দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৪ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মানুষ গিজগিজ করছিল। রাতের বাজারের জমজমাট অবস্থা। তবে এই জমজমাট অবস্থা যতটুকু না আমাকে টানছিল তার থেকে ঢের বেশি বিস্মিত করছিল। রাস্তার উপর গড়ে উঠা অস্থায়ী একটি বাজারের এমন চাকচিক্য! এতো রাতেও এতো মানুষ কেনাকাটায় ব্যস্ত! ঘোর লাগা চোখে এদিকওদিক দেখছিলাম আমি। কী সাংঘাতিক অবস্থা! এতো এতো জিনিস হকার্স মার্কেটে বিক্রি হয়! এমন দুর্দান্ত সব জিনিস এমন সাধারণভাবে বিক্রি হতে দেখবো এমন কথা কোনদিন চিন্তাও করিনি। মাথায় ঢালা নিয়ে মোবাইল ফোন ফেরি করে বিক্রি করার একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখেছিলাম টিভিতে। রম্য টাইপের পরিবেশনা ছিল। কিন্তু আজ এই নিশিরাতে হংকংয়ের নাইট মার্কেট দেখে মনে হচ্ছিল শুধু মোবাইলই নয়, আরো বহু দামি জিনিস ফেরি করে বিক্রির অবস্থায় বিশ্ব পৌঁছে গেছে। কী দুর্দান্ত সব জিনিসপত্র অতি সাধারণভাবে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। শিল্প বিপ্লবের সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া মনে হয় একেই বলে। রাস্তার উপর গড়ে উঠা ঘন্টা কয়েকের বাজারটিতে রোবট এবং ড্রোনের মতো জিনিসপত্র বিক্রি হতে দেখে আমার চোখ কপালে উঠছিল!

অসংখ্য দোকান, থরে থরে সাজানো নানা পণ্য। শুধু রোবট, ড্রোন বা মোবাইল ফোনই নয়, বিক্রি হচ্ছে আরো নানা কিছু। বহু ধরনের পোশাক, খেলনা, ফুলের টব, ঘড়ি, চশমা থেকে শুরু করে চার্জার ক্যাবল, পাওয়ার ব্যাংক, জুতো, আয়না, চিমটি, গৃহস্থালী নানা পণ্য অর্থাৎ যে পণ্যের কথাই আপনার মনে পড়ছে সেটিই বিক্রি হচ্ছে রাস্তার বাজারটিতে। দিনভর এসব রাস্তা ধরে সাঁই সাঁই করে চলে গাড়ি, রাত হলেই বাজার বসে। গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। ঘন্টা কয়েক হুলস্থুল করে চলে বাজার সদাই। মানুষ প্রচুর কেনাকাটা করে। করে খাওয়া দাওয়াও। স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি প্রচুর পর্যটক এই মার্কেটে ঘুরঘুর করে, কেনাকাটা করে।

বেশ রাত অব্দি আমরা ঘুরলাম। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে পথ চলতে চলতে কাহিল হয়ে উঠেছিলাম। ড্রাইভার যখন ঘরে ফেরার কথা বললো তখন সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। বাজার নিয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহ নেই। নাইট মার্কেট থেকে কেনার মতো বহু জিনিস দেখলেও আমি তেমন কোন কেনাকাটা করিনি। ড্রাইভার কি কি সব কিনেছিল। আমার মতো কাস্টমারের সংখ্যা বাড়লে এই নাইট মার্কেট যে লালবাতি জ্বালাবে তা আমি নিশ্চিত।

ড্রাইভারের পেছনে হাঁটছি। ঘরে ফিরবো আমরা। নাইট মার্কেট এরিয়ার বাইরে এসে ‘এখানে দাঁড়ান’ বলে ড্রাইভার গাড়ি আনতে চলে গেলো। আমি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এতো রাতে এমন অচিন এক নগরীর ফুটপাতে একা দাঁড়িয়ে থাকা কতটুকু নিরাপদ বুঝতে পারছিলাম না। তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে, নিরাপদ না হলে ড্রাইভার আমাকে একা রেখে যেতো না।

ফুটপাতের পাশে একটি বিশাল ভবন রয়েছে। পুরো ভবনটিতে বিভিন্ন কোম্পানির অফিস রয়েছে বলে মনে হলো। রাতে বন্ধ হয়ে গেছে। কোন লোকজন নেই। রাস্তা ধরে গাড়ি চলাচল থাকলেও ভবনটির সামনে কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। প্রচুর আলো ভবনটিতে। সুউচ্চ ভবনটির দেয়ালজুড়ে চলছে বিজ্ঞাপনচিত্রের আলোআঁধারি খেলা। পুরো দেয়াল যেনো টিভি স্কিন। প্রজেক্টরে কোত্থেকে যে এই ডিজিটাল ডিসপ্লে চালানো হচ্ছে কে জানে! দেখতে মনে হচ্ছে পুরো ভবনটিই টিভি, পুরো ভবনটিই কাচের।

গাড়ির হেডলাইটের সিগন্যালে বুঝতে পারলাম যে ড্রাইভার চলে এসেছে। গাড়িতে উঠার জন্য ইশারা করলো আমাকে। ফ্রন্ট সিটে বসে পড়লাম। আমি গাড়িতে চড়ার সাথে সাথে গতি বাড়ালো ড্রাইভার। আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। একা দাঁড়িয়ে থাকার প্রসঙ্গ তুলে হাইজ্যাকার ধরার আশংকা ছিল কিনা জানতে চাইলাম। ড্রাইভার হাসলো। বললো, একেবারেই না। হংকংয়ের রাস্তায় চুরি ছিনতাই একেবারে হয় না তা বলা যাবে না, তবে একেবারে কালেভদ্রে। হংকংয়ের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি অনেক ভালো বলেও ড্রাইভার জানালো।

গাড়ি ছুটছিলো। রাত বেড়েছে, রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। কিন্তু একটি জিনিস খুব খেয়াল করলাম যে, আমার বন্ধুর ড্রাইভার প্রায় প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগুচ্ছিল। কোন গাড়ি নেই, কোথাও পুলিশ নেই, রাস্তায় একজন পথচারীও নেই। অথচ সবুজ বাতির অপেক্ষায় চালক অলস দাঁড়িয়ে থাকছিল। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করতে চালক জানালো, পুলিশ নেই তো কি হয়েছে, আইন তো মানতে হবে। বাঙালী ড্রাইভারের মুখে এমন আইন মানার কথা শুনে আমার ‘ভূতের মুখে রাম নামে’র মতো ঠেকলো!

ঘরে ফিরে দেখি আমার বন্ধু টিভি দেখছেন। পাশে ভাবী বসে কী যেনো কাজ করছেন। চিরাচরিত বাঙালী দৃশ্য। দীর্ঘদিন হংকং থাকলেও আমার বন্ধু কিংবা তার স্ত্রী সন্তানেরা কেউ বাঙালি সংস্কৃতি ছাড়েন নি। আপাদমস্তক বাঙালি ধারায় প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন। টিভিতে বাংলাদেশী সব চ্যানেল দেখার জন্য বাড়তি টাকা পয়সা খরচ করে কী যেনো ব্যবস্থা করে রেখেছেন। ওই ব্যবস্থার ফলে বাংলাদেশী সব চ্যানেল দেখা যায়। আমার বন্ধু একটি নিউজ চ্যানেল দেখছিলেন। বিদেশে থাকলেও দেশের সব খবরাখবর নিয়মিত পাওয়ার এমন সুযোগ বছর কয়েক আগেও ছিল না। এখন বিদেশে দেশি চ্যানেল ‘ছেলের হাতের মোয়া’র চেয়ে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে! ‘ছেলের হাতে মোয়া’ কথাটি মনে পড়তে আমার হাসি পেলো। কে যে সহজলভ্য বুঝাতে এমন কথা বলেছিলেন কে জানে!! ‘ছেলের হাতের মোয়া’ তো সহজলভ্য নয়। ছেলে তো দূরের কথা, বয়স্কদেরও ঠিকঠাকভাবে মোয়া ঝোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়। কখন মোয়া খেয়েছি মনে করতে পারলাম না। শুধু শীতকালে মিলে এমন একটি বস্তুকে কেনো যে সহজলভ্যের উদাহারণ হিসেবে টেনে আনা হয়েছিল কে জানে!!

কেমন ঘুরলাম জানতে চাইলেন আমার বন্ধু। ভাবী বললেন, ‘গল্প পরে হবে। আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। রাত হয়ে গেছে।’ আবার খাবো? নিজেকে প্রশ্ন করলাম। নাইট মার্কেটের ভাজাপোড়া খাওয়ার কথা বললাম। ক্ষুধা নেই বলেও জানালাম। কিন্তু নাছোড়বান্দা বন্ধু এবং ভাবী। বললেন, খাবেন না মানে!! ডিনার করতে হবে না? ভাজাপোড়ায় ডিনার হয় নাকি!! সাথে ইমুশনাল টাচ দিয়ে ভাবী বললেন, আমরা সন্ধ্যায় ডিনার করি। আজ আপনার জন্য এতোরাত অব্দি না খেয়ে বসে আছি। তাড়াতাড়ি আসেন, ক্ষুধা লেগেছে।

এমন ইমুশনের পর আর কথা চলে না। আমি দ্রুত রুমের দিকে পা চালালাম। ফিরে এসে দেখি বন্ধু টেবিলে বসে আছেন। আমাকে দেখে প্লেট টেনে নিলেন। পাশের চেয়ারে আমার প্লেটও বাড়িয়ে দিলেন।

টেবিল ভর্তি হয়ে গেছে খাবারে। এত রকমের খাবার যে টেবিলে রাখা সম্ভব হয়নি। পাশের শো’কেজের সেল্ফের মতো একটি অংশেও খাবার রাখা হয়েছে! খাবারের বহর দেখে চমকে উঠলাম। বিদেশের টেবিলে দেশীয় সব খাবার। টমেটো এবং আলু দিয়ে ইলিশ, সিমের বিচি দিয়ে কই মাছ, রূপচান্দা ফ্রাই এবং লইট্যা মাছের পাশাপাশি গরু, মুরগী ও খাসির মাংস। সবজিও কয়েক রকমের। ইছা শুটকি দিয়ে কচুর লতি!! হংকংয়ে প্রচুর নদনদী কিংবা সাগর রয়েছে। তাই ইছা শুটকি পাওয়া যেতেও পারে, কিন্তু কচুর লতি!!! হংকংয়ের পাহাড়ে পাহাড়ে কি কচুও হয়!! কথাটি বলতেই ভাবী হাসতে গিয়ে ভীষম খেলেন। পানি খেয়ে বললেন, আরে না, এগুলো সব দেশ থেকে আনা। খাইস্যাও দেশের, সীতাকুণ্ডের। ভাবী বললেন, দেশ থেকে আসার সময় এসব বেশি করে নিয়ে আসি। প্রসেস করে রেখে দিই। বিশেষ দিনগুলোতে রান্না করি। ভাবী বুঝিয়ে দিলেন যে, আজ বিশেষ দিন।

স্বামীর বন্ধু বেড়াতে আসার দিন যে বিশেষ দিন হয় তা আমার জানা না থাকলেও ভাবীসহ পুরো পরিবার দেশের একজন মানুষ পাওয়ায় যে আনন্দিত তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। আমরা আনন্দের সাথে খাবার খাচ্ছিলাম। বড় টেবিলে সবাই মিলে খাবার খাচ্ছি আমরা। গল্পে গল্পে ডিনার সারছিলাম। আমার পাতে দ্বিতীয় বারের মতো একটি কই মাছ তুলে দিয়ে বন্ধু বললেন, ভাত না খেলে সমস্যা নেই। এটা খান। আমার শুধু পেটই নয়, পাতও টুইটুম্বর। কোনটি রেখে কোনটি যে খাবো! এত আইটেমের মাঝে একটু একটু করে খেলেও অনেক খাওয়া হয়ে যায়। আমারও অনেক কিছু খাওয়া হয়ে গেলো। ভাবীর রান্নার হাত খুবই ভালো। প্রতিটি আইটেমই দারুণ হয়েছে, স্বাদে গন্ধে। তাই একটু আধটু করে করে খেতে খেতে এক সময় মনে হলো, প্রচুর খাওয়া হয়ে গেছে।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বন্ধু বললেন, ‘চলেন, হেঁটে আসি। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে ভালো লাগবে।

ভাত খাওয়ার পর একটু হাঁটতে পারলেই ভালো লাগে। তাছাড়া এখানে হাঁটা মানে নতুন কিছু দেখতে পাবো। অতএব সাথে সাথে পা বাড়ালাম আমি। বন্ধুসহ ঘরের বাইরে দাঁড়াতেই আমার প্রাণটি নেচে উঠলো। সর্বনাশা জ্যোৎন্সায় সব যেনো ভেসে যাচ্ছিলো। ( চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজ চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ