষে সেই দিন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। বাদী এড. শহীদুল হুদার ছেলে এড. মো: এরশাদ হোসেন বলেন ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ ঘটনায় জড়িত ৪৬ জন আসামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার পর থেকে সিএমপির তৎকালীন কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা আমার বাবাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। ২৪ জানুয়ারির এই মামলার রায়ে ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রায়ে প্রমাণিত হলো অপরাধী যে হোক না কেন এদেশের মাটিতে বিচার একদিন হবেই। আলোচিত এই মামলার ১৬৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৩ জনের সাক্ষী গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, ডা. অনুপম সেন, সাংবাদিক অঞ্জন কুমার সেন ও হেলাল উদ্দীন চৌধুরী সহ বেশ ক’জন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী মামলার সাক্ষ্য প্রদান করেন।

নিহতদের স্মরণে ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভটি উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। এ মামলায় তিনিও একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এছাড়াও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ, সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুও রয়েছেন। তাঁদের সাক্ষি আদলতে নেওয়া হয়নি। বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে সাক্ষি হাজির না হওয়ায় মামলাটি দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল। আওয়ামীলীগ সরকার গঠনের পর রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগের মাধ্যমে সাক্ষিদের হাজির করে বিচার কার্য সম্পন্ন করেন। হত্যাকাণ্ডের ৩৬ বছরে দাঁড়িয়ে নিহত সকল শহীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিষ প্রয়োগে মাছ চুরি ও নিধন প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে