অসাম্প্রদায়িক সরকারের আমলে কেন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা

ডা. দুলাল দাশ | সোমবার , ৮ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ‘আমার বাংলাদেশে সংখ্যালগু বলতে কেহ নেই। আমরা সবায় বাঙালি, সবাই বাংলাদেশের নাগরিক সবার সম অধিকার’। তাই পাকিস্তান আমলে সংখ্যালগুদের মধ্যে তফশিল সম্প্রদায় যাদের ছেলে-মেয়েরা উচ্চ শিক্ষায় যেমন মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতো তাদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি ছিল যেটা মেধাতালিকার বাইরে ছিল। যেহেতু এখন সবাই আমরা বাঙালি। সেসময় ঘোষণা করা হলো, বর্ণ ভিত্তিক সুবিধা দেওয়া হবে না। সেই থেকেই সেটা বন্ধ হয়ে গেল। এখন আমরা বাঙালি সবার সমঅধিকার। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও কার্যত আমরা কি দেখছি, ধর্মীয় সংখ্যালগু সম্প্রদায়-সংখ্যালগুই রয়ে গেল। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর যে সমস্ত হিন্দুরা ভারতে বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গে চলে গিয়েছিল তারা বেশির ভাগ সচ্ছল ও সমাজে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন লোক ছিল। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদের অঢেল সম্পত্তি ভিটা মাটি ছেড়ে দেশ ত্যাগ করেছিল। বর্তমান অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে তাদের সিদ্ধান্ত ভালই ছিল।
১৯৭১ সালে ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু আমরা কি দেখতে পাচ্ছি প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো উছিলায় সংখ্যালগুদের উপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। সম্প্রতি নড়াইলের ঘটনা ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হিন্দুদের রান্নাঘরের রান্নাকরা ভাত-তরকারি, হান্ডিবাসন তছনছ ও লুট করে নিয়ে গেছে। সংখ্যালগু সম্প্রদায়ের একটা পারসেন্ট জনসংখ্যা তুলনামূলক ভাবে দরিদ্র ও নিরিহ। কোনো প্রকার খেয়ে পরে বেঁচে আছে। তারা যে কোনো প্রকারে তাদের পূর্বপুরুষদের ভিটে-মাটি আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। তাদেরকে তাড়াতে চাইলেও তারা এদেশ থেকে যাবে না। কারণ এটা তাদের মাতৃভূমি। তবে আমি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের স্বাক্ষী হিসাবে দৃঢ় কণ্ঠে বলতে চাই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যালগুদের অংশগ্রহণ, ত্যাগ, এমনকি গ্যারিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ সহ স্বাধীনতার জন্য অনেকেই প্রাণ দিয়েছিল। তাদের অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের বর্তমান সরকার প্রধান সবসময় এটা স্বীকার করে থাকেন। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীনতা বিরোধীরা পাকিস্তানী বাহিনীর মদদে সংখ্যালগুদের পাড়ার পর পাড়া, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে-পোড়ায়ে শেষ করে দিয়েছিল। ঘর থেকে বের করে এনে লাইন করে দাঁড় করিয়ে শত শত হিন্দুদের ব্রাশ ফাইয়ারে হত্যা করেছিল। নতুন প্রজন্মের কাছে এগুলো সম্পূর্ণ অজানা। বলতে গেলে বহু বিভৎস ও মর্মান্তিক ঘটনা তখন ঘটেছিল। তারপরও হিন্দুরা ভিটেমাটি এখনও আঁকড়ে ধরে আছে। ইতিহাসের পাতায় এগুলি লিখা হয়ে আছে। যাদের এত ত্যাগ তারা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কী পেল? এক শ্রেণির লোকদের কাছে অবহেলা ও ঘৃণার পাত্র হয়ে রইল। তারা আজ গ্রামে গঞ্জে পরিবার পরিজন নিয়ে সদা আতংকগ্রস্ত, ঠিকমত ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারে না, ভয়ে ভয়ে থাকে। কখন তাদের উপর হিংস্র থাবা নেমে আসে। স্বাধীনভাবে তারা ধর্ম পালন করতে পারে না। বার বার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর আঘাত আসে। আদিকাল থেকে তারা এদেশেরই বাসিন্দা। তাদের চাষবাস ভূসম্পত্তি সবই তাদের ছিল এখনও আছে। জাতীয় পর্যায়েও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সব কিছুতে তাদের অংশিদারিত্ব রয়েছে। খেলাধুলায় তাদের অংশগ্রহণ দৃশ্যমান। সরকারের উচ্চপর্যায়েও তাদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। তবে কেন তাদের এদেশ থেকে তাড়াতে চায়? কেন তাদের ভূসম্পত্তি জবরদখল করতে চায়। দেশের কোনো এক জায়গায় একটা সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটলে আমরা দেখি সরকারি লোকজন, জনপ্রতিনিধিরা, দলের নেতারা এবং প্রশাসনের লোকজন ঘটনাস্থলে আসেন। কিছু বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হল, ধংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পুনঃনির্মাণ করে দিল- এ পর্যন্ত। কিন্তু যেটা সব চেয়ে এ মুহুর্তে দরকার সেই কঠোর বিচার ব্যবস্থা যেটা বিলম্ব হতে হতে একদিন হারিয়ে গেল। দুষ্কৃতিকারীদের অপরাধের এই যে বিচারহীনতা সেটা আর একটা ঘটনা ঘটাতে উৎসাহ যুগিয়ে দিল। তা না হলে সারা বৎসর দেশের কোথাও না কোথাও একিই ঘটনা ঘটতে থাকে কেন? তাই কবি সুকান্তের ভাষায় বলি ‘অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি/জন্মেই দেখি হিংস্র স্বদেশভূমি’। অবাক লাগে সকালে বাজারে যাদের সাথে একসাথে বসে চা খেয়েছি তাদের সামনেইত ঘটনা ঘটলো-কই তারা কেউ এগিয়ে আসেনি। ইচ্ছা থাকলে তারা বাঁধা দিতে পারতো। তারাতো প্রতিবেশী। যদি স্থানীয়রা এগিয়ে আসে তবে এ ধ্বংসলীলা দেখতে হতো না। এই সনাতনধর্মী লোকেরা দেশের জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ তারাতো অন্যকোনো দেশ থেকে রিফিউজি হয়ে আসেনি। বংশানুক্রমে তারা এদেশের নাগরিক শত বছর ধরে এখানে বাস করছে। ছোট বেলা থেকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবায় একসাথে বড় হয়েছে, একসাথে খেলাধুলা করেছে, একসাথে স্কুল কলেজে গিয়েছে, তারা একে অপরের অতি পরিচিতও বন্ধু। তবে কেন এই নির্মম পরিহাস? যারা এই গুলি করছে তাদের মানবতাবোধ নেই। তাদের বুঝা উচিত মানব ধর্ম বড় ধর্ম। গ্রামে গঞ্জে একটা দুর্বল সম্প্রদায়ের উপর এই জুলুম, অত্যাচার- এটা কি পাপ নয়? আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাকে আমরা ্থগড়ঃযবৎ ড়ভ ঐঁসরহরঃু্থ বলে থাকি তিনি এ সমস্ত ঘটনায় খুবই মর্মাহত। তিনি এব্যাপারে জিরো টলারেন্স ব্যক্ত করেছেন। তারপরও কেন এই লোমহর্ষক ঘটনা থামছেনা। এটা নিয়ে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে নচেৎ যে উন্নয়ন আমরা দেখছি তা একটা সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে হতে পারে না। গুণীজনেরা বলে- বাংলাদেশ এখন আর অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নয়। এখানে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে আছে- যেটা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ছিল না।
এখানে জনগণের সাম্প্রদায়িকতার চরিত্রটা অনেকাংশে রাজনৈতিকও বটে। সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। কিন্তু ঘটনা প্রবাহে মনে হয় এই আইন বিশেষ কার্যকর নয়। এই আইন প্রতিষ্ঠা করার পর মনে হচ্ছে সংখ্যালগুদের উপর অমানবিক নিপীড়ন আরও বেড়ে গেছে। কারণ বিগত ৭-৮ বছরের নানা জেলায় সংখ্যালগুদের উপর নির্যাতন, তাদের মন্দির, বিগ্রহ ভাঙচুর, হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জীবিকা ধ্বংস, বাড়ি ঘরে আগুন, লুট পাটের অসংখ্যা ঘটনা প্রমাণ করে ডিজিটাল আইনটি সত্যিই দুর্বল। এ দেশের সংখ্যালগুরা স্বায়ত্বশাসন বা আলাদাভূখণ্ড চায় না।
যে সরকারই আসুক তারা সদা সরকারের অনুগত, উন্নয়নের কাজের অংশীদার হিসাবে থাকতে চায়। তারা কোনো সময় সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত নয় এবং ছিল না। তবে তাদের অপরাধ কোথায়? তারা চায় তাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশে একটু শান্তিতে বসবাস করতে। এখানে প্রশ্ন জাগে যদি তাদের কোনো অপরাধ না থাকে তবে কেন এই নির্মমতা? শুধু তারা কি হিন্দু বলে? অন্যভাবে চিন্তা করতে গেলে দুষ্কৃতকারিরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায়। আমরা দেখি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংখ্যালগুদের মত এদের দাবি দাওয়া, আচার-আচারণ সেরকম নয়। তারা মাঝে মধ্যে রাস্তায় আন্দোলন করে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ও নাগরিক মর্যাদা পাওয়ার জন্য। স্বাধীনতার পর এ দেশে সংখ্যালগুদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যা ২৮% এর উপর সেটা এখন কমতে কমতে ৭% এ নেমে এসেছে। এটা অতি সম্প্রতি জনশুমারি থেকে পাওয়া সংখ্যা। ভবিষ্যতে এটা আরও কমে যেতে পারে। তবে এক জাতি ভিত্তিক কোনো দেশ চলতে পারে না। দেশের গুণীজনেরা বলতে চান সাম্প্রদায়িকতায় রাষ্ট্রের দুর্বলতা রয়েছে। অসাম্প্রদায়িক সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও আমরা অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। দেখা যায় ধর্মীয় উগ্রবাদীরা স্থান করে নিয়েছে। ধর্মকে ব্যবহার করে বার বার যে সহিংসতা ঘটছে তাতে সরকারের ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। প্রতিটা ঘটনায় স্থানীয় জন প্রতিননিধিদের জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। আজ সমাজে শুভবুদ্ধির মানুষেরা নিষ্ক্রিয় বলেই বার বার এসব ঘটনা ঘটছে। সরকারের কাছে আকুল আবেদন এই সহিংসতা থেকে সংখ্যালগুদের রক্ষা করুন। তবেই দেশ আরও এগিয়ে যাবে।
লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গমাতা
পরবর্তী নিবন্ধস্বাধীনতা সংগ্রামের বীর যোদ্ধা শ্রমিক নেতা নূর আহমদ